ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সেবক নয়, ঘাতক

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

সেবক নয়, ঘাতক

‘যে জীবন দোয়েলের, ফড়িংয়ের’ বলে কবি জীবনানন্দ দাশ আক্ষেপ করেছিলেন, সেই জীবন এখন ‘পাখির মতো মাছির মতো’ রাজপথে ছটফটিয়ে মারা যাচ্ছে। একটি নয়, শত শত মরছে। যেন এই মৃত্যুই তাদের জন্য বরাদ্দ। নিহত ও আহতদের স্বজনের ভারি কান্নায় আকাশ-বাতাস কম্পিত হলেও তাতে কারও কিছু যায় আসে না। যে যানবাহন মানুষ বহন করে দূর থেকে দূরত্বে কিংবা কাছে-দূরে নিয়ে যায়, সেই যানবাহনই হরণ করে নিচ্ছে অনায়াসে মানবজীবন। পঙ্গু করে দিচ্ছে এমনভাবে যে বাকি জীবন হচ্ছে চলচ্ছক্তিহীন। পরিবারের আয়ের প্রধান ব্যক্তিটি নিহত বা পঙ্গু হলে, সেই পরিবারকে নেমে আসতে হয় রাস্তায় কিংবা ভিক্ষাবৃত্তিতে, এমন ঘটনা আকছার ঘটেই চলেছে। এমন মৃত্যু যেন দেশে আজ ঘটেই চলছে। কেন নিরাপদে মানুষ চলাচল করতে পারে না রাজপথে, কেন যানবাহন হয়ে ওঠে মৃত্যুদূতÑ তার কোন জবাব মেলে না কোথাও। যানবাহনের নিচে পিষ্ট করে মানুষ মারা, কিংবা বেপরোয়া যান চালিয়ে যাত্রীসহ উল্টে যাওয়া বা খাদে পড়ার ঘটনার কোন জবাবদিহিতা নেই, বিচার দূরে থাক। আর তা হয় না বলেই নির্বিচারে সড়ক দুর্ঘটনার নামে মানুষ খুন হচ্ছে। ঘাতক গ্রেফতার হলে শুরু হয় হুলস্থূল। তাকে রক্ষায় শুরু হয় নানাবিধ বিধি-বিধান লঙ্ঘন। যানবাহন ধর্মঘট চালানো থেকে বিশৃঙ্খলা তৈরির কাজটি যেন ট্রাডিশনে পরিণত হয়েছে। যে দেশে বাঘ মারা হলে শাস্তি মৃত্যুদ-। সেদেশে গাড়ি চাপায় মানুষ হত্যার শাস্তি মাত্র ক’বছর কারাদ-। সুতরাং প্রাণহরণ করা জায়েজ প্রায়। বলা হয়, পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা আনা যায়নি দীর্ঘ সময়ে। দুর্ঘটনারোধ নিয়ে সভা সেমিনার গোলটেবিলের মতো আয়োজন হয়, যত সুপারিশ উত্থাপিত হয়, সবই গাড়ির ধোঁয়ায় মিশে যায়। কার্যকর করার কোন উদ্যোগ কস্মিনকালেও দেখা যায় না। এবারের ঈদ উৎসবে সড়ক দুর্ঘটনা মহামারী আকার ধারণ করে। প্রতি ঈদেই ঘরে বা কর্মস্থলে ফেরার পথে শতাধিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটবে এবং শতাধিক মানুষ মারা যাবে- এটা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। গত ঈদ-উল-ফিতরে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত হয়েছিল নয় শ’ ত্রিশজন। আর ঈদ-উল-আযহাকে কেন্দ্র করে দুই শতাধিক মানুষ নিহত ও সহস্রাধিক আহত হয়েছে। মুখোমুখি সংঘর্ষ ট্রাকের বেপরোয়া চলাচল, বাসের দ্রুতগতিতে ছুটে চলা, ইজিবাইক যত্রতত্র চলাচল এবং মোটরসাইকেলের যথেচ্ছ ব্যবহার সড়ক দুর্ঘটনার হার বাড়িয়ে দিয়েছে। গতিসীমা নিয়ন্ত্রণে নেই কার্যকর ব্যবস্থা। দুর্ঘটনা রোধে আইনের কার্যকর প্রয়োগ নেই। তাই মালিক ও চালকরা আইনের তোয়াক্কাও করেন না। মোটরযান অধ্যাদেশ কেউই মানে না। শুধু ঈদ নয়, সারাবছরই চলে সড়ক দুর্ঘটনা। ২০১৫ সালেই মারা গেছে আট হাজার দুই শ’ পনেরো জন। কর্তৃপক্ষ হয়ত ভাবছেন, এভাবে জনসংখ্যা হ্রাস করার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন তারা। মূলত সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের প্রশাসনিক দুর্বলতার পাশাপাশি দুর্নীতির বিস্তার কোন নিয়মনীতি চালু করতে পারছে না। তাই চলাচল অযোগ্য যানবাহন যেমন সড়ক মহাসড়কে চলে, তেমনি অদক্ষরাও চালকের আসনে বসে। যাত্রীসেবা যাদের কাজ, সেই সেবকরা ক্রমশ ঘাতকে পরিণত হচ্ছে, অথচ কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। ‘হেন করেঙ্গা তেন করেঙ্গা’ বলে যতই লম্ফঝম্প করুক না কেন, এদের হাতে কোন যাত্রীর জীবনই নয় নিরাপদ। তাই কঠোর হস্তে বিধিবিধান প্রয়োগের জন্য যোগ্য, দক্ষ, কর্মকৌশল গড়ে তোলা দরকার হয়ে পড়েছে। দেশবাসী এমন দুর্ঘটনা আর চায় না।
×