তিন প্রজন্মের গান
আসাদ মান্নান
বাঙালীর যমজ কবিতা
মূলত বাঙালী যারা বাংলাদেশ তাদের হৃদয়,
যে হৃদয়ে একজন বাঙালীর মূল রক্তনালি
মায়ের নাড়ির সঙ্গে সন্তানের বন্ধন যেমন
তিনি আর বাংলাদেশ পরস্পর অভিন্ন তেমন:
এ সত্য সূর্যের মতো আলো দিচ্ছে প্রজন্মের চোখে
গোলাপের আস্ফালনে মুগ্ধ হয়ে উড়ে আসে ভোর
জেগে ওঠে ডিজিটাল স্বপ্নপ্রেমী যুবা ও যুবতী।
অশুভ জঙ্গীর থাবা আর বাঙালীচেতনানাশী
ক্ষমতার মধুখোর অন্ধকারে জন্ম নেয়া জন্ম-
জানোয়ার যতই আঘাত ওরা হানুক না কেন
ওরা বেশ জানেÑ লাখো শহীদের রক্তে জন্ম নেয়া
এ দেশে যদিও ওরা জন্মিয়াছে, তাদের এ জন্ম ভুল জন্ম।
সবুজ বনানী ঘেরা আমাদের স্বদেশম-লে
নক্ষত্রকুসুম স্বপ্ন বুকে জ্বেলে হে বন্ধু সারথী
আসুন সবাই আজ কুয়াশার জঙ্গী বদে নামি,
প্রিয় দেশজননীর ইজ্জত বাঁচাতে এক পায়ে
এক পথে হাঁটি; আবার সবাই বলি এক কণ্ঠেÑ
এক নেতা এক দেশÑ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ
এক ও অভিন্ন দু’নাম বাঙালীর যমজ কবিতা।
আলোর নদীর স্রোতে
আলোর নদীর স্রোতে দ্যাখো আজ সেই আততায়ী অমাবস্যা
ভেসে যাচ্ছে; একদিন যে নগর ব্যর্থ হলো পিতাকে বাঁচাতে,
সে-নগর নতুন দিনের স্বপ্নে আগুনের জামা গায়ে উঠে দাঁড়িয়েছে:
বেঁচেও মৃতের মতো ভয়ে ভয়ে যারা তেত্রিশ বছর ধরে
‘স্বাধীনতা’ এই প্রিয় শব্দটিকে লুকিয়ে রেখেছে, অই দ্যাখো
দ্বিধা ভয় জয় করে তারা আজ দাঁড়িয়েছে মুক্তিমোহনায়;
সূর্যকে আঁচলে নিয়ে কুয়াশার জাল ছিঁড়ে পিতার মতন
এ মাটিকে ভালোবেসে যে তাঁর দ্বিতীয় জন্মে
অনিবার্য মৃত্যুর দুয়ার থেকে বার বার ফিরে এসে
দাঁড়ালেন রবীন্দ্রনাথের গানে, দরিদ্রজনের ঘরে ঘরে;
শোকগ্রস্ত কঙ্কাল জীবনে যিনি অবিরাম যোগান দিচ্ছেন
প্রেম শক্তি মেদ মাংস রক্ত আর সাহসের মাটি
অন্ধকারে তার প্রাণে কে জ্বালায় অফুরন্ত আলো?
...হে উড়ন্ত স্বপ্ন পাখি!
