ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রেজওয়ানা আলী তনিমা

আডা লাভলেস বিশ্বের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

আডা লাভলেস  বিশ্বের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার

উনিশ শতকের প্রতিভাবান গণিতবিদ আডা লাভলেসকে বিশ্বের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার বলা হয়। তিনিই সর্বপ্রথম কম্পিউটার নির্দেশনা রচনা করেন। তার পিতা বিখ্যাত কবি লর্ড বায়রন ও মা আনা ইসাবেলা নোয়েল। ১৮১৫ সালে লন্ডনে সম্ভ্রান্ত ঘরে জন্মগ্রহণ করেন আডা। তার পারিবারিক জীবন আর দশটা স্বাভাবিক ঘরের মতো ছিল না। জন্মের সপ্তাহ খানেকের মধ্যে তার পিতা-মাতার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। বাবা বায়রন ইংল্যান্ড ত্যাগ করেন। আডার আট বছরে তিনি মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত মেয়ের সঙ্গে বাবার আর কখনও দেখা হয়নি। তৎকালীন অভিজাত পরিবারের চেয়ে আডার বেড়ে ওঠা অন্য রকম ছিল। গণিত ও বিজ্ঞানের মতো জটিল বিষয় তখন মেয়েদের জন্য খুব প্রচলিত ছিল না। তবু তার মা আনা নিজে সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন ও গণিতে সুশিক্ষিত ছিলেন এবং মনে করতেন এসব কষ্টসাধ্য বিষয়ে মনোনিবেশ মেয়েকে তার পিতার মতো অস্থিরচিত্ততা ও খেয়ালিপনা থেকে দূরে রাখবে। তার প্রচেষ্টায় শিক্ষকরা আডাকে এসব বিষয়ে শিক্ষাদান করেন। অবশ্য এসব শিক্ষা আডার জন্য শাপে বর হয়ে ছিল। আবিষ্কৃত হলো তার মধ্যে এসব ব্যাপারে জন্মগত মেধা আছে। সতেরো বছরে বয়সে তার আবিষ্কারক ও গণিতবিদ চার্লস ব্যাবেজের সঙ্গে পরিচয় হয়। বয়সে ব্যবধান থাকলেও দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। চার্লস ছিলেন আডার মেন্টরস্বরূপ। তার মাধ্যমে আডা ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের প্রফেসর অগাস্টাস ডি মোরনের কাছে উচ্চতর গণিত শাস্ত্রে পড়াশোনা শুরু করেন। চার্লস ব্যাবেজের আরেকটি বিশেষ পরিচয় হলো তিনি কম্পিউটারের জনক হিসেবে পরিচিত। গাণিতিক সমস্যা সমাধানের জন্য ডিফারেন্স ইঞ্জিন তার উদ্ভাবন। আডা ব্যাবেজের ধ্যান-ধারণার প্রতি অত্যন্ত আকৃষ্ট ছিলেন। ইঞ্জিন তৈরি শেষ হওয়ার আগে তিনি এই মেশিন দেখার সুযোগ পান। এটি তার সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নেয়। জটিলতর সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যাবেজ এ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন নামে আরেকটি মেশিনের পরিকল্পনা করেছিলেন। এই যন্ত্রটিতে পাঞ্চ কার্ডের মাধ্যমে ইনপুট আউটপুট পাওয়ার কথা বলা হয়। আডাকে এই এ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনের ওপর প্রকাশিত ইতালিয়ান প্রকৌশলী লুইগি মেনেব্রিয়া রচিত ফরাসী ভাষায় লেখা একটি নিবন্ধ অনুবাদের দায়িত্ব দেয়া হলো। তিনি অনুবাদের সঙ্গে সঙ্গে এতে নিজ ধ্যান-ধারণাও যুক্ত করেন। ফলে আসল রচনার চেয়ে তার নোটগুলোই তিনগুণ লম্বা হয়ে পড়ে। ১৮৪৩ সালে আডার সম্পূর্ণ লেখাটি একটি ইংরেজী বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। মজার ব্যাপার আডা এতে নিজের নামের বদলে শুধু নামের আদ্যাক্ষর ব্যবহার করেন। নিবন্ধের নোটগুলোতে তিনি কিভাবে কোডের মাধ্যমে যন্ত্র দিয়ে নম্বর, সঙ্কেত ও অক্ষরের সমন্বয় করা যায় সেটা ব্যাখ্যা করেন। সিরিজ ইন্সট্রাকশনের ক্ষেত্রে তার তাত্ত্বিক পদ্ধতি ‘লুপিং’ নামে এখন আধুনিক কম্পিউটার প্রোগ্রামে ব্যবহৃত হয়। নিবন্ধে আডা আরও কিছু সুদূরপ্রসারী তত্ত্ব দেন। কিভাবে যন্ত্রকে প্রয়োজনীয় প্রোগ্রাম করে ডাটা ইনপুট করে বার্নোলি সংখ্যার ক্যালকুলেশন করানো যায় এই বিষয়ক তার নির্দেশনাকে বিশ্বের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রাম বলা হয় ও তিনি প্রথম প্রোগ্রাম রচয়িতা হিসেবে অভিধা পান। শুধু গণিতবিদ বা প্রোগ্রামকারী নন, আডা ছিলেন একজন ভিশনারিও। তিনি মনে করতেন কম্পিউটার দিয়ে শুধু পরিমাণগত নয়, গুণগত মানেরও পরিমাপ সম্ভব। তাঁর মতে কম্পিউটার শুধু সংখ্যা সংক্রান্ত বিষয় নয়, যা কিছুকেই নম্বর দিয়ে উপস্থাপন করা যায় সে সবেরই পরিমাপ করতে সক্ষম। কম্পিউটার তাত্ত্বিক অবস্থা থেকে বাস্তবে আসার এক শ’ বছর আগেই আডা ভবিষ্যদ্বাণী করেন, এই ধরনের যন্ত্র গ্রাফিক্স, সঙ্গীত ও বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে কাজে লাগানো সম্ভব। অবশ্য অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তিদের মতো তার জীবদ্দশায়ও তার কাজ তেমন গুরুত্ব পায়নি। ১৮৫২ সালে ইউরিন ক্যান্সারে ভুগে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পরে তিনি যেই পিতাকে স্মরণ হওয়ার সময়কার থেকে জীবনে সাক্ষাত পাননি তারই পাশে ইংল্যান্ডের নটিংহ্যামে একটি চার্চে চিরনিদ্রায় শায়িত হন। আডার মৃত্যুর অনেক পরে ১৯৫৩ সালে তার লেখা নোটগুলো বিভি বাউডেন পুনর্প্রকাশ করলে তা সবার গোচরে আসে। এরপর তিনি অনেক মরণোত্তর সম্মানে ভূষিত হন।
×