ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যfপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

পিতৃভক্ত পুত্র

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

পিতৃভক্ত পুত্র

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছন : ইবরাহীমের মতো আবার/কোরবানি দাও প্রিয় বিভব/জবীহুল্লাহ ছেলেরা হোক। জবীহুল্লাহ হযরত ইবরাহীম আলায়হিস সালামের জ্যেষ্ঠ পুত্র হযরত ইসমাঈল আলায়হিস সালামের উপাধি। জবীহুল্লাহ শব্দের অর্থ আল্লাহর উদ্দেশে জবেহকৃত বা উৎসর্গকৃত। হযরত ইবরাহীম আলায়হিস সালামের প্রথম স্ত্রী বিবি সারার গর্ভে কোন সন্তান না হওয়ায় তিনি মিসরের এক অভিজাত পরিবারের কন্যা বিবি হাজিরা আলায়হাস সালামকে বিয়ে করে আনেন। তিনি আল্লাহর নিকট একটি পুত্র সন্তানের জন্য দু’আ করেন এই বলে : হে আমার রব! আমাকে এক সৎকর্মপরায়ণ সন্তান দান করুন। আল্লাহ তার দুআ কবুল করেন। আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : অতঃপর আমি তাকে এক স্থিরবুদ্ধি পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। (সূরা সাফফাত: আয়াত ১০১)। হযরত ইবরাহীম আলায়হিস সালাম সদ্যজাত শিশু ইসমাঈল আলায়হিস সালামসহ বিবি হাজিরা আলায়হিস সালামকে বহুদূরে মক্কা মুকাররমায় রেখে এলেন। মাঝে মধ্যে তিনি মক্কা এসে স্ত্রী ও পুত্রকে দেখে যেতেন। এক রাতে তিনি স্বপ্নে আদিষ্ট হলেন তার প্রিয় বস্তুকে জবেহ বা কোরবানি কর। তিনি স্বপ্নের তাবীর করে বুঝলেন তার নিকট সবচেয়ে প্রিয় বস্তু হচ্ছে নিজ প্রিয় পুত্র ইসমাঈল। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : অতঃপর সে (পুত্র) যখন তার পিতার সঙ্গে কাজ করার বয়সে উপনীত হলো তখন ইবরাহীম বলল : হে পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখি যে আমি তোমাকে জবেহ করছি, এখন অভিমত কি বলো? সে (পুত্র) বলল : হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন সেটাই করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। যখন তারা (পিতা-পুত্র) উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইবরাহীম তার পুত্রকে কাত করে শোয়ায়ে ফেলল। তখন আমি (আল্লাহ) তাকে আহ্বান করে বললাম : হে ইবরাহীম! তুমি তো স্বপ্নাদেশ সত্যিই পালন করলে! এইভাবে আমি (আল্লাহ) সৎকর্ম পরায়ণদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটা ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা। আমি (আল্লাহ) তাকে (পুত্রকে) মুক্ত করলাম এক কোরবানির বিনিময়ে। (সূরা সাফফাত : আয়াত ১০২-১০৭)। পিতা হযরত ইবরাহীম আলায়হিস সালাম কোরবানি করতে ও পুত্র হযরত ইসমাঈল আলায়হিস সালাম কোরবানি হতে আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন সেটাই স্মরণ করে কয়েক হাজার বছর ধরে ১০ জিলহজ মুসলিম দুনিয়াজুড়ে পালিত হয়ে আসছে। আল্লাহর নবী হযরত দাউদ আলায়হিস সালামের পুত্র হযরত সুলায়মান আলায়হিস সালাম, আল্লাহর নবী হযরত ইয়াকুব আলায়হিস সালামের পুত্র হযরত ইউসূফ আলায়হিস সালাম পিতৃভক্তির অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। হযরত লোকমান আলায়হিস সালাম নবী ছিলেন না কিন্তু প্রচুর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তার পুত্র ছিলেন পিতার অনুগত। হযরত লোকমান (আ.) তার পুত্রকে যে উপদেশ দিতেন তার বর্ণনা আমরা কুরআন মজীদে দেখতে পাই। ইরশাদ হয়েছে : স্মরণ করো, যখন লোকমান উপদেশচ্ছলে তার পুত্রকে বলেছিল! হে আমার পুত্র! আল্লাহ্র কোন শরিক কর না। নিশ্চয় শিরক চরম যুলুম (সূরা লুকমান : আয়াত ১৩) হে আমার পুত্র ক্ষুদ্র বস্তুটি যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় এবং তা যদি শিলা গর্ভে অথবা আকাশে কিংবা মৃত্তিকার নিচে, আল্লাহ্ সালাত কায়েম করবে, সৎ কর্মের নির্দেশ দেবে আর অসৎ কর্মে নিষেধ করবে এবং আপদে বিপদে ধৈর্য ধারণ করবে। এটাই তো দৃঢ় সংকল্পের কাজ। অহঙ্কার বশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা কর না এবং পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে বিচরণ কর না। নিশ্চিয় আল্লাহ্ কোন উদ্ধত অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না। তুমি পদক্ষেপ করবে সংযতভাবে এবং তোমার কণ্ঠস্বর নিচু করবে। নিশ্চয় স্বরের মধ্যে গর্দভের স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর। (সূরা লুকমান : আয়াত ১৬-১৯) বর্তমান লেখকের একমাত্র পুত্র আরিফ বিল্লাহ্ মিঠু একজন খ্যাতিমান ছড়াকার। তার লেখা কয়েকখানা ছড়ার বই আছে। প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়ে কিছুদিন সাংবাদিকতা করে। মিঠু ম্যানেজমেন্টে পড়ে একটি ব্যাংকে যোগদান করে। এখন সে ব্যাংক ম্যানেজার। তার নানাজান ছিলেন খড়কীর পীর এবং দাদাও ছিলেন পীর। ২০০৬ সালে তাকে ও তার মা মাহমুদা মায়াকে নিয়ে হজে যাই। আরাফাত ময়দানে, মীনাতে, মক্কা, মদীনায় তার মিলাদ শরীফ পড়ানোর মধুর ইলহানে সবাই মুগ্ধ হয়ে যায়। ৯ জিলহজ আরাফাত ময়দানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান শেষে মুযদালিফা এসে অবস্থান করি সারা রাত। সে রাতে হাড় কাঁপানো শীতে সে পিতা-মাতাকে আগলে রাখে। সকালে মিনা এসে বড় শয়তানকে সাতটা কংকর মেরে আমি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ি। রক্তচাপ ৫০-এ নেমে আসে। সে আমাকে প্রয়োজনীয় সেবা দিয়ে কোলের ওপর আমার মাথা নিয়ে বুক, মাথা ম্যাসাজ করতে করতে বলে : বাপ! কোন চিন্তা কর না। তুমি সুস্থ হয়ে যাবে। আমরা যথাসময় বাড়ি যাব। এমনভাবে সে কথাগুলো বলছিল যে, আমি যেন তার ছোট্ট পুত্রটি। এবার এই ২০১৬-এর ঈদ-উল-আযহার রাতে হঠাৎ আমার রক্তচাপ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেলে সে সারাক্ষণ সেবা শুশ্রƒষা করে আমাকে সুস্থ করে ছাড়ল। কয়েক বছর আগে আমি হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে ছিলাম। সেই সময় সে সারাক্ষণ কাঁপছিল। সে মুনাজাত করছিল: আল্লাহ্ আমার আব্বুর হায়াত দারাজ করে দাও। আমি আব্বুকে নিয়ে ঈদের নামাজ পড়ব। সেটা ছিল ঈদ-উল-আযহা। ঐদিন সকালে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলে আমাকে হুইল চেয়ারে করে মসজিদে নেয়া হয়। সব পিতার পুত্র যেন হয় পিতৃভক্ত। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলি : জবীহুল্লাহ্ ছেলেরা হোক। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.) সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×