ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাল্যবিয়ে শিক্ষা এবং উন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধা

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

বাল্যবিয়ে শিক্ষা এবং উন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধা

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গে অন্য খাতগুলোও সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এখন অনেকটাই দারিদ্র্য বিমোচনের পথে। কিন্তু সামগ্রিক দেশের সমৃদ্ধির সূচক শুধুমাত্র তার বস্তুগত কিংবা বৈষয়িক নয়। মানুষের সামাজিক প্রতিবেশ বৈষয়িক সম্পদ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলেও তার মানসিকতাও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তার ওপর শ্রেণীবিভক্ত সমাজে বিভাজনের কারণে মানুষে মানুষে বৈষম্যও পরিলক্ষিত হয়। চিন্তা-চেতনায় কিংবা মূল্যবোধে মানুষ যদি এগিয়ে যেতে না পারে তাহলে তার বৈষয়িক অর্জন অনেকাংশেই খর্বিত হয়ে যায়। মানুষের সচেতনতা, যুগের সঙ্গে তাল মেলানো, আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে নতুন ভাবনা গ্রহণ সব মিলিয়েই একজন মানুষ তার সময়ের প্রতিনিধি হয়। সমকালের মাঙ্গলিক ধ্যান-ধারণাকে মেনে নিতে না পারলে তার অন্যান্য অর্জন থাকা সত্ত্বেও তাকে পেছনের দিকে ঠেলে দেয়। এ ধরনের সমস্যা বিশ্বের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেও রয়েছে। শ্রেণীবিন্যস্ত সমাজে সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার হয় দুর্বল অংশ হিসেবে নারী সমাজ। সমাজের অর্ধাংশ হয়েও। এ কারণেই উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে নারী-পুরুষের তারতম্য বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। শিক্ষা, বিয়ে, কর্ম ও পেশাগত অবস্থান, মজুরি নির্ধারণ সর্বোপরি গৃহাস্থালির কার্যক্রম আছেই। কৃষিতে নারী শ্রমের মজুরি বৈষম্য নারীবঞ্চনার এক বেদনাঘন দীর্ঘশ্বাস। কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে আমরা এখনও কৃষি উৎপাদনের ওপরই সিংহভাগ দাঁড়িয়ে আছি। আর শিক্ষা তো একটি জাতির মেরুদ-। সেখানেও নারী-পুরুষের তারতম্য বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। শিক্ষা এবং নারী শিক্ষার হার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেলেও উন্নয়নের এই সূচকটিতেও নারীর তুলনায় পুরুষরা অনেকখানি এগিয়ে। আর বিয়ের ব্যাপারে তো নারী দুর্দশার চিত্র বিভিন্ন গণ এবং সংবাদ মাধ্যমে হরহামেশাই প্রচার হয়ে থাকে। সেই কবে উনিশ শতকে বিদ্যাসাগর আন্দোলন করেছিলেন বাল্যবিয়ের বিপক্ষে। উনিশ শতক পার করে আমরা বিশ শতককেও অতিক্রম করলাম। একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের মাঝামাঝিতে আমরা। এখনও কি বাল্যবিয়েকে আমরা জয় করতে পেরেছি? খোঁজ নিলে দেখা যাবে আজও বাংলার অনেক ঘরে অল্পবয়সী কন্যাদের বিয়ের নামে অপরিণত জীবনযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। যে সময় একটি ঘরের মেয়ের বই হাতে স্কুলে যাওয়ার কথা তার ভাইয়ের পাশাপাশি। কিন্তু তাকে গিয়ে বসতে হয় বধূবেশে বিয়ের আসনে। যে বিষয়টা সম্পর্কে যখন তার কোন ধারণাই জন্মায় না। আর বাল্যবিয়ের কারণে নারী শিক্ষার হারও কমে যায়। এ চিত্রের হার বাংলাদেশে বেশি হলেও বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এর আলামত লক্ষ্য করা যায়। এক পরিসংখ্যানে বেরিয়ে আসে বিশ্বে ৩৮ হাজারেরও বেশি কন্যা শিশুকে জোর করে বিয়ে দেয়া হয়। উন্নয়নশীল দেশে প্রতি ৯ জনের মধ্যে ১ জনের বিয়ে হয় ১৫ বছর বয়সের নিচে। আবার এদের মধ্যে সিংহভাগেরই বয়স ৮ থেকে ৯ বছর। এই শিশু বিয়েকে উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সবচাইতে বড় বাধা হিসেবে উল্লেখ করা যায়। মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার হার কমে যায়, কর্ম এবং পেশাগত ধারায় তাদের বিচ্যুতে ঘটে সর্বোপরি সামগ্রিক উন্নয়নে তারা পিছিয়ে যায়। সবচাইতে বড় কথা একজন বালিকা কিংবা কিশোরী জীবনে স্বপ্ন দেখার আগেই সর্বনাশের দ্বারে গিয়ে উপস্থিত হয়। আঠারো বছরের আগে কন্যা সন্তানকে বিয়ে দেয়া আইনগত এবং সামাজিক অপরাধ। আইনে এই অপরাধের শাস্তির বিধান আছে। এসব আইনগত বিধিনিষেধ কেউ মানেও না আবার বিপরীত দিকে এ অন্যায়ের শাস্তির বিচারও হয় না। আসলে আইন করে। বিচার দিয়ে সেভাবে অন্যায় অপরাধের মাত্রা কমানো কি যায়? প্রতিটি মানুষের সচেতন মানসিকতা, ন্যায়-অন্যায় বোধ, কন্যা সন্তানের প্রতি গভীর মায়া-মমতাই পারে এসব আইন এবং সমাজবহির্ভূত কার্যক্রম থেকে মানুষকে বিরত রাখতে। ছেলেমেয়ে উভয়েই একজন পিতামাতার সন্তান। একটি ছেলের যেমন তার জীবনকে সমৃদ্ধ করার অধিকার এবং ক্ষমতা থাকে একজন মেয়েরও তা থাকা বাঞ্ছনীয়। মেয়ে বলেই অহেতুক, অপ্রয়োজনে বাল্য বয়সে বিয়ে দিয়ে অন্যত্র পাঠিয়ে দিতে হবে তা কোনভাবে যৌক্তিকও নয় গ্রহণযোগ্যও নয়। যেসব মেয়ের বিচার বুদ্ধি-বোধ জাগ্রহ হওয়ার আগেই তাকে বিয়ের আসনে বসতে হয়, যারা সচেতন হওয়ার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হয় তাদের জন্য এক সময় বাবা-মার দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। সুতরাং সময় থাকতে বাবা-মাকেই সাবধান হতে হবে। ছেলের মতো মেয়েকেও নিজের জীবন সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তা করতে দিতে হবে, তার জীবন গড়ার সুযোগ এবং সুবিধা দিতে হবে। তারপর বয়ঃপ্রাপ্ত হলে, নিজেকে তৈরি করতে পারলে, জীবনকে যথার্থভাবে অনুধাবন করার পরই তাকে সুযোগ দেয়া উচিত তার জীবন সঙ্গী নির্বাচনে। জোর করে কিংবা অবোধ এবং বাল্য বয়সে বিয়ে দিয়ে কন্যা সন্তানের সর্বনাশের পথ থেকে সব বাবা-মারই সরে আসা তাদের নৈতিক এবং মানবিক দায়িত্ব।
×