তুমি আজ নিচে নেমে অই মৃত নদীকে জাগাও;
আমাদের অভিশপ্ত নগরীর অই মহাকলঙ্কের দাগ মুছতে মুছতে
শিশুপার্ক ছেড়ে শিশুরা এসেছে আজ বহুদিন ধরে
ইট-পাথরের নিচে চাপা আমাদের গৌরবের মাঠে,
নতুন শপথে তারা উজ্জীবিত হয়Ñ পতাকার রঙে রঙে
পিতাকে উদ্ধার করে তুলে রাখে হৃদয়ের শহীদ মিনারে
হালভাঙা তরণীকে বৈঠা মেরে নিয়ে যাচ্ছে স্বপ্নের মঞ্জিলে
জয়ের পতাকা
লাখ লাখ শহীদের রক্তমাখা আমাদের এই পুণ্য মাটি,
কখনও মায়ের মতো এই মাটি টেনে আনে স্নেহের নীলিমা,
কখনও আত্মার মতো এই মাটি রক্তে মিশে থাকে:
প্রিয় সন্তানের জন্মদিনে কী মধুর মায়ের মমতা
মাটি থেকে ব্যাপ্ত হয়ে ছুঁয়ে গেছে সমস্ত আকাশ।
জয় তো সন্তান নন শুধু এক বাঙালী মায়ের
মুক্তির প্রযুক্তি যুদ্ধে তিনি এক রতœপুত্র সিপাহসালারÑ
যদিও বা কর্মপ্রেমী তবু এই কর্মহীন নিয়ত বেকার
জাতিকে কর্মের মন্ত্রে জাগালেন যিনি তার মেধার কিরণে :
মায়ের স্নেহের মতো আমাদের প্রতিঘরে ওড়ে যেন আজ
বাঙালীর অবিনাশী জনকের প্রিয় চোখ জয়ের পতাকা।
আত্মজার জন্য
(আরহাম মাসুদুল হক ভাইকে)
জাহিদ হায়দার
তোমাকে বুঝতে হবে,
উদীয়মান প্রেমের বহুরূপী রশ্মিসম্পাত
আর ওই আলোক লঙ্ঘনের সৃজনকৌশল।
সৃজনে কখন নামে জীবনের চিত্ত মম,
আর কৌশলে কখন হবে উল্টো পাশা খেলা।
নিয়মের অক্ষর দিয়ে
কখন প্রশ্ন করে মন্ত্র পড়া সমাজ।
অনেক পুতুলনাচে, কোথা থেকে আসছে সুতোর টান
না জেনে, তুমিও হতে পারো এক পণ্য মানুষ।
তোমাকে জানতে হবে,
কতটুকু গেলে পরাজয় ভালো লাগে;
কোন সিঁড়ি থেকে ফিরে এলে
ফেরাকে উদয় বলে মনে হয়।
কারো হাত ধ’রে একসাথে
কিছুপথ যাওয়া মানেই
কিছুটা সহায়তা, হয়তো পূর্ণ হৃদয়তা নয়।
এবং নয়, ফেলে আসা পদচিহ্নগুলির ঘাটতিপূরণ।
তোমার মনে হতে পারে,
পড়শি যুবক এক বিরল ভোরবেলা, স্বপ্নের স্পর্শরূপ।
হয়তো সে খুব সহজ কথার ঋতুপর্ব উল্টো ক’রে
হাতের প্রার্থনা বসন্তের তৃষ্ণায় ধুয়ে
বোঝাবে তোমাকে, তুমি আমার সাথে চলো।’
মনে রেখ, তোমার আনন্দ হতে পারে ধর্ষিত আকাশ।
একটি পাখি ঠোঁটে খড়কুটো নিয়ে
একবার উঁচু ডালে,
একবার গাছের ভেতরে যাচ্ছে, আসছে।
বাসা বানাবার সত্য তাকে কোন শাখা দেবে?
পাখির শ্রমিকতা থেকে তুমি কী শিক্ষা নেবে?
