ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আমদানির অনুমতি শুধুমাত্র সেনা গোয়েন্দা সংস্থাকে দেয়া হয়েছে

এবার আলোচনায় ড্রোন- জঙ্গী হামলার হাতিয়ার হতে পারে

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

এবার আলোচনায় ড্রোন- জঙ্গী হামলার হাতিয়ার হতে পারে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ দেশে নতুন আলোচনার বিষয় ড্রোন। সম্প্রতি বিমানবন্দরে বেশ কিছু আমদানি নিষিদ্ধ ড্রোন আটকের পরই বিষয়টি আলোচনায় আসে। নতুন এই প্রযুক্তি সন্ত্রাসী কর্মকা-ে ব্যবহৃত হয় কিনা এ নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এমন একটি প্রেক্ষাপটে সম্ভাব্য হামলা ঠেকাতে ড্রোন ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা। গত কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন বিমানবন্দরে আমদানি নিষিদ্ধ ড্রোন ধরা পড়ছে। এসব ড্রোন নাশকতার উদ্দেশে আনা হয়েছে বলে তদন্তে অনেকটাই নিশ্চিত গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। অদূর ভবিষ্যতে জঙ্গীরা দেশে ড্রোন হামলা করতে পারে, এমন আশঙ্কা মাথায় রেখেই ড্রোন আমদানি করার অনুমতি পেয়েছে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা। পাশাপাশি ড্রোন বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজেও ব্যবহৃত হবে। ড্রোন জঙ্গী আস্তানা শনাক্ত ও অত্যন্ত দুর্গম স্থানের গোপনীয় তথ্য এবং ছবি সংগ্রহের কাজ করবে। সার্বিক পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণ এবং সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাকে আরও শক্তিশালী করতেই ড্রোন ব্যবহারের অনুমতি দেয় প্রতিরক্ষা বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সময় নানা আকারের ড্রোন ধরা পড়েছে। অনেক ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। আবার অনেক ড্রোন ধরা পড়ার পর তা গোপনেই তদন্ত হয়েছে। অধিকাংশ ড্রোন ধরা পড়েছে বিমানবন্দরে। ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি ড্রোন ধরা পড়ে। সর্বশেষ গত কয়েক দিনে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্পাই রোবট, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের কাজে ব্যবহৃত নানা সরঞ্জাম জব্দ হয়। বিভিন্ন সময় জব্দ এসব ড্রোন আমদানিকারকদের বিষয়ে অনুসন্ধান হয়। অনুসন্ধানে ইলেক্ট্রনিক সামগ্রীর আড়ালে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে ড্রোনগুলো আমদানি করা হয়েছিল বলে তদন্তে বেরিয়ে আসে। পরবর্তীতে গোয়েন্দা অনুসন্ধানে জব্দ হওয়া ড্রোনগুলো দেশে বড় ধরনের নাশকতা চালাতে এবং দেশের বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিকে হত্যার কাজে জঙ্গীদের তরফ থেকে আমদানি করা হয়েছিল বলে তথ্য বেরিয়ে আসে। এসব ড্রোনের ব্যবহার করার মতো প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন জঙ্গী বর্তমানে বাংলাদেশে রয়েছে। বিশেষ করে বিদেশ থেকে প্রশিক্ষিত অনেক জঙ্গী বর্তমানে দেশেই আত্মগোপ। তারা খুবই উচ্চ প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন। মূলত তারাই দেশে দীর্ঘদিন ধরে ড্রোন দিয়ে বড় ধরনের নাশকতার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সূত্র বলছে, ২০১৪ সালে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে এমন দুজন একটি ড্রোনসহ গ্রেফতার হয়। গ্রেফতাররা নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবির সদস্য হলেও তাদের সঙ্গে দেশী সকল জঙ্গী সংগঠনের যোগাযোগ ছিল। শুধু তাই নয়, তাদের সঙ্গে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বেশকিছু আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনের যোগাযোগ থাকারও প্রমাণ মেলে। গ্রেফতাররা বিদেশে প্রশিক্ষিত। আর জব্দ হওয়া ড্রোন সম্পর্কে সে সময় পুলিশের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, ড্রোনটি ৩৫ কেজি ওজনের বিস্ফোরক নিয়ে উড়তে সক্ষম। পরীক্ষামূলকভাবে ড্রোনটির কার্যক্রম চালানোর পরিকল্পনা করছিল গ্রেফতারকৃতরা। গ্রেফতারদের টার্গেট ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করা কঠিন হওয়ায় তারা ড্রোন দিয়ে হামলার চক্রান্ত করছিল। পরিকল্পনা মোতাবেক ড্রোনটি মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে ৩৫ কেজি ওজনের বিস্ফোরক ভর্তি করে ওড়ানোর পরিকল্পনা ছিল। আর দূর নিয়ন্ত্রিত এই