ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জিয়া হায়দার

এ লে বে লে

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

এ লে বে লে

(পূর্ব প্রকাশের পর) নির্দেশক : সে উঠে আসে দর্শকদের সামনে। ছেলে : ওকে আমার ভালো লাগে, ভীষণ ভালো লাগে। ওরও নাকি আমাকে ভালো লাগে। এই যে ভালো লাগালাগি একে যদি ভালোবাসা বলা যায়, তাহলেই মুশকিল। ভালবাসা ব্যাপারটা আমার খুব পছন্দ নয়। এর চেয়ে প্রেম করা কথাটা শুনতেও ভালো, করাটাও বেশ আনন্দের। সে জন্যেই ভালোবাসতে ভালোবাসিনা, প্রেম করতে ভালোবাসি। প্রেম জিনিসটা একনাগাড়ে অনেকের সঙ্গে করা যায়। কিন্তু ভালোবাসাটা একজন ছাড়া হয় না। (ইতোমধ্যে ওয়েটার কাঞ্চুর ইঙ্গিতে ছেলের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়েছে।) আলী সাহেব একটা প্রবলেম। নির্দেশক : কিসের প্রবলেম। ছেলে : এই হাত দুটো দিয়ে কি করবো। নির্দেশক : ও। তা... কখনো পকেটে রাখবে, কখনো বাইরে রাখবে। (ছেলে পকেটে হাত ঢোকায় ও দেশলাই বের করে। নির্দেশক ছেলেকেই অনুসরণ করে। সে সিগ্রেট বের করে। প্যাকেটে ঠুকে ঠুকে দেশলাই জ্বালিয়ে ধরায়।) ওয়েটার : (কাঞ্চুকে ফিসফিস করে) মেনুটা কি হাতে দেব? কাঞ্চু : না থাক। নির্দেশক : (কাঞ্চুকে) কি হচ্ছে? কাঞ্চু : বিজনেস প্রসপেক্ট চিন্তা করছি। ছেলে : কি, ভুল হয়েছে। নির্দেশক : না, চালিয়ে যাও। ছেলে : প্রেম কথাটা নিয়ে ইদানীং আমি বেশ ভাবনা-চিন্তা শুরু করেছি। কারণ হচ্ছে গিয়েÑ কিছুদিন হলো আমার একটা গাড়ি হয়েছে। কেমন করে হয়েছে সে কথা আমার আত্মজীবনীতে লেখা থাকবে। আমার এক বন্ধু খুব ভালো খাতা লেখে। তাকেই বলেছি আমার আত্মজীবনী লিখে দিতে। শিগগিরই শুরু করবে সে। (সংলাপ ভুলে গেছে। মাথা চুলকাতে থাকে। সিগারেটে একটা-দুটো টান দেয়।) সেই গাড়িটা হওয়ার পর থেকেই আমার বেশকিছু শাসালো বন্ধু হয়েছে। আমোদ ফুর্তির আয়োজন হয়েছে। আরো কতো কি। এ সবের ফলেই প্রেম নামক জিনিসটা... এ সবের ফলেই... (আবারো ভুলে গেছে। সিগেরেট ফেলে দিয়ে নিভিয়ে দেয়। ঘড়ি দেখে। বাইরের দিকে তাকায়।) নির্দেশক : (ফিসফিস করে) কি হলো থেকে আছো কেনো। ছেলে : (ফিসফিস করে) লাইন ভুলে গেছি। কিউ ধরিয়ে দিন। নির্দেশক : (ফিসফিস করে) এই রে সেরেছে।... (জোরে) সে পায়চারী করতে শুরু করে। (ছেলের পায়চারী করাকালে কাঞ্চু খিকখিক করে হাসতে থাকে। দর্শকদের ভেতর থেকেও দু’একজন হাসে। নির্দেশক বিরুক্ত হয়। ছেলেটিও অপ্রস্তুত বোধ করে।) ছেলে : (পায়চারী করতে করতে একবার নির্দেশকের কাছে এসে ফিসফিস করে) আর কতো পায়চারী করবো। নির্দেশক : (ফিসফিস করে) মনে করার চেষ্টা করো। ছেলে : (ফিসফিস করে) পারছি না। আপনি ডায়ালগ বলে দিন। নির্দেশক : (ফিসফিস করে) ওই যে ভালোবাসা ভালোলাগা এসব কথাই আবার শুরু করে দাও। (ছেলে মধ্যমঞ্চে আসে। ভাবতে থাকে। কাঞ্চু কয়েকবার নকল কাশি দেয়।) ছেলে : ওকে আমার ভালোলাগে। এতো ভালো আর কাউকে লাগেনি। সে আমার মনপ্রাণ সমস্ত অধিকার করে নিয়েছে। ওকে ছাড়া আমি আর কাউকেই ভাবতে পারি না। ওকে ছাড়া আমার জগৎ শূন্য মনে হয়। আকাশ অন্ধকার হয়ে যায়। মজনু যেমন লাইলির কুকুরকেও ভালোবেসেছিল, আমিও তেমনি ওর ছোঁচা বেড়ালটাকেও কোলে তুলে নিতে ঘেন্না করিনে। নির্দেশক : তোমার ভয়েস-এ মডুলেশন নেই কেন; মডুলেশন আনো। ছেলে : (জনান্তিকে) ওটাতো আপনারও নেই। (প্রকাশ্যে) আপনি একটু দেখিয়ে দিন। নির্দেশক : (গম্ভীর গলায়) ছেলেটি অস্থির অস্থির ভাব করতে থাকে। ছেলে : (নির্দেশককে অনুকরণ করে) কিন্তু সে আসছে না কেন? (কাঞ্চু খিক খিক করে হেসে উঠে। কয়েকজন দর্শকও জোরে হাসতে থাকে। ছেলে অপ্রস্তুত হয়ে তাকিয়ে নিজেও মুচকি হাসে।) নির্দেশক : (রেগে) কাঞ্চু। কাঞ্চু : (হাসতে হাসতে) হাসি পেলে হাসবো না, নাকি এ্যাঁ। নিদের্শক : (ছেলেকে) চালিয়ে যাও। ছেলে : ছেলে ভাবতে ভাবতে গিয়ে বসে পুরুষ ও মহিলার জন্য সংরক্ষিত আসনে। ওই অংশে আবছা আলো জ্বলে উঠে। (স্বাভাবিক গলায়) কিন্তু সে আসছে না কেন? নাকি সে অন্য কারো সঙ্গে আজকের বিকেল কাটাতে গেছে। আমি জানি ওকে অনেকেরই ভালো লাগে। না, না। সে অমন করবে না। সে আমায় কথা দিয়েছে। আজকের পার্টিতে সে আমার সঙ্গেই যাবে।... কি করবো আমি এখন?... একটা বিরহের গান গাইলে কেমন হয়। নির্দেশক : মিউজিকÑ প্যালোস (মিউজিশিয়ান নির্দেশ পালন করে) ছেলেটি বিভ্রান্ত পায়ে ফিরে আসে টেবিলে। বসে। গালে হাত দিয়ে ভাবতে থাকে।... হঠাৎ সোজা হয়ে বসে। ছেলে : না, গান নয়। নির্দেশক : মিউজিক স্টপ। ছেলে : (একটুক্ষণ ভেবে নিয়ে) তার চেয়ে ওর জন্যে একটা চিঠি রেখে যাই। এই হবে আমার শেষ সচিত্র প্রেমপত্র। উত্তেজিতভাবে যেয়ে বসে প্ল্যাটফর্মে। ওয়েটার... নির্দেশক : চিঠি? চিঠির কথা তো বলা হয়নি। (ততোক্ষণে ওয়েটার এসে থমকে দাঁড়িয়েছে।) ছেলে : ইমপ্রোভাইজেশন। (ওয়েটারকে) এদিকে এসো। (ওয়েটার তার কাছে এগিয়ে আসে।) নির্দেশক : বেশ তবে আর করবে না কিন্তু। মাফ করে দিলাম। দরকার হলে আমিই ইমপ্রোভাইজ করে দেবো। ছেলে : (ওয়েটারকে) এক টুকরো কাগজ আর কলম-টলম দাও তো। কাঞ্চু : এই যে নায়ক সাহেবÑ ছেলে : বলুন। কাঞ্চু : মেনুতে কাগজ কলমের কথা নেই। নির্দেশক : কাঞ্চু! কাঞ্চু : ইমপোভাই। ছেলে : (ওয়েটারকে) যাও, নিয়ে এসো। নির্দেশক : (হঠাৎ তার নিজের অবস্থান ও ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হয়, দাঁড়িয়ে যায়) না, না। (ওয়েটার যেতে যেতে থেমে যায়) ঠিক মতো সিকোয়েন্স অনুযায়ী করে যাও। ছেলে : সিকোয়েন্স! নির্দেশক : হ্যাঁ। আমি নির্দেশ দিচ্ছি। কেন তোমার জানা নেই, আমার নির্দেশ তোমাকে বিনাদ্বিধায়, বিনাপ্রশ্নে পালন করতে হবে? ছেলে : হ্যাঁ, তাই।... কিন্তু... নির্দেশক : কিন্তু কি? ছেলে : উল্টোপাল্টা করে ফেললে? নির্দেশক : উল্টোপাল্টা করলে! জানো, সোজা জিনিসকে উল্টোপাল্টা করলে কি হয়? ছেলে : (কাঁধ ঝাঁকিয়ে) একটু অন্যরকম দেখায়, এই আর কি। নির্দেশক : তোমাকে যদি পা দুটো উপরে তুলে হাঁটতে বলি সেটা কি রকম দেখাবে? ছেলে : হ্যাঁ, এরকম একটা যোগ ব্যায়াম আছে, শুনেছি। নির্দেশক : কি রকম দেখাবে, সেইটে বলো। ছেলে : লোকে দেখবে নির্দেশক সাহেব অমনটিই চান। কারণ... নির্দেশক : কারণ? ছেলে : নির্দেশক সাহেবের নিজের ওই যোগ ব্যায়ামটি খুব পছন্দের। (কাঞ্চু, ওয়েটার ও দর্শকরা হেসে উঠে।) নির্দেশক : (ছেলের দিকে কিছুক্ষণ ক্ষুব্ধ চোখে তাকিয়ে থেকে) বেশ। (একটু থেমে) দরকার হলে তোমাকে মাফ করে দেবো। অবশ্য দরকারটা যদি হয় আমার। বলতে বলতে বসে পড়ে। নইলে নাটক বন্ধ করে দেবো। ছেলে : ওয়ান্ডার ফুল। তাহলে তাই দিন। (উঠে দাঁড়ায়) নির্দেশক : হ্যাঁ, প্রয়োজন হলে তাই দেবো। ছেলে : আপনার পাঁঠা- ল্যাজে কাটেন আর মাথায় কাটেন আমার কি। নির্দেশক : আমার নাটকের জন্যে তোমার একটু দরদও নেই? ছেলে : থাকতো, যদি বেদরদের মতো কথা না বলতেন। কাঞ্চু : এ রকম বেনজির ব্যাপার-স্যাপার চলতে থাকলে... নির্দেশক : তুই এর মধ্যে বেমক্কা কথা বলিস নে। কাঞ্চু : আ—চ্ছা। ছেলে : এ সব বেতালা কথাটথা বাদ দিয়ে নাটক বন্ধ করে দেবার প্রস্তাবটাই গ্রহণ করলাম। (‘করলাম’ কথাটার সঙ্গে সে টেবিলে একটা ঘুষি মেরে চলে যেতে উদ্যত হয়।) নির্দেশক : না, এখনই বন্ধ করতে চাই না। ছেলে : তাহলে ডায়ালগ ধরিয়ে দিন। নির্দেশক : সে তোমারই মুখস্ত রাখার কথা। ছেলে : তবু প্রম্পটার রাখতে হয়। (চলবে)
×