তোমাকে জানতে হবে,
সব সীমারেখা নিঃশব্দে বোঝায়, লঙ্ঘনে বিজয় আছে;
সব সৃজনে তুমি কতটুকু নিজস্ব-অর্জন;
ঘন ঘন ঘড়ি দেখা মানুষগুলি কেন হারিয়েছে নদী।
হে কন্যা আমার,
চারদিকে উড়ছে বল্লম,
ঝড়ো হাওয়ায় দুলছে দু’একটি রজনীগন্ধা।
তুমি সংগতি খুঁজে নিও স্বাস্থ্যের স্বাক্ষরে,
আগামীকাল আঠারো বছর বয়স হবে তোমার।
১৬.০২.২০১৫
প্রত্যার্বতন
জাফরুল আহসান
মেধা ও মননে তুই ছিলি সেরা সরল যুবক
ভ্রষ্ট সময়ে তোকে নিয়ে গেল নষ্ট কুহক,
বিশ্বাসে তুই পান করে নিলি তরল গরল
দাহ্য নয় জানি, তবুও গরল জ্বাললো অনল।
জীবনের সুধা, গন্ধ-বৈচিত্র্য, রূপ-রস সবি
দিয়েছি তোকে; এঁকে নিবি তুই জীবনের ছবি
তোকে তো আমরা দেইনি কখনো এমন শিক্ষা
তবু বেছে নিলি! রক্ত-মৃত্যু-হত্যা দীক্ষা?
ঝলকানি দেয়া আগ্নেয়াস্ত্রের ভাষা তোর নয়,
চাপাতি, ভোজালি, থ্রি নট থ্রি ওরা তোর নয়,
ধর্মের নামে হত্যা ও খুন তাও তোর নয়,
তবুও মিথ্যে ভুলের বেসাতি ছেড়ে দিতে ভয়?
আদরের ধন পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য ভুলে
পঙ্কিল পথে! কেমনে ফেরাবো কোন সে মাশুলে,
বিপরীত স্রোতে গোলক ধাঁধায় পথেই হারাবে?
বৈরী সময়ে বুকের পাঁজরে রাখবো কী ভাবে?
সুহৃদ-স্বজন ফুল-পাখি-নদী সবকিছু ছেড়ে
কোথায় পালালি? জলে ভেজা চোখ তোকে খুঁজে ফেরে
ফেরাতে পারেনি মায়ের আকুতি ¯েœহ চুম্বন
তুই তো ফেরারি ছুঁড়ে ফেলে গেলি সব বন্ধন।
পিতৃঋণের কাছে, ফিরে আয় বাবা ফিরে আয় তুই
মা’র ¯েœহের আঁচল বিছানো পথে তোরে ছুঁই
ফিরে আয় বাছা সোনার দেশের সোনামণি তুই
ভুলের মাশুল দিতে হয় দেবো ফিরে আয় তুই।
সংবাদ বুলেটিন
অমূল্য সরকার অমল
সদ্য পাওয়া সংবাদ জেনে নিন
হে প্রিয় দেশবাসী;
লাশের মিছিলের ভিড়ে
সেবা সংঘের সেবায়েত, শিব মন্দিরের পুরোহিত,
সদর গির্জার প্রধান ধর্মযাজকের রক্তাক্ত দেহ
এই মাত্র শনাক্ত হয়েছে।
গুম হয়ে যাওয়া গার্মেন্স কর্মী সবিতা সেনের
কষ্টের বয়ান পঠিত হয়েছে মিছিলে মিছিলে।
হারিয়ে যাওয়া সুখ পাখিটা আবারও উড়বে আকাশে।
সদ্য পাওয়া সংবাদ জেনে নিন, হে প্রিয় দেশবাসী;
জেলেপাড়ার জ্ঞানমোহন রাজবংশীর বোবা মেয়েটার
লাশের কফিন খানাও শনাক্ত হয়েছে।
খুঁজে পাওয়া গেছে অশান্তির দুষ্ট চক্র,
সমুদ্রে জেগে ওঠা জমির মালিকানা,
নিখোঁজ মৎসজীবিদের মাথার করোটি।
