ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বের সমর্থন চাই ॥ সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ নির্মূলে বাংলাদেশের মানুষ এককাট্টা

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

বিশ্বের সমর্থন চাই ॥ সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ নির্মূলে বাংলাদেশের মানুষ এককাট্টা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ নির্মূলে বিশ্ববাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলাদেশের মানুষ একাট্টা জানিয়ে তাতে বিশ্ববাসীর সমর্থন চান। প্রধানমন্ত্রী বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় ভোরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭১তম অধিবেশনে বাংলায় দেয়া ভাষণে সন্ত্রাসী এবং উগ্রবাদীদের অর্থ ও অস্ত্রশস্ত্রের যোগান বন্ধ, তাদের প্রতি নৈতিক ও বৈষয়িক সমর্থন না দেয়ার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়কে আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী মানবতার স্বার্থে বিশ্ব থেকে সংঘাত দূর করে শান্তির পথে এগিয়ে যেতে অভিন্ন অবস্থানে উপনীত হওয়ার জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আসুন, জাতিসংঘকে টেকসই ও প্রাসঙ্গিক একটি সংস্থা তৈরিতে আমরা নতুন করে শপথ গ্রহণ করি। খবর বাসস ও বিডিনিউজের। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে সাম্প্রতিক গুলশান হামলার বিষয়টি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “এই ভয়ঙ্কর ঘটনা বাংলাদেশের জনগণের মনে এক গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে আমরা এই নতুন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি।” দেশী জঙ্গীদের ওই হামলার পর জনগণকে সচেতন করতে সরকারের গৃহীত কর্মসূচী এবং তাতে সাড়া পেয়ে তিনি আশাবাদী, বাংলাদেশের মাটি থেকে সন্ত্রাসীরা সমূলে উৎখাত হবে। আমি সন্ত্রাসী এবং উগ্রবাদীদের অর্থ ও অস্ত্রশস্ত্রের যোগান বন্ধ এবং তাদের প্রতি নৈতিক এবং বৈষয়িক সমর্থন না দেয়ার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়কে আহ্বান জানাচ্ছি, বলেন শেখ হাসিনা। জাতিসংঘের ৭০তম সাধারণ অধিবেশনে ভাষণে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস চরমপন্থার কথা বলেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। এবারের ভাষণে তা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, চ্যালেঞ্জগুলো এখন কোন নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ না থেকে বিশ্বের সবস্থানেই ছড়িয়ে পড়ছে। কোন দেশই আপাতদৃষ্টিতে নিরাপদ নয়, কোন ব্যক্তিই সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যবস্তুর বাইরে নয়। ‘আমেরিকা থেকে ইউরোপ, আফ্রিকা থেকে এশিয়ায় অগুনতি নিরীহ মানুষ সন্ত্রাসবাদের শিকার হচ্ছে।’ সন্ত্রাসীদের সমূলে উৎখাতের সঙ্কল্পে বিশ্ববাসীর ঐক্যবদ্ধ থাকার উওপর জোর দেন শেখ হাসিনা। সন্ত্রাস ও সহিংস জঙ্গীবাদের মূল কারণগুলো আমাদের চিহ্নিত করতে হবে। একই সঙ্গে এদের পরামর্শদাতা, মূল পরিকল্পনাকারী, মদদদাতা, পৃষ্ঠপোষক, অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহকারী এবং প্রশিক্ষকদের খুঁজে বের করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এক যুগ আগে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হওয়া শেখ হাসিনা সন্ত্রাস ও সহিংস জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে তার সরকারের ‘জিরো টলারেন্স নীতি’র বিষয়টি বিশ্বনেতাদের কাছে আবারও তুলে ধরেন। আমাদের দেশে যেসব সন্ত্রাসী গ্রুপের উদ্ভব হয়েছে, তাদের নিষ্ক্রিয় করা, তাদের নিয়মিত অর্থ সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা এবং বাংলাদেশের ভূখ- থেকে আঞ্চলিক সন্ত্রাসীদের কার্যক্রম নির্মূল করার ক্ষেত্রে আমাদের সরকার সফল হয়েছে। সংঘাত বন্ধ করে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় সব দেশকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ স্মরণ করেন। তিনি বলেন, এখনও আমাদের এই বিশ্ব উত্তেজনা এবং ভীতিকর পরিস্থিতি থেকে মুক্ত নয়। বেশ কিছু স্থানে সহিংস-সংঘাতের উন্মত্ততা অব্যাহত। অকারণে অগণিত মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। এই প্রসঙ্গে আবেগঘন কণ্ঠে গত বছর সিরিয়ার শিশু আইলান কুর্দির সাগরে ডুবে মারা যাওয়া এবং সম্প্রতি আরেক শিশু ওমরানের আহত হওয়ার কথা বলেন শেখ হাসিনা। “কী অপরাধ ছিল সাগরে ডুবে যাওয়া সিরিয়ার ৩ বছর বয়সী নিষ্পাপ শিশু আইলান কুর্দির? কী দোষ করেছিল ৫ বছরের শিশু ওমরান, যে আলেপ্পো শহরে নিজ বাড়িতে বসে বিমান হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে? একজন মা হিসেবে আমার পক্ষে এ সকল নিষ্ঠুরতা সহ্য করা কঠিন। বিশ্ব বিবেককে কি এসব ঘটনা নাড়া দেবে না?” দুদিন আগে জাতিসংঘে অভিবাসী ও শরণার্থী বিষয়ক সম্মেলনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমি আশা করি, এই সম্মেলনের ফল বর্তমান সময়ে অভিবাসনের ধারণা এবং বাস্তবতাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে সাহায্য করবে। শান্তির পক্ষে বাংলাদেশের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঢাকায় ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কেন্দ্র’ স্থাপনের সিদ্ধান্ত সহিংসতার কবল থেকে বেরিয়ে আসা দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ করে দেবে। মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়া পুনরায় চালু ও ভ্রাতৃপ্রতিম ফিলিস্তিনীদের প্রতি বৈরিতা নিরসনে সাম্প্রতিক প্রচেষ্টাগুলোকে