ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মাহফুজ রিপন

যাপিত জীবনের নন্দনভাবনা

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

যাপিত জীবনের  নন্দনভাবনা

‘মহাসমারোহে পার হলো জীবনের চুয়াত্তর বছর। কর্মস্থল নাটকের মঞ্চে। যেখানে কেটেছে অর্ধেকের বেশি জীবন, জানি না কী সাধিত হয়েছে, অভ্যস্ত হয়েছি মঞ্চের ব্যারোমিটারে জীবনের। সুখ-দুঃখের পরিমাপ করতে বন্ধু-স্বজন-সহকর্মীদের মাঝে নাটকের সংসার আমার। জীবনের একূল ওকূল ভাসিয়ে দিয়েছিÑ কী হতে পারে এর চেয়ে বড় পুরস্কার’ (নাটকের সংসার-১৩ পৃষ্ঠা)। দেশবরেণ্য নাট্যজন মঞ্চসারথি আতাউর রহমান। গত পঞ্চাশ বছর যাবৎ মঞ্চনাটকের সাথে অভিনেতা, নির্দেশক এবং সংগঠক হিসেবে তিনি নিবিড়ভাবে জড়িত। টেলিভিশন নাটকের ক্ষেত্রেও তার পদচারণা উল্লেখযোগ্য। তার নির্দেশিত নাটকÑ বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রোঁ, মাইলপোস্ট, সাজাহান, গডোর প্রতীক্ষায়, ঈর্ষা, রক্তকরবী, বাংলার মাটি বাংলার জল উল্লেখযোগ্য। নাট্য রচনার ক্ষেত্রে তিনি একাধিক বিদেশী নাটকের বাংলা অনুবাদ ও রূপান্তর করেছেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১২টি। তবে এবার ‘স্বপ্নলোক’ যে বইটি প্রকাশ করেছে সেটা একটি কবিতার বই। কাব্যগুণ সমৃদ্ধ এ বইটির সমস্তটাই যেন আবহমান এক বাংলার মুখ। কবিতার শব্দচয়নে পেয়েছে বহুমাত্রা। প্রকৃতি ও নিসর্গ বন্দনাগীত সমৃদ্ধ এ কাব্যে লোকঐতিহ্য ও সং¯ৃ‹তিকে ধারণ করে রূপ নিয়েছে একটি আখ্যানে। মঞ্চ সারথির কবিতায় আমরা পাই সমাজ, সংসার, দেশ, প্রকৃতি, পরিবেশ ঘিরে এক জীবন চক্রের বর্ণনা, জীবন বহুমাত্রিক আর পাঠক তার সমগ্র অনুভূতি দিয়ে দেখতে পায় যে দৃশ্যকাব্য তা দেশ, বিদেশ, প্রেম এবং উদার মানবতাবোধের। কথায় আছে সাহিত্যের সহজিয়া সাধনের পথে যারা হাঁটেন তাদের কপালে সহজ সিদ্ধি থাকে না। কিন্তু এ মানুষটি সাহিত্যের যে শাখায় হাত দিয়েছেন সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন। জীবনকে তিনি উপলব্ধি করেছেন কাছ থেকে। তার কবিতায় উপমামুখর যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা রূপক, পাঠককের মাধ্যে তিনি যে ঘোর তৈরি করেণ সেটা জীবন বোধ, সুন্দর এবং মৃত্যুর কথা বলে। ‘শৈশবে গ্রামের বাড়ির গাছের ডালে হরিয়াল পাখির পেলব-বাহারি রূপ মুগ্ধ করেছিল আমাকে একদিন; চোখে সে সুন্দরের ঝালর আজও আমি বয়ে বেড়াচ্ছি। দেশে-বিদেশে দূর-দূরান্তরে। জানা, না-জানা গাছের ডালে খুঁজেছি সে হলুদ- পা হরিয়াকে। বৃথা যায়নি যে খোঁজা, পেয়েছি চোখ-ভরা সে অনাবিল সুন্দরকে। কাক পাখিও সুন্দর হয়ে উঠেছে গাছের ডালে প্রাণ ভরে পেয়েছি আমি সে হরিয়ালকে’ (হরিয়াল-১৭ পৃষ্ঠা)। মঞ্চসারথির কাব্যকথা বইটির হরিয়াল কবিতায় শৈল্পিক শুদ্ধতার যে জাল তৈরি হয়েছে তা চিত্রপট নয় মানব মনের চিত্তপটের ছবি। সমকালীন বিশ্বনাট্য, ইতিহাস, দর্শন, নিসর্গ, মনোদৈহিকটান, স্ববিরোধ ও টানাপোড়েনের এক ব্যাপক আয়োজন এ কাব্যে। সাধারণ মানুষের শ্রম ও অসাধারণত্ব দিয়ে সৃষ্ট সভ্যতা আর এর সামাজিকতার ভেতর প্রবিষ্ট যে বোধ যাকে কবি তাঁর ভাষাশৈলী ও অভিজ্ঞান এর সংশ্লেষে জাগিয়ে দিতে চেয়েছেন। প্রতিভা আর সৌভাগ্যের জাদুকরী মিশেল এক হয়ে মঞ্চসারথিকে করে তুলেছেন প্রবাদপ্রতিম। বইটির ভূমিকায় দেশবরেণ্য কবি শামসুল হক লিখেছেন- ‘আতাউর আমার সর্বাধিক নাটকের নির্দেশক। শক্তিমান অভিনেতা তিনি। মঞ্চসারথির কাব্যকথায় সহজ সরল উচ্চারণে, কবিতার পঙক্তির পর পঙক্তিতে, ভেতরের ভাব ও ভাবনাকে আমাদের কাছে উপস্থিত করেছেন। আমি স্পৃষ্ট হয়েছি। আশা করি আপনারাও হবেন।’ ‘আকাশে মেঘ দেখা যায়, উড়ে যায় সে মেঘ; ঝলমলে আকাশে আবার গম্ভীর ধূসর হয়, রবীন্দ্রনাথের লুকোচুরি খেলার মতো, আমার জীবনে চলছে সে খেলার আখ্যান, আমি পড়ে যাচ্ছি, উঠে দাঁড়াচ্ছি, অসম্ভব জেদি মনে হয় নিজেকে, মনে হয় স্বেচ্ছায় শুয়ে পড়ি কবরে, পিতামহ ভীষ্মের ইচ্ছামৃত্যুর মতো!’ (জেদÑ ৬১ পৃষ্ঠা) কবিতার নন্দনতত্ত্বের দিক থেকে মঞ্চ সারথি কবি আতাউর রহমান বাস্তববাদী। তাঁর কবিতায় প্রকৃতি, রাজনীতি এবং প্রেম- এ তিনটি বিষয় সমানভাবে প্রতিষ্ঠিত। কবিতায় এবং জীবন ভাবনায় রবীন্দ্রনাথের প্রভাব অনস্বীকার্য। আলো আঁধারের এ কবি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মঞ্চ সারথির কাব্যকথা’র মাধ্যমে পাঠককে নিয়ে যাবেন কাব্য রসের অমৃত সদনে। পাঠক খুঁজে পাবে স্বার্থক এক কাব্য সম্ভার ঠিক জীবনের মতো, স্বার্থক।
×