ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মৃতের সংখ্যা ২৪, অভিযান শেষ

সন্ধ্যার পাড়ে স্বজনহারা মানুষের আহাজারি, লঞ্চ উদ্ধার

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

সন্ধ্যার পাড়ে স্বজনহারা মানুষের আহাজারি, লঞ্চ উদ্ধার

স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল ॥ সন্ধ্যা নদীতে বুধবার ডুবে যাওয়ার প্রায় সাড়ে ২০ ঘণ্টা পর বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে যাত্রীবাহী এমএল ঐশি-২ লঞ্চটি উদ্ধার করা হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএর জাহাজ ‘নির্ভীক’ নদীর ৬০ ফুট নিচ থেকে লঞ্চটি তুলে আনার পর সকাল দশটার দিকে উদ্ধার অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করেছে জেলা প্রশাসন। উদ্ধার অভিযানের সময় বৃহস্পতিবার সকালেও সন্ধ্যা নদীর পাড়ে ছুটে আসেন নিখোঁজ যাত্রীদের স্বজনরা। তারা মরদেহ উদ্ধারের পর কিংবা আপনজনকে খুঁজে না পেয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এ সময় স্বজনদের আর্তনাদে সন্ধ্যা নদীর তীরে হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। জেলার অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসেন জানান, শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ২৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করে স্বজনদের বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের কাছে নিখোঁজের কোন খবর নেই। তবে কারও নিখোঁজের খবর পাওয়া গেলে সে অনুযায়ী উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে হবে। অথচ পুলিশ জানিয়েছে, তাদের কাছে এখনও ২০ থেকে ২৫ জন নিখোঁজের খবর রয়েছে। বিআইডব্লিউটিএর ডুবুরি মোঃ ইমাম হোসেন জানান, উদ্ধারের পর লঞ্চের মধ্য থেকে জিরাকাঠি গ্রামের রিয়াদ (৫), সাতবাড়িয়া গ্রামের মাইশা (৪), রাব্বি (৬), সৈয়দকাঠি গ্রামের সাফওয়ান (৩) ও সাতবাড়িয়া গ্রামের আলমগীর হোসেনের কন্যা মাফিয়া (৪) নামের ৫ শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, দুর্ঘটনার পর থেকেই ডুবুরিরা প্রায় আড়াই ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে দুর্ঘটনস্থল থেকে প্রায় ১০০ ফুট দূরে সন্ধ্যা নদীর প্রায় ৬০ ফুট নিচে এমএল ঐশি-২ লঞ্চের সন্ধান পান। পরবর্তীতে অবস্থান নিশ্চিত করে লঞ্চটি মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। তবে নদীতে তীব্র স্রোত থাকায় উদ্ধার অভিযান বার বার ব্যাহত হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। সূত্র মতে, অর্ধশতাধিক যাত্রী নিয়ে বানারীপাড়া থেকে উজিরপুরের হাবিবপুরগামী একতলা লঞ্চ ঐশি-২ বুধবার দুপুর বারোটার দিকে ভাঙ্গনের কবলে পড়ে সন্ধ্যা নদীর মসজিদবাড়ির দাসেরহাট এলাকায় ডুবে যায়। ওইদিন রাতে খুলনা থেকে লে. মোঃ আরিফ হোসেনের নেতৃত্বে আসা নৌবাহিনীর ১৪ সদস্যের উদ্ধারকারী দল উদ্ধার কাজে অংশগ্রহণ করেন। বরিশাল থেকে বিআইডব্লিউটিএর উদ্ধারকারী জাহাজ নির্ভীক বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে চারটার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কাজে অংশ নিয়ে সকাল সাড়ে আটটার দিকে লঞ্চটি নদী থেকে ওপরে তুলে আনে। উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া জেলা প্রশাসক ড. গাজী মোঃ সাইফুজ্জামান বলেন, ডুবে যাওয়া নৌযানটির কাঠামো অনেকটা ট্রলারের মতো হওয়ায় ডুবুরিরা ভেতরে প্রবেশ করতে পারেননি। দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে উদ্ধার অভিযানে যাওয়া বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বড় ট্রলারকে (ইঞ্জিনচালিত নৌকা) বর্ধিত করে যাত্রীবাহী লঞ্চে রূপান্তর করা হয়েছিল। সার্ভে সনদ ও ফিটনেসবিহীন লঞ্চটি অবৈধভাবে যাত্রী পরিবহন করত। দুর্ঘটনার সময় নৌযানটি ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ যাত্রী পরিবহন করছিল। যাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে ॥ দুর্ঘটনার পর দুপুর একটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ১৩ জনের এবং রাতে একজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। বৃহস্পতিবার সকালে ডুবে যাওয়া লঞ্চের মধ্য থেকে চার শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। সব মিলিয়ে বৃহস্পতিবার বিকেল তিনটা পর্যন্ত ছয় নারী, সাত শিশু ও একজন মুক্তিযোদ্ধাসহ পাঁচ পুরুষ যাত্রীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে তারা হলেন বানারীপাড়ার মসজিদবাড়ি স্কুল এ্যান্ড কলেজের ৭ম শ্রেণীর ছাত্র সাগর মীর (১৩), সৈয়দকাঠি গ্রামের সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক (৬৮), একই গ্রামের মিলন ঘরামি (৩৫) তার পুত্র সাফওয়ান (৩) ও রাবেয়া বেগম (৪৫), মসজিদবাড়ি গ্রামের মোজাম্মেল ওরফে মুজা মোল্লা (৬৫), জিরাকাঠি গ্রামের রেহানা বেগম (৩৫), কোহিনুর বেগম (৬৫) ও রিয়াদ (৫), সাতবাড়িয়া গ্রামের ফিরোজা বেগম (৫৫), মাইশা (৪) ও রাব্বি (৬), উজিরপুরের হারতা গ্রামের মাছ ব্যবসায়ী সুখদেব মল্লিক (৪৫), মশাং গ্রামের কবির হোসেনের পুত্র রাহাত (১০) ও মেয়ে শান্তা আক্তার (৮), নয়াকান্দি গ্রামের জয়নাল হাওলাদার (৫৫), স্বরূপকাঠির আলকিরহাট গ্রামের হিরা বেগম (২৫) ও রাহিমা বেগম (৬০)। পুলিশের কন্ট্রোলরুম ॥ দুর্ঘটনার পর থেকেই ঘটনাস্থলে খোলা পুলিশের কন্ট্রোলরুমের তালিকানুযায়ী এখনও চার নারী, চার শিশু ও দুই পুরুষ যাত্রী নিখোঁজ রয়েছে। তারা হলেন সৈয়দকাঠি গ্রামের নিহত মিলন ঘরামির স্ত্রী ও নিহত সাফওয়ানের মা খুুকুমনি (২৫), সাতবাড়িয়া গ্রামের আব্দুল মজিদ হাওলাদার (৬৫), উজিরপুরের খলিল হাওলাদারের স্ত্রী হামিদা বেগম (৪০) ও তার পুত্র নাফফি (৯), হিদেলকাঠি গ্রামের মনিশঙ্করের স্ত্রী কল্পনা রানী (২৫), উজিরপুরের সিদ্দিকুর রহমানের পুত্র রাফি (৭), বানারীপাড়ার আলমগীর হোসেনের শিশু কন্যা মারিয়া (৩), বরগুনায় কর্মরত ফায়ার সার্ভিস কর্মী সাতবাড়িয়া গ্রামের মালেক সরদারের পুত্র রুহুল আমিন (৩০), মনোয়ারা বেগম (৪৫), পূর্ব কেশবকাঠি গ্রামের দিদার (৭)। তবে দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের দাবি এখনও ২০/২৫ জন যাত্রী নিখোঁজ রয়েছে। ৯ সদস্যের তদন্ত কমিটি ॥ ঐশি ডুবির ঘটনায় কারণ জানতে ৯ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন বরিশালের জেলা প্রশাসক ড. গাজী মোঃ সাইফুজ্জামান। তিনি জানান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসেনকে প্রধান করে এ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির নেতৃবৃন্দকে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে দেয়া হবে। নিখোঁজ যুবকের লাশ উদ্ধার ॥ এদিকে সন্ধ্যা নদীতে ঢাকাগামী লঞ্চের ধাক্কায় নৌকা ডুবিতে নিখোঁজের একদিন পর বেল্লাল বেপারি (২৭) নামের এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে তিনটার দিকে সন্ধ্যা নদীর শাখা ব্রাহ্মণকাঠী খালের মুখ থেকে বেল্লালের লাশ উদ্ধার করা হয়। বেল্লাল বানারীপাড়া উপজেলার খেজুরবাড়ি গ্রামের আবু বক্কর বেপারির পুত্র। বুধবার বিকেলে ঢাকাগামী এমভি মর্নিংসান লঞ্চের ধাক্কায় নৌকায় থাকা ৫ যাত্রী আহত ২ যাত্রী নিখোঁজ হন।
×