সঠিক দিকে পরিচালিত করার ওপর জোর দেন তিনি। নির্বিচারে হত্যার ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা ও বিচার নিশ্চিত করতে জাতীয় বিচারিক প্রক্রিয়ার ভূমিকাকে গুরুত্ব দেয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের চলমান বিচারের কথাও বলেন শেখ হাসিনা। “১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য স্থানীয় অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার মাধ্যমে আমরা বিগত কয়েক দশকের বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি।” বিশ্ব এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে মন্তব্য করে এ থেকে উত্তরণের আশাবাদও ঝরে বাংলাদেশের সরকার প্রধানের কণ্ঠে। অনেক সৃজনশীল এবং প্রায়োগিক সমাধান এখন আমাদের নাগালের মধ্যে। প্রযুক্তি, নব্য চিন্তাধারা এবং বৈশ্বিক নাগরিকদের বিস্ময়কর ক্ষমতা আমাদের একটি ‘নতুন সাহসী বিশ্ব’ সম্পর্কে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করছে। ‘পরিবর্তনশীল প্রযুক্তি সবার জন্য চাই’ ॥ গত বছর গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা প্রাপ্তি নিশ্চিতের ওপর জোর দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ২০১৫ সালে আমরা একটি উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন এজেন্ডা এসডিজি গ্রহণ করেছি। এই এজেন্ডার রাজনৈতিক অঙ্গীকারকে পশ্চাৎপদ দেশগুলোর জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ এবং অর্থবহ অবলম্বনে রূপান্তরিত করা প্রয়োজন। এজন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। শেখ হাসিনা বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে সম্মত উন্নয়ন প্রতিশ্রুতিগুলোর সঠিক বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পক্ষে তাদের বর্তমান অবস্থান থেকে উত্তরণ সম্ভব। উদ্ভাবন এবং সম্ভাব্য সম্পদ সরবরাহ ব্যবস্থা জোরদার করতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য প্রস্তাবিত প্রযুক্তি ব্যাংককে দ্রুত কার্যকর করতে হবে। এসডিজির বেশিরভাগ বিষয় বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়ন নীতিমালায় সম্পৃক্ত করার কথা জানিয়ে নিজের দেশের অগ্রযাত্রার একটি বিবরণও বিশ্বনেতাদের সামনে তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার জন্য ‘ভিশন-২০২১’ এবং ‘ভিশন-২০৪১’ বাস্তবায়নে এগিয়ে চলছে তার সরকার। আমাদের লক্ষ্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, শক্তিশালী, ডিজিটাল এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। সেজন্য আমাদের সরকার উদ্ভাবনমূলক সরকারী সেবা বিতরণ, জনসাধারণের তথ্য লাভের অধিকার এবং রাষ্ট্র পরিচালনা ও সেবা খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। জনগণের দোরগোড়ায় ২০০ ধরনের সেবা পৌঁছে দিতে প্রায় ৮ হাজার ডিজিটাল কেন্দ্র স্থাপন, স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে ৬ হাজার ৪৩৮টি কমিউনিটি ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণীকক্ষ ও ডিজিটাল ল্যাব ব্যবহারের কথা বলেন তিনি। নিজস্ব অর্থায়নে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণের কাজ শুরু, একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা এবং রাজধানী ঢাকায় মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ শুরুর কথাও তিনি বলেন। গত ৭ বছরে বিদ্যুত উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় তিন গুণ এবং সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণও তিন গুণ বৃদ্ধি পাওয়ার কথা বলেন তিনি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের বেশি থাকার উল্লেখ করে শেখ হাসিনা সীমিত সম্পদের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে দারিদ্র্যের হার দ্রুত কমিয়ে আনার চিত্রও তুলে ধরেন। মন্দার মধ্যেও রফতানি আয় প্রায় তিন গুণ বাড়ানোর কথা বলেন শেখ হাসিনা। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সাড়ে ৩ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার কথাও আসে তার ভাষণে। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, সম্ভবত বাংলাদেশ বর্তমানে পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পীকার এবং সংসদ উপনেতা সকলেই নারী। আঞ্চলিক যোগাযোগ বাড়াতে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত এবং নেপাল (বিবিআইএন)-এর মধ্যে ‘মাল্টি-মোডাল ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্ক’ তৈরি এবং বিনিয়োগ বাড়াতে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কথাও বলেন শেখ হাসিনা। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের অনেক উন্নয়ন অর্জনকে হুমকির মুখোমুখি করছে জানিয়ে ঐতিহাসিক প্যারিস জলবায়ু চুক্তিটি অনুসমর্থনের জন্য সব দেশের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই এই জলবায়ু চুক্তিটি অনুসমর্থন করেছে। আমি আশা করি বৃহৎ কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো অতিসত্বর চুক্তিটিতে অনুসমর্থন জানাবে। জাতিসংঘের বিদায়ী মহাসচিব বান কি মুনের ভূমিকার প্রশংসা করে শেখ হাসিনা বলেন, “তিনি সব সময়ই একজন বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে বাংলাদেশের উন্নয়নের অর্জনগুলোকে বাকি বিশ্বের জন্য ‘রোল মডেল’ হিসেবে তুলে ধরেছেন।” মতের ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও মানবতার স্বার্থে জাতিসংঘকে আরও টেকসই এবং প্রাসঙ্গিক করে তুলতে নতুন করে শপথ নিতে সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
×