ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থনৈতিক প্রাচুর্য ও সামাজিক স্থিতিশীলতা

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

অর্থনৈতিক প্রাচুর্য ও সামাজিক স্থিতিশীলতা

একজন রিক্সাওয়ালা তার রিক্সার ভাড়া নির্ধারণে যে পদ্ধতি ব্যবহার করে বা যে আচরণ করে তার সঙ্গে একটি এয়ারলাইন্সের বা তার মালিকের ভাড়া নির্ধারণ পদ্ধতির পার্থক্য কী? আরেকটি প্রশ্ন করা যাক, একজন সবজির দোকানি তার পণ্যের দর-দাম নির্ধারণে যে আচরণ করে তার সঙ্গে একটি ব্যাংকের অথবা তার মালিকের সুদ নির্ধারণের আচরণের মধ্যে পার্থক্য কী? এক সময় এসব করার প্রয়োজন ছিল না। তখন ব্যাংক ও বিমান কোম্পানি ছিল সরকারের হাতে। এখন এসবের মালিকানায় সরকার বাহাদুর থাকলেও বেসরকারী ব্যাংক ও বিমান কোম্পানিই সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। মালিকানা কাঠামোতে এই পরিবর্তনের পাশাপাশি ভাড়া অথবা সুদ নির্ধারণ পদ্ধতিতেও পরিবর্তন এসেছে। আগে সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যাংক ও বিমান কোম্পানির সুদ এবং ভাড়া ছিল ‘ফিক্সড’ বা পূর্ব-নির্ধারিত। সকাল-বিকাল চাহিদা-সরবরাহের ভিত্তিতে তা পরিবর্তিত হতো না। মানুষ পূর্বাহ্নেই জানত ব্যাংকে আমানতের ওপর সুদের হার কত অথবা জানত ঢাকা-চট্টগ্রামের বিমান ভাড়া কত। এতে সুবিধা ছিল। মানুষ খরচের পরিকল্পনা করতে পারত। এখন আর তা সম্ভব নয়। এখন বেসরকারী খাতের রিক্সাওয়ালা যেমন সকাল-বিকাল, দুপুর ও রাতে ভাড়া পরিবর্তন করে, তেমনি বিমান কোম্পানিগুলোও এমন করে। মেয়েছেলেকে দেখলে, বৃষ্টি হলে, স্কুলগামী শিশুসহ ভদ্রমহিলাদের দেখলে, অফিসে যাওয়া-আসার সময় হলে রিক্সাওয়ালাদের দাপট বাড়ে। দাপট বাড়ে সিএনজিওয়ালাদের, এমনকি হলুদ, ট্যাক্সিওয়ালাদেরও। অসহায় যাত্রীরা তাদের আচার-ব্যবহারে ক্ষুব্ধ হন, নিপীড়িত হন (গরিবের অত্যাচার!)। কিন্তু কিছুই করার থাকে না। শত হোক চাহিদা-সরবরাহের মিসম্যাচ। অর্থনীতিবিদদের প্রিয় বিষয়, এটাই নিয়ম তাই শেখানো হয়। ব্যাংকগুলো কী করে? তারাও এই পথ ধরেছে। মাসে মাসে, সপ্তাহে সপ্তাহে সুদের হার পরিবর্তন। আজ এক রকম সুদের হার, কাল ভিন্ন রকম। একেক ব্যাংকে একেক রকম। আবগারি শুল্ক কাটা হচ্ছে সুদ থেকে, ব্যাংক চার্জ কাটা হচ্ছে, আয়কর কাটা হচ্ছে। বলা হচ্ছে এটাই বাজার অর্থনীতি। যে ব্যাংকের শক্তি, আর্থিক শক্তি বেশি সেই ব্যাংক আমানতের ওপর সুদ বেশি দেবে, যাদের শক্তি কম তারা দেবে কম সুদ। টাকা বেশি রাখলে বেশি হারে সুদ, কম রাখলে কম হারে সুদ। সুদের হার কার্যকর করার সময় একেক ব্যাংকের একেক পদ্ধতি। কেউ ৩৬৫ দিনের হিসাবে করে কেউ করে ৩৬০ দিনের হিসাবে। বাজার অর্থনীতি! এর ফলে আমানতকারীরা জানে না কোন মাসে তাদের কত টাকা সুদ আয় হবে। আদৌ সুদ আয় এক বছর পর হবে কীনা তাও তারা জানে না। অথচ আমানতকারী/সঞ্চয়কারী ঠিকই জানে তার মাসিক খরচ কত হবে। বাড়ি ভাড়ার পরিবর্তন হবে, উপরের দিকে, জিনিসপত্রের দামে পরিবর্তন আসবে, তাও উপরের দিকে। এ এক যাঁতাকল আর কী? বাসওয়ালা, ট্রাকওয়ালা, লঞ্চওয়ালাদের দাম নির্ধারণ পদ্ধতি একই। তারা ঈদের সময়, পার্বণের সময়, প্রয়োজনের সময় যথেচ্ছভাবে ভাড়া বাড়ান। যাত্রীরা অসহায়। ব্যাংক, বীমা, পরিবহন, সবজিওয়ালা, রিক্সাওয়ালা, সিএনজিওয়ালা থেকে শুরু করে বেসরকারী খাতের যত ব্যবসা-বাণিজ্য আছে সবারই একই আচরণ। যখন গ্রাহক, ভোক্তা, যাত্রীদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তখন তারা যথেচ্ছভাবে সুদের হার কমান, জিনিসের দাম বাড়ান, ভাড়া নেন বেশি বেশি। বলা হচ্ছে এটাই বাজার অর্থনীতি, খোলা বাজারি অর্থনীতি, মুক্তবাজার অর্থনীতি। এই বাজারে ক্রেতার স্বার্থ, ভোক্তার স্বার্থ, গ্রাহকের স্বার্থ, আমানতকারীর স্বার্থ, সঞ্চয়কারীর স্বার্থ কে দেখবে? কাগজে-কলমে দেখার কথা সরকারের। থাকার কথা আইন, বিধি, নিয়ম। বাস্তবে তা নেই, আইন থাকলে বিধি নেই, আইন ও বিধি থাকলে তার প্রয়োগ নেই। এতে মানুষ মরে, গ্রাহক মরে, ভোক্তা মরে। প্রতিবাদের কোন ব্যবস্থা নেই। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি হচ্ছে বাজারে, বিষ মেশানো শাক-সবজি, মাছ, ফলমূল বিক্রি হচ্ছে বাজারে, হাসপাতাল যাচ্ছেতাই হারে রোগীদের চার্জ করছে, ডাক্তার ইচ্ছেমতো তার ফি আদায় করছে। স্কুল-কলেজ ইচ্ছেমতো বেতন নিচ্ছে। সমাজের সর্বত্র এই অবস্থা। বাজার অর্থনীতির নামে, চাহিদা ও সরবরাহ নীতির কথা বলে চলছে লুট যাকে ভদ্র ভাষায় আবার বলা হচ্ছে ‘ক্যাপিটেল ফর্মেশন’। এভাবেই নাকি পৃথিবীর সব দেশে পুঁজি গঠিত হয়েছে। ‘প্রিমিটিভ ক্যাপিটেল’। কেউ বলে না যে, প্রিমিটিভ ক্যাপিটেল এক্যুমুলেশন যখন চলে তখন আইনী কাঠামো ছিল না, ‘দুর্নীতি’ শব্দ ছিল না, দুর্নীতির সংজ্ঞা ছিল না। কিন্তু এখন তা আছে। তা দেখাশোনার জন্য প্রতিষ্ঠান আছে। এরই মধ্যে বাজারে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যথেচ্ছ আচরণ করে পণ্যের দাম নির্ধারণে, ভাড়া নির্ধারণে, সুদ নির্ধারণে, চার্জ নির্ধারণেÑ এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। দেশের সিংহভাগ লোক এক অস্থিতিশীলতার শিকার। তারা অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সামাজিক অস্থিতিশীলতার শিকার। তারা ভীষণ ও ভয়াবহ অনিশ্চয়তার শিকার। দৃশ্যত চারদিকে প্রাচুর্য্য। কিভাবে? ধরা যাক, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের কথা। আমাদের মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ আকাশচুম্বী। ব্যাংকে ব্যাংকে টাকার স্তূপ। মানি মার্কেটে টাকার কোন চাহিদা নেই। সারাদেশ দোকানে দোকানে সয়লাব। শপিংমল হচ্ছে তো হচ্ছেই। আগাম শপিং মল করা হচ্ছে। বিশাল বিশাল প্রকল্পে কাজ করছে হাজার হাজার বিদেশী। সরকার জনসাধারণের স্বার্থে হাতে নিচ্ছে বিশাল বিশাল