ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল মালেক

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথম ক্রুসিয়াল বিতর্ক ॥ কে জিতবেন হিলারি না ট্রাম্প?

প্রকাশিত: ০৩:৩৫, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথম ক্রুসিয়াল বিতর্ক ॥ কে জিতবেন হিলারি না ট্রাম্প?

দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন সমাপ্ত হওয়ার পর থেকেই মার্কিন নির্বাচনের ক্যানভাস যেন একটু একটু করে হারিয়ে ফেলছিল তার বর্ণাঢ্যতা। কিন্তু তিনটি তর্কযুদ্ধের মাধ্যমে দুই প্রার্থীর ওয়ান টু ওয়ান আসন্ন এনকাউন্টারগুলো সেটিকে আবার ভরে তুলছে বর্ণে বর্ণে। আগামী ২৬ সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্ক রাজ্যের হফস্ট্রা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দুই প্রার্থীর মধ্যে নির্বাচন ১৬-এর প্রথম তর্কবিতর্ক। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন উপলক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে এবার প্রথম যে টেলিভিশন বিতর্কটি হতে যাচ্ছে সেটি নিয়ে ভোটারদের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক কৌতূহল। কারণ এবারের প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন ও রিয়াল এস্টেট মুঘল ও রিয়ালিটি টিভি স্টার রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প উভয়েই রয়েছেন ইমেজ সঙ্কটে। এক বছরেরও বেশি সময় নির্বাচনী প্রচারণা সত্ত্বেও হিলারি কিংবা ট্রাম্প কেউই তাদের ইমেজ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হননি। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, দুই তৃতীয়াংশ ভোটার এবারের নির্বাচনী প্রচারণাকে সাম্প্রতিককালের মধ্যে সর্বাপেক্ষা নেতিবাচক হিসেবে নিয়েছেন। দেশের অর্ধেকেরও বেশি ভোটার দুই প্রার্থীর প্রতি অনেকটাই আস্থাহীন ও আবেগশূন্য। রেজিস্টার্ড ভোটারদের বিশ্বাস উভয় প্রার্থীই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক রিস্কি চয়েস। ভোটারদের মধ্যে ট্রাম্প এবং হিলারি ক্লিনটনকে পছন্দ ও অপছন্দের ব্যবধান খুব একটা লক্ষ্য করা যায়নি। কিন্তু তারা জানেন মন্দের ভাল হিসেবে তাদের একজনকে বেছে নিতে হবে। এসব মতামত নিয়ে হিলারি ও ডোনাল্ডের প্রতি সমর্থনের পাল্লা কখনও দাঁড়াচ্ছে প্রায় সমান সমান, কখনওবা ভারি কয়েক পয়েন্টের ব্যবধানে। স্বভাবতই ধারণা করা হয়, এই বিতর্কগুলোতে যিনি তর্কবাগীশ হয়ে দর্শকশ্রোতার হৃদয়ে নাড়া দিতে সক্ষম হবেন তিনিই বিজয়ী হবেন নির্বাচনে। ভোটের মোড় ঘোরাতে এই বিতর্ক ডোনাল্ড কিংবা হিলারি কার জন্য সহায়ক হবে সেটা নিয়েই এখন চলছে জল্পনা-কল্পনার পালা। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হবে আমেরিকায় নির্বাচনের সঙ্গে প্রেসিডেনশিয়াল বিতর্ক বাধ্যতামূলকভাবে জড়িত নয় এবং সংবিধানে এতদসম্পর্কে কোন নির্দেশনা দেয়া হয়নি। ব্যাপারটি পরবর্তীকালে যুক্ত হয়েছে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অঙ্গ হিসেবে নয়, প্রথা হিসেবে। আক্ষরিক অর্থে প্রেসিডেনশিয়াল বিতর্কের সূচনা হিসেবে ধরা হয় ১৮৫৮ সালে ইলিনয় স্টেটে অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের নির্বাচন উপলক্ষে আব্রাহাম লিংকন ও স্টিফেন ডগলাসের ডিবেটটি। দাসত্বের ফলে সমাজে নৈতিক ও অর্থনৈতিক অবক্ষয় ইস্যুতে মডারেটর বা প্যানেল ছাড়াই এটি চলে তিন ঘণ্টাব্যাপী এবং সিনেটর হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন