ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

জোবায়ের আলী জুয়েল

রাজা রাম মোহন রায় জীবনে ও কর্মে

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

রাজা রাম মোহন রায়  জীবনে ও কর্মে

আঠারো শতকের শেষ দিকে যখন ভারতবর্ষে মুঘল শাসনের অবসান হয়েছে। চারদিকে শুধু অন্ধকারের রাজত্ব। এই অন্ধকারের মধ্যেও কয়েকজন মহামানব ভারতবর্ষের হিন্দু- মুসলমানের তথা সব ধর্মের মানুষের মধ্যে সম্প্রতি সাধনের মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে গেছেন, তাদের মধ্যে রাজা রাম মোহন রায় ছিলেন অন্যতম। বাঙালীদের মধ্যে প্রথম আধুনিক দৃষ্টিসম্পন্ন চিন্তা নায়ক, সমাজ সংস্কারক ও কর্মবীর, সংস্কারক রাজা রাম মোহন রায় ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দের ২২মে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামে এক রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা রাম কান্ত ও মাতা ছিলেন তারিণী দেবী। গ্রাম্য পাঠশালাতেই শুরু হয় তার শৈশবকালের বিদ্যা শেখার পর্ব। এক মৌলভীর কাছে কিছুদিন ফারসী ভাষাও শিখেছিলেন তিনি। তার বাল্যকাল ও প্রথম যৌবনে তিনি হিন্দী ও তার মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও বেশ কয়েকটি প্রাচ্য ভাষা যেমন সংস্কৃতি, আরবী ও ফারসীতে উল্লেখযোগ্য ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। সেকালে পাটনা ছিল ইসলামী বিদ্যা শিক্ষার চর্চা কেন্দ্র। এই পাটনাতেই রাম মোহন ফারসী শেখার সঙ্গে সঙ্গে আরবী, ফারসী ভাষার মাধ্যমে বিখ্যাত গ্রীক দার্শনিক এ্যারিস্টটল আর ইউক্লিড সম্পর্কে জানতে পারেন। আরবের সুফী সাধনা আর যুক্তিবাদী মতাজিলাদের দার্শনিক চিন্তা-চেতনা তার মনে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। জ্ঞান-তৃষ্ণা তাকে পরিণত করে ব্যতিক্রমী একজন মানুষ হিসেবে। বাঙালীকে আধুনিকতার পথ দেখিয়েছিলেন তিনি। এ সময় ইউরোপের ইতিহাস-বিজ্ঞান-দর্শন প্রভৃতি বিষয়ে তিনি বহু গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন, চর্চা করেন ইংরেজী ভাষা। পাটনা থেকে ফিরে আসার পর রাম মোহন মূর্তি পূজার অসারতা প্রমাণ করে বই লিখতে চেষ্টা করেন। নানাভাবে মূর্তি পূজার বিরোধিতা করলেন। ফলে গোঁড়া ধর্ম বিশ্বাসী বাবা তাকে তার বাড়ি হতে বের হয়ে যেতে বললেন। নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি করে রাম মোহন গেলেন বারানসীতে। সেখানে অধ্যয়ন করলেন হিন্দু দর্শন শাস্ত্র। ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে পিতার মৃত্যুর পর রাম মোহন পাড়ি জমান মুর্শিদাবাদে। এই মুর্শিদাবাদ থাকার সময়ই তিনি ফারসী ভাষায় লেখেন ‘তুহফাৎ উল মুয়াহিদীন’ অর্থাৎ একশ্বরবাদীদের জন্য উপহার নামে একটি বই। এই বইটিতে তিনি দেখালেন যে সৃষ্টিকর্তা একজনই। বিভিন্ন স্থানে মানুষ এই সৃষ্টিকর্তাকে বিভিন্ন রূপে কল্পনা করে বলেই মানুষ নানা রূপের মূর্তি স্থাপন করে। আসল সৃষ্টি কর্তা এক এবং আকারহীন। সুতরাং গোাঁড়া হিন্দুরা তার প্রবল বিরোধিতা করতে শুরু করল। তবু কিছুতেই থামলেন না রাজা রাম মোহন তিনি সব ধর্মের সেরা বিষয়কে একত্রিত করে সৃষ্টি করলেন এক নতুন ধর্ম। রাম মোহনের সঙ্গে পরিচয় ঘটে উইলিয়াম ডিগবি নামে এক ইংরেজের সঙ্গে যিনি সদ্য নিযুক্ত সিভিলিয়ান ছিলেন। ডিগবি সাহেবের সঙ্গে রাম মোহনের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে এবং ১৮০৫-১৮১৪ খ্রিস্টাব্দের সময়কালে রাম মোহন ও ডিগবি সাহেব ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলেন। মূলত ডিগবি সাহেবের ব্যক্তিগত দেওয়ানে কাজে ব্যাপৃত ছিলেন রাম মোহন। পরবর্তীতে ডিগবির প্রচেষ্টায় রংপুরে তিনি সরকারী দেওয়ান নিযুক্ত হন এবং ১৮০৯-১৮১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রংপুরে অবস্থান করেন। পরবর্তীতে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে স্থায়ীভাবে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। তখন থেকেই তিনি ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন এবং বেদ ও উপনিষদ বাংলায় অনুবাদ করে প্রচার শুরু করেন। তিনি ছিলেন একশ্বরবাদে বিশ্বাসী এবং ব্রাহ্মধর্মের প্রবর্তক। হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামি ও অজ্ঞানতা দূর করার জন্য তিনি ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ‘আত্মীয় সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে তিনি তৎকালীন হিন্দু সমাজের কুসংস্কার কৌলীণ্য প্রথা, কন্যা বিক্রয়, জাতিভেদ প্রভৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করেন। সেকালে পিতা ও স্বামীর সম্পত্তিতে মেয়েদের কোন অধিকার ছিল না। রাম মোহনই প্রথম সংগ্রাম শুরু করেন এই অধিকার আদায়ের জন্য। রাম মোহন হিন্দু সংস্কারের এক মহান যুগের সূত্রপাত করেন। তিনি ‘সতীদাহ’-এর মতো কু প্রথার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে সক্ষম হন। স্বামীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীকেও পুড়িয়ে দেয়ার মতো নির্মম এবং বর্বর কাজ যে কোন ধর্মের বিধান হতে পারে না সে ব্যাপারে তিনি প্রচার চালাতে শুরু করেন। তার আপ্রাণ চেষ্টাতেই সেকালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট রাম মোহন রায়ের কথা মেনে ‘সতীদাহ প্রথা’ নিষিদ্ধ করার ঘোষণা অনুমোদন করেন যা ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে বিশেষ আইনের মাধ্যমে রদ করতে সরকারকে প্রভাবিত করে। রাম মোহন প্রতিমা পূজাকে দৃঢ়ভাবে বর্জন করেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন যে হিন্দু ধর্ম এক সার্বজনীন ঈশ্বরের পূজা করতে নির্দেশ দেয়। রাম মোহনের চিন্তা-চেতনা ছিল পরিচ্ছন্ন এবং স্বচ্ছ। সঠিক বিষয় প্রকাশের জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা গ্রহণে তিনি ছিলেন অকুণ্ঠ। সংবাদপত্রের সঙ্গে সংযুক্তি তার অন্যতম উদাহরণ। ভারতবর্ষে সংবাদপত্র প্রকাশ এক যুগান্তকারী ঘটনা। ক্যালকাটা টাইমস (১৮১৪ খ্রি.), গবর্মেন্ট গেজেট (১৮১৫ খ্রি.), ফ্রেন্ডস অব ইন্ডিয়া (১৮১৮ খ্রি.), দিগ দর্শন (১৮১৮ খ্রি.) প্রভৃতি সংবাদপত্র সাময়িক পত্র প্রকাশ জ্ঞান চর্চার জগতে বিস্ময়কর সংযোজন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মে ‘বেঙ্গল গেজেট’ প্রকাশ করেন হরচন্দ্র রায় রাম মোহনের উৎসাহ অনুপ্রেরণায়। সেকালে ভারতবর্ষে যে ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল তা পরিবর্তন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন রাম মোহন। ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে যখন হিন্দু কলেজ গড়ে উঠতে শুরু করল তখন তিনি ডেভিড হেয়ারকে সহযোগিতা করতে শুরু করেন। ডেভিড হেয়ারের কঠোর পরিশ্রমে এই কলেজ গড়ে উঠেছিল। কিন্তু সেকালের হিন্দু সমাজপতিরা রাম মোহনের বিরোধিতা করায় রাম মোহন আড়াল থেকে এই কলেজের কাজে সহযোগিতা করতে থাকেন। কারণ এই কলেজের পাঠ্যসূচী ছিল প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার চেয়ে আলাদা রীতির। অবশ্য এর আগে ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন যার সম্পূর্ণ ব্যয় ভার বহন করতেন তিনি নিজে। রাম মোহনই প্রথম বাঙালী যিনি সংস্কৃতের কাছ থেকে বাংলা ভাষাকে অনেকটা সরিয়ে এনে সুশৃঙ্খল করে তুলেছিলেন। রাজা রাম মোহন রায় ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে সংবাদ কৌমুদী নামে বাংলায় সংবাদ পত্র ও ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে মিরাত-উল-আখবার নামে ফারসী সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। তিনিই সর্ব প্রথম বাঙালীদের জন্য বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনা করেন। এই ব্যাকরণের নাম ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ।’ এ ছাড়াও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সেকালের সাময়িক পত্রগুলোয় রাম মোহনের উপস্থিতি ছিল। এসব পত্রিকার মাধ্যমে উদার নীতির প্রচার করতেন রাম মোহন। সার্বজনীন মানব ধর্মে বিশ্বাস করতেন তিনি। ধর্মমত প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি বাংলায় ও ইংরেজীতে বেশ কয়েকটি সাময়িক পত্র সম্পাদনা করেছিলেন। উপমহাদেশে জাতীয় ও রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষেও রাম মোহন রায়ের প্রভূত অবদান ছিল। তিনি ছিলেন একাধারে বহু ভাষাবিদ প-িত। বাংলা ভাষা ছাড়াও তিনি সংস্কৃতি, আরবী, ফারসী, হিব্রু, গ্রীক, ল্যাটিন ও ইরেজী ভাষা জানতেন। তিনি ছিলেন আধুনিক মন ও মননের অধিকারী। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে খেতাবসর্বস্ব মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর (১৮০৬-১৮৩৭ খ্রি.) রাম মোহন রায়কে রাজা উপাধিতে ভূষিত করেন এবং তার পক্ষে ব্রিটিশ রাজ ও পার্লামেন্টে ওকালতি করার জন্য ইংল্যান্ডে পাঠান। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ নবেম্বর রাম মোহন ‘বার এ্যালবিয়ান’ নামক জাহাজে চড়ে ইংল্যান্ডে যাত্রা করেন। পরের বছর ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ৮ এপ্রিল তিনি ইংল্যান্ডে গিয়ে পৌঁছান। ইংল্যান্ডে তার সঙ্গে দেখা ও আলোচনা করার জন্য সেখানকার বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ ছুটে আসেন। ইংরেজ সমাজের শীর্ষস্তরে রাম মোহনকে সম্মান জানানো হয় এবং ব্রিটিশ সমাজের নেতৃবৃন্দ কর্তৃক তিনি বিপুলভাবে সংবর্ধিত হন। ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ফ্রান্সও সফর করেন। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন লন্ডনে। বন্ধুরা তাকে হাওয়া বদলের জন্য বিস্টলে যেতে বলেন। সেখানেই ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭ সেপ্টেম্বর ভারত মাতার সুসন্তান রাজা রাম মোহন রায় ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল শহরে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। আজ তার ১৮৩তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে জানাই হৃদয়ের অফুরন্ত শুভেচ্ছা ও ভালবাসা। দেশের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিশেষ করে ‘সতীদাহ প্রথার’ বিলোপ সাধনে তার অক্ষয় অবদান উল্লেখযোগ্য। সুতরাং যে কোন গোঁড়ামি আর কুসংস্কারের অন্ধত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী প্রতিটি বাঙালীর জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন রাজা রাম মোহন রায়।
×