প্রকল্প। সাত শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার যা ছিল চিন্তার বাইরে। এক কোটি লোক বিদেশে কাজ করে। তারা প্রতি মাসে শত শত কোটি টাকা দেশে পাঠাচ্ছে। মধ্য আয়ের দেশ হব অচিরেই। চল্লিশ লাখ নারী শ্রমিক শুধু পোশাক শিল্পেই কাজ করে। কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা কমছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ বিশ্বব্যাংক। কাগজে দেখেছি- বিশ্বব্যাংক প্রধান ঢাকায় আসবেন সরাসরি প্রশংসা করতে। কোন মুখে ঢাকায় আসবেন দু’দিন আগে যে প্রতিষ্ঠান আমাদের গালাগাল করে ঋণ বাতিল করেছে। না, উপায় আছে। ড. অমর্ত্য সেনকে সঙ্গে নিয়ে আসবেন। তিনি বিশ্বব্যাংকের ঢাল হিসেবে কাজ করবেন। হয়ত আসবেন একটা কথা বলতে যা তারা সর্বত্রই বলেন। বলবেন বেসরকারী খাতের উন্নয়নের ফলেই তোমাদের এত উন্নতি। কথা কিন্তু দৃশ্যত সত্যি। আমরা স্বাধীনতার পর এত উন্নয়ন দেখাতে পারিনি। এর কারণ তারা বলছেÑ উল্টোপথ ধরেছিলে তোমরা। এখন তোমরা সঠিক পথে আছÑ বাজার অর্থনীতি। সব নিয়ন্ত্রণ করছে বেসরকারী খাত। অতএব সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধি, অতএব, তোমরা এগিয়ে যাচ্ছ মধ্যবিত্তের দেশের দিকে। দৃশ্যত সব ঠিক। মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে। শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়েছে, সাক্ষরতার হার বেড়েছে, দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে, গড় আয়ু বেড়েছে। এসব কিন্তু প্রাচুর্যের লক্ষণ। চারদিকে প্রাচুর্য্যরে লক্ষণ দৃশ্যমান। বড় মধ্যবিত্তের উন্মেষ ঘটছে। কিন্তু যে জিনিসটা বোধের মধ্যে এর পাশাপাশি আসা দরকার তা হলো বাজার অর্থনীতি, বেসরকারী খাতের অদম্য ও অনিয়ন্ত্রিত আচরণ সমাজকে, সামাজিক স্থিতিশীলতাকে দুমড়ে-মুচড়ে দিচ্ছে। যুব সম্প্রদায়ের একটা অংশকে ভুলপথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ধর্মপ্রাণ মানুষকে ভুলপথে নেয়া হচ্ছে, ড্রাগ-ইয়াবা ইত্যাদি ছাত্রদের নষ্ট করছে। বাড়িতে বাড়িতে মহিলাদের লক্ষ্যবস্তু করে তাদের মস্তক ধোলাই করার চেষ্টা করা হচ্ছে। মা সন্তানকে, সন্তান মাকে হত্যা করছে। হত্যা করে লাশ শত টুকরা করা হচ্ছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখন টাকার উপাসনা, বিত্তের উপাসনা। গুণী লোকের কদর নেই। এসব অস্থিতিশীলতা, অনিশ্চয়তার লক্ষণ। সরকারকে বলব, উন্নতি ও উন্নয়ন চলছে, চলুক। সঙ্গে সঙ্গে এই নেতিবাচক দিকগুলোর প্রতি নজর দেয়া দরকার। মানুষের রোজগার ঠিক রাখা হোক। বাজার স্থিতিশীল রাখা হোক। নিয়ন্ত্রণহীন বাজারের (মার্কেট) কাছে মানুষকে অসহায় করে রাখা ঠিক হবে না। বাজারের অত্যাচার থেকে মানুষকে বাঁচাতে হবে। বাজার যদি অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতার হাতিয়ার হয় তাহলে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×