ডগলাস। কিন্তু দু’বছর পর ১৮৬০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টি থেকে লিংকন ও নর্দান ডেমোক্র্যাট পার্টি থেকে ডগলাস প্রার্থী হলেন তখন তারা পুনর্বার কোন বিতর্কে নামেননি। সে কারণেই সম্ভবত এটিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনী ডিবেটের সূচনা হিসেবে ধরা হয়। এরপর অবশ্য দীর্ঘ ১৫টি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আর কোন তর্কযুদ্ধের আয়োজন করা হয়নি। যথার্থ অর্থে প্রথম সাধারণ প্রেসিডেনশিয়াল বিতর্ক হিসেবে সর্বমহলে স্বীকৃত হয়েছে ১৯৬০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর শিকাগোতে অনুষ্ঠিত ডেমোক্র্যাট প্রার্থী সিনেটর জন এফ কেনেডি এবং রিপাবলিকান প্রার্থী তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের ডিবেটটি। তরুণ সিনেটর কেনেডির প্রখর বুদ্ধিমত্তা, সুতীক্ষè মেধা, আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গি এবং সর্বোপরি সুদর্শন চেহারা ভোটারদের চমৎকৃত করতে সক্ষম হয়। বিপরীত দিকে অভিজ্ঞ রাজনীতিক হলেও এই অনুষ্ঠানে নিক্সনের পারফরম্যান্স ছিল অত্যন্ত নিষ্প্রভ ও হতাশাজনক। সরাসরি টেলিভিশনে প্রদর্শিত এই বিতর্ক ৬৬ মিলিয়ন দর্শক প্রত্যক্ষ করেছিলেন। মনে করিয়ে দেয়া ভাল তখন যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার পরিমাণ ছিল ১৭৯ মিলিয়ন। ইদানীং প্রেসিডেনশিয়াল ডিবেটের আয়োজক কমিশন অন প্রেসিডেনশিয়াল ডিবেটস (সিপিডি)। বড় দুটি দলের সম্মতিক্রমে গঠিত সিপিডির নেতৃত্বে থাকে ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটির সাবেক দুই চেয়ারপার্সন। অবশ্য দু’দল ব্যতীত থার্ড পার্টি ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রার্থীরাও বিতর্কে অংশ নিতে পারেন, যদি তারা ওপিনিয়ন পোলে ১৫% ভোট পেতে সক্ষম হন। এবারের বিতর্কের দিনক্ষণ ও স্থান নির্ধারণ নিয়ে শুরুতে হিলারি ও ট্রাম্প শিবিরের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প সপ্তাহান্ত ছুটির দিন শনি ও রবিবার এবং মার্কিন ফুটবলের মতো জনপ্রিয় খেলার দিন বাদ দিয়ে মঙ্গল বা বুধবার এই ডিবেট করার পক্ষপাতী ছিলেন। কারণ উইকেন্ডে খুব কম সংখ্যক মানুষই টিভি দর্শক হন। আর খেলার দিনগুলোতে দেশজুড়ে সবারই মধ্যে চলে খেলা নিয়ে মাতামাতি। রিপাবলিকানরা মনে করে হিলারি শিবির চাতুর্যতার সঙ্গে বার্নি ও হিলারির প্রাইমারি বিতর্কটি নির্ধারণ করেছিল একটি জনপ্রিয় খেলার দিনেই। ফলে অসংখ্য দর্শক সে অনুষ্ঠান দেখায় বঞ্চিত থেকেছে। অবশ্য হিলারি শিবির তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে এমন অভিযোগ। উপরন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প কোন মডারেটর এবং প্যানেল ছাড়া বিতর্ক করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। ফলে দুই শিবিরের মধ্যে তর্কযুদ্ধ নিয়ে সৃষ্টি হয় এক অচলবস্থা। রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটির চেয়ারপার্সন রিনে প্রিভিসের মধ্যস্থতা সেই জট খুলতে রাজি হওয়ায় অবশেষে ঘটতে যাচ্ছে আকাক্সিক্ষত ডোনাল্ড-হিলারির তর্কযুদ্ধগুলো। তিনটি বিতর্কের মধ্যে প্রথমটি অনুষ্ঠিত হবে ২৬ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের হফস্ট্রা ইউনিভার্সিটিতে, দ্বিতীয়টি ৯ অক্টোবর মিজৌরি স্টেটের সেন্ট লুইসস্থ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে ও ১৯ অক্টোবর সর্বশেষ বিতর্কটির স্থান নির্ধারিত হয়েছে লাসভেগাসের ইউনিভার্সিটি