ড্রোনটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসভবন গণভবনে পৌঁছানোর পর তা রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটনার চক্রান্ত ছিল। ড্রোনটি অন্তত আধাকিলোমিটার উঁচু দিয়ে এক কিলোমিটার পর্যন্ত উড়তে সক্ষম ছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, হালের জঙ্গীরা উচ্চশিক্ষিত এবং প্রযুক্তিবিদ্যায় খুবই পারদর্শী। তারাই প্রথম ড্রোন কালচার শুরু করে। জব্দ ড্রোন সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে ড্রোনগুলো জঙ্গীদের তৈরি ও আমদানি করা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। দেশে জঙ্গীদের ড্রোন হামলার আশঙ্কাকে মাথায় রেখেই সরকার এমন উদ্যোগ নিয়েছে। যদিও এখনও জঙ্গীদের ড্রোন হামলার মতো সক্ষমতা নেই বলে সূত্রটি দাবি করেছে। দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে, সংসদীয় কমিটিতে ড্রোন আমদানির অনুমতি পেলেও কি ধরনের ড্রোন আমদানি করা হবে, কবে নাগাদ তার কার্যক্রম শুরু হবে, আমদানিকৃত ড্রোনের আকার কেমন হবে, সেসব ড্রোনে কি ধরনের প্রযুক্তি থাকবে, এ খাতে কত অর্থ বরাদ্দ হবে সেসব বিষয় এখনও চূড়ান্ত হয়নি। আনুষঙ্গিক কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর প্রস্তাবটি একনেকের বৈঠকে উঠবে। পদাধিকারবলে একনেকের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একনেকের বৈঠকে প্রকল্পটি পাস হওয়ার পরেই শুরু হবে ড্রোন আমদানিসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম। সূত্র বলছে, জঙ্গীদের ড্রোন কালচারের সূত্র ধরেই ড্রোন আমদানির অনুমতি পায় সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই। গত ২১ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদ ভবনে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ‘ডিজিএফআইয়ের আধুনিকায়নের লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা’ শিরোনামে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে নিজেদের সরঞ্জামের পাশাপাশি ড্রোন যোগ করার অনুমতি পায় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই। গোয়েন্দা নজরদারি কার্যক্রম শক্তিশালী করতে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ভিভিআইপিদের নিরাপত্তার জন্য এ্যান্টি ড্রোন সিস্টেম সংযোজনের পরিকল্পনাও নিয়েছে সামরিক বাহিনীর সংস্থাটি। জঙ্গী অর্থায়ন রোধে ডিজিএফআই সব অনলাইন আর্থিক লেনদেন পর্যবেক্ষণের সক্ষমতা অর্জনের পরিকল্পনাও নিয়েছে। সাতক্ষীরা, দিনাজপুর, নোয়াখালী, নারায়ণগঞ্জ, পটুয়াখালী, পাবনা, কুষ্টিয়া ও ফরিদপুরে ডিজিএফআইর শাখা খোলা হচ্ছে। প্রতিকূল পরিবেশে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও সার্ভিলেন্স কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সার্ভিলেন্স ড্রোন এবং সকল ভিভিআইপির নিরাপত্তা নিশ্চিতের নিমিত্তে এ্যান্টি ড্রোন সিস্টেম সংযোজনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। চালকবিহীন উড়ন্ত যান বা ড্রোনের ব্যবহার বিশ্বে দিন দিন বেড়েই চলেছে। দূর নিয়ন্ত্রিত ড্রোনে স্থাপিত ক্যামেরার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা খুবই সহজ। চীনে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণেও ড্রোন ব্যবহৃত হচ্ছে। সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স এবং সাইবার সিকিউরিটিতে সক্ষমতা অর্জনের জন্য চারটি পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে গোয়েন্দা সংস্থাটি। এগুলো হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক ওয়্যারফেয়ার সংক্রান্ত সক্ষমতা, ট্রান্সফ্রন্টিয়ার ইন্টেলিজেন্স পরিচালনার সক্ষমতা, স্যাটেলাইট মনিটরিং সক্ষমতা এবং সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে প্রয়োজনীয় সক্ষমতা। কমিটির তরফ থেকে দেশের ভেতরে ও সীমান্তে নজরদারি জোরদার করে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ নির্মূলে নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে আরও বেশি তৎপর হওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। সুবিদ আলী ভূইয়ার সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিটির সদস্য ইলিয়াস আলী মোল্লা, মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী, হোসনে আরা বেগম প্রমুখ অংশ নেন। এছাড়া সশস্ত্র বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।
×