শনাক্ত হয়েছে কবর থেকে চুরি হওয়া লাশের কংকাল;
স্তূপ-স্তূপ রক্তের দাগ
কেড়ে নেয়া মেঠোপথ।
আমি হলফ করে বলতে পারি
সবকিছু শুদ্ধ হবে একদিন, ফিরে আসবে হারানো সুখ।
ফিরে আসবে অনাগত কাল, নবজাতকের হাতছানি;
ফিরে পাবে মা-বোনের সম্ভ্রম-অভয়াশ্রম।
তা না হলে, অপমৃত্যু হবে পৃথিবীর, থেমে যাবে প্রকৃতির
প্রসব বেদনা;
ধ্বংস হবে বহতা নদী।
শরৎ সংবাদ
রহমান মুজিব
অপার আন্তরিক মাঠ শুয়ে আছে বুকে টেনে মজাখাল
দু’ধারের দুরত্ব বড়জোড় হৃদয়পোড়া এক টুকরো অঙ্গারের
ভাষা। তবুও মালিকানাবিহীন ভোরের স্বর্ণাভ আলোয় শ্রমবিক্রি
মানুষের মুখে চিকচিক করে উজ্জ্বল দিনের পাদটীকা। ঘাসে ঘাসে
পরিয়ে দেয় আশ্বিন জলবিন্দুর শরৎরাখি।
অবশেষে আমার সবটুকু তামাদি বিশ্বাস নিয়ে শিশিরমুক্তো নির্মাণ
করে জীবনের আলোকচিত্র। বিকল অন্তরাগুলো ঠিকঠাক আবারও
বেজে ওঠে, নতুন দিনের ঘ্রাণে আবারও প্রাণ মাটিমুখি হয়।
ধূসরিত
শামীম হোসেন
সরষে ফুলের মতো হলুদ হও সমস্ত বিষাদ...
আমার দিগন্তচোখ কতটা গভীরে গিয়েÑ
ভুলে যাবে ভূগোলের ভাঁজÑ সবুজে মোড়া
ধুলোর ভেতর লুকিয়ে রাখবে জগতের মায়া।
গোয়ালে গরু থাকে, গৃহে থাকে না সন্ন্যাসী
যতটা গভীর চাওÑ তত পাবে ধূসরিত পথ!
প্রত্যর্পণের দুঃখগুলো
হাসান কল্লোল
প্রত্যর্পণের দুঃখগুলো এখানে উদাস
রয়েছে ছড়ানো।
উঠানে জমেছে বিদায় বেলার বৃষ্টির দাগ!
মুঠোফোনে জমে আছে কতিপয়
কথোপকথন, কাঁদছে কেউ, কেউবা জেগে।
তোমার ভালবাসা আমার পেনড্রাইভে
রয়েছে জমে, স্মৃতি তুমি আর কতদূরে যাবে?
দেখো পলাতক আনন্দগুলো এসে
বাদাম খাচ্ছে যেন কাঠবিড়ালীর মতো
কয়েকটা শুকনো পাতাও তারা নিচ্ছে
পকেটে পুরে, পাতা কুড়ানোর স্মৃতি
টলমল আঙ্গুল এখনো চঞ্চল।
আমাদের পৃথিবীতে নীল জল ছিল টলমল
বর্ষার দুপুরে তাতে টুপ করে পড়তো অবাধ্য প্রেম
বৌÑকৈ মাছের মতো লাফিয়ে।
আজ কুড়িয়ে নেব সব জাল টেনে জীবন্ত ফসিল।
সবুজ ঘাসের মতো তাদের যারা পাথরের নিচে
চাপা পড়ে হয়ে গেছে শাদা।
সেই শ্বেত দুর্বা দিয়ে সাজাবো তোমার
বরন ডালাÑ দেখো শঙ্খধ্বনিতে
এখনি উঠছে নেচে চারপাশের অনিন্দ্য স্মৃতিরা।
তাদের পায়ের পাতায় লাল আলতার কারুকার্য
তারা তোমার বাড়ির পড়শিÑ
আমি তাদের দেখি প্রতিদিন
তুমি আর কতদূরে আছ শুকতারা!
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: