ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নুরুল করিম নাসিম

জার্নাল

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

জার্নাল

সাত. বাহাত্তর সালে বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় হঠাৎ একটা জোয়ার আসে। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আমার বিষয় ছিল ইংরেজী সাহিত্য। বাংলাদেশের একমাত্র এবং প্রথম নাট্যবিষয়ক পত্রিকা রামেন্দু মজুমদারের সম্পাদনায় বেরিয়েছে। প্রথম সংখ্যা মুনীর চৌধুরীর প্রতি নিবেদিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র নাট্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। বেশ হৈ চৈ পড়ে গেছে চারদিকে। এদিকে নাগরিক নাট্যগোষ্ঠী কলকাতার বাদল সরকার রচিত ‘বাকী ইতিহাস’ টিকিটের বিনিময়ে মহিলা সমিতি মঞ্চে মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করেছে। একই সময়ে মামুনুর রশীদ তার ‘পশ্চিম সিঁড়ি’ নাটক নিয়ে এসেছেন মঞ্চে। ইংরেজী বিভাগের আমরা কয়েকজনÑ আমি, খায়রুল আলম সবুজ, কাজি জাহাঙ্গিরুল আলম, ইতিহাস বিভাগের হাসান ও আরো অন্যরা মিলে ‘স্বরলিপি ড্রামা সার্কেল প্রতিষ্ঠা করি। আমার লেখা নাটক ‘সোনার হরিণ’ টিএসসিতে মঞ্চস্থ হয়। পর পর তিনদিন। শেষের দিন নাটক দেখতে আসেন নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। নাটক শেষে তিনি ‘থিয়েটার’ ত্রৈমাসিকে ছাপার জন্য ‘সোনার হরিণ’ নাটকটি চেয়ে নিলেন। সে দিন আমার কী যে আনন্দ। খুবই অভিভূত হয়েছিলাম। বিপুল আগ্রহ নিয়ে আরেকটি নাটক লিখে ফেললাম ‘বিজয় বাড়ীতে নেই’। এটাও টিএসসিতে মঞ্চস্থ করলাম। পরে ১৯৭৫ সালে ‘থিয়েটার’ এ ছাপা হয়। সেলিম আলদিন, আল মনসুর, হাবিবুল হাসান, শাহনুর খান ওরা নাটক লিখে টিএসসির মঞ্চে নিয়ে এলো। বেশ হৈ চৈ এবং আলোড়ন শুরু হয়ে গেল। নাটক এমন একটি শিল্প মাধ্যম যা সার্বক্ষণিক সময় ও মনোযোগ দাবি করে। আমি সেরকম, সময় দিতে পারতাম না। সেলিম আলদীন, আল-মনসুর, হাবিবরা পেরেছিল। ’৭৬ সালের পর থেকে আমি চাকরি-বাকরি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ’৮০ সালে অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে চলে গেলাম বিদেশে। শেষের বারো বছর গল্প-কবিতা নিয়ে মগ্ন হয়ে রইলাম। এ সময় আমি গল্প লিখেছি। ’৭৯ সালে ‘যে যার ভূমিকায়’ গল্পগ্রন্থটি বাংলা বাজারের একজন প্রকাশক তার ছোটখাটো প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশ করে। বন্ধু রফিক নওশাদ এ সময় কবিতার পত্রিকা ‘কালপুরুষ’ বের করার উদ্যোগ নিয়েছে। আমাকেও কবিতা এবং কবিতাম বিষয়ক প্রবন্ধ লিখতে উদ্বুদ্ধ করে। সেই সময় রফিক আজাদ, হুমায়ুন কবির, সায্যাদ কাদির, মোহাম্মদ নূরুল হুদা, ফরহাদ মাজহার প্রমুখ একই ফ্লাটফর্মে একত্রে কাজ করতো। আজকের মতো সবাই সেদিন আলাদা হয়ে যায়নি। আমাদের আড্ডার জায়গা ছিল শরিফ মিয়ার ক্যান্টিন। রোজ বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসের পরে আমরা সেখানে একত্রিত হতাম। তখন এত ভিড় ছিল না, এত মিছিল মিটিং ছিল না। বেশ নির্জন ছিল ক্যাম্পাস। আট. একদিন হঠাৎ আবুল হাসনাত ভাইয়ের টেলিফোন পেলাম। তখন বিকেল পড়ে এসেছে। আমি বাইরে বেরোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছি। ’৭২ সালে হাসনাত ভাই ‘সংবাদ’এর সাহিত্য সাময়িকী পাতার দায়িত্বে ছিলেন। ‘গণসাহিত্য’ মাসিক সাহিত্য পত্রিকাটিও সম্পাদনা করতেন। তখন আমার বেশ ক’টি ছোটগল্প অত্যন্ত যতœ নিয়ে সংবাদ সাময়িকীর পাতায় ছেপেছিলেন। তার টেলিফোন পেয়ে যুগপৎ বিস্মিত ও অভিভূত হলাম। তিনি বললেন, নাসিম আপনি বিদেশী বই কিংবা বিদেশী সাহিত্য বিষয়ে প্রতি একমাস অন্তর আমাকে একটি লেখা দিবেন। আমার মনে পড়লো প্রয়াত কবি আহসান হাবিবের কথা। তিনিও বিদেশী সাহিত্য সম্পর্কে লেখার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলেন আমাকে একদিন। আমি রাজি হয়ে গেলাম। কিন্তু কাজে নেমে দেখলাম আসলে তা সহজ নয়। প্রথমত : বিদেশী বই আমাদের বই বিপণিগুলোতে নিয়মিত আনা হয় না। দ্বিতীয়ত : অর্ডার দিলে আনতে বেশ সময় লাগে। তারপরেও সিলেবাস তৈরির মতো একটি তালিকা প্রস্তুত করলাম। কবি, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, প্রবন্ধকার এরকম ভাগ করে নামের একটি তালিকা তৈরি করে লেখা শুরু করলাম। প্রত্যেকের অন্তত দু’তিনটি বই, তাদের সাক্ষাৎকার, তাদের আত্মজীবনী, তাদের চিঠিপত্র পড়ে নিয়ে শুরু করলাম। বেশ সময় ও শ্রম ব্যয় হলো। হাসনাত ভাই অসম্ভব যতœ নিয়ে ছাপালেন। পরে ‘অ্যাডর্ন’ থেকে ‘বিশ্বসাহিত্যে কথাশিল্পী তেরো’ নামে বই হিসেবে ২০০৯ সালে বই মেলায় বইটি ছাপা হয়েছিল। একই বিষয়ে আরো দু’টি বই দূরের হাওয়া’ এবং ‘বাইরের জানালা’ বাংলা বাজারের অয়ন প্রকাশনী পরপর দু’বছর একুশের বইমেলায় এনেছিল। অনেক দিন ধরে বইগুলো আর পাওয়া যাচ্ছে না। এখন যখনই বাইরের সাহিত্য সম্পর্কে কিছু লিখতে বসি অই দুই সম্পাদকের অনুপ্রেরণার কথা খুব মনে পড়ে। সমসাময়িক কয়েকজন সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদক নোবেল, ম্যানবুকার ও পুলিৎজার পুরস্কার ঘোষণার আগে থেকে আমাকে লেখার জন্য তাড়া দিতে থাকে। ব্যস্ততার কারণে এখন আমি তেমন একটা সাড়া দিতে পারি না, কিন্তু মনের গহীন গোপনে এক ধরনের উৎসাহ নিরন্তর অনুভব করি।
×