অব নেভাদায়। মার্কিন নির্বাচন নিয়ে আগ্রহী মানুষেরা জানেন গত মাসে বিভিন্ন ন্যাশনাল পোলে সুইং স্টেটসহ লেজে-গোবরে ডোনাল্ডের চেয়ে প্রায় ডাবল ডিজিটে এগিয়েছিলেন হিলারি। কিন্তু ই-মেইল কেলেঙ্কারি, ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের বিপুল পরিমাণ ডোনেশন, লিবিয়ার বেনগাজিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হত্যার দায়ভার এসব ইস্যু যখন পুনর্বার তাকে জড়িয়ে ধরলো আষ্টেপৃষ্ঠে তখন বদল ঘটল চিত্রপটের। ডোনাল্ড উঠে দাঁড়ালেন এবং পরিস্থিতির ক্রমানবতিতে পেছাতে পেছাতে হিলারি চলে গেলেন প্রতিদ্বন্দ্বীর সমপর্যায়ে। রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ সেøাগান তুললেও সেটা তিনি কিভাবে করবেন তা নিয়ে তার কোন সুস্পষ্ট পরিকল্পনা জনগণের সামনে হাজির করতে তো পারেনইনি, বরং নানা ইস্যুতে কটু মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি নিজেকে করে তুলেছেন বিতর্কিত। মার্কিন জেনারেলদের চেয়ে তিনি বেশি জানেন, মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ, মুসলিম নিয়ে বিরূপ মন্তব্য, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ভাল হিসেবে আখ্যায়িত করা ও ট্রাম্প ইউনিভার্সিটি কেলেঙ্কারির মতো বিষযয়গুলো তাকে তাড়া করে ফিরছে এখনও। ফলে ইদানীং অনেক বিষয়ে তাকে নমনীয় হতে দেখা যাচ্ছে। আফ্রিকান-আমেরিকানদের কাছে টানতে এখন তিনি স্বীকার করেছেন প্রেসিডেন্ট ওবামার জন্ম যুক্তরাষ্ট্রে। হিস্পানিক ও অন্যান্য ইমিগ্রান্ট সম্প্রদায়ের বিরূপতা এড়াতে এমন কথাও তিনি এখন বলে বেড়াচ্ছেন যে, মানবিক কারণে সকল অবৈধ ইমিগ্রান্টকে এদেশ থেকে বহিষ্কার করবেন না। সাবেক ফার্স্ট লেডি, সিনেটর ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে যুক্তিতর্কের বিপুল অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। ধীরস্থির হিলারি গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সামনের টিভি বিতর্ক নিয়ে করছেন যথেষ্ট হোমওয়ার্ক। তিনি ব্রিফিং বিষয়ে বইপত্র যেমন পড়ছেন তেমনি প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতিকৃতি স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে মক ডিবেট করে যাচ্ছেন। প্র্যাক্টিসের কারণে ২২ সেপ্টেম্বর থেকে তিনি প্রচারণার জন্য জনসমক্ষে উপস্থিত হবেন না। তুলনামূলকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী রিয়েল এস্টেট মুঘল ও রিয়ালিটি টিভি স্টার ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বলা যায় নবীন। এরপরেও ডিবেট বিষয়ে তিনি কোনরকম প্র্যাক্টিসে যাচ্ছেন না। ট্রাম্প আগেও বলেছেন, শেখানো বুলি বিতর্কে আওড়াতে পছন্দ করেন না। শনিবার পর্যন্ত তিনি ব্যস্ত থাকবেন প্রচার কাজে। শুধু রবিবারে তার পরিবারের সদস্য ও নির্বাচনী উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন। এটা নিয়ে যেমন কিছু মহলে আশঙ্কা রয়েছে তেমনি আশঙ্কা রয়েছে টেম্পেরামেন্টের ব্যাপারে। তিনি দীর্ঘ সময় ধৈর্য ধরে যুক্তিতর্কে টিকে থাকতে পারবেন কিনা সে কারণে অদ্যাবধি কোন মক ডিবেট পর্যন্ত করেননি। তারপরেও তিনি আশাবাদী প্রতিপক্ষের উস্কানি না থাকলে ভালই করবেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্পর্কে যে যাই বলুন, তিনি যে তর্কযুদ্ধে একজন আনাড়ি ব্যক্তি সে কথা কিন্তু বলা যায় না। কারণ ১৭ জন ঝানু রিপাবলিকান সিনেটর, কংগ্রেসম্যান ও গবর্নরকে প্রাইমারি বিতর্কে পরাস্ত করে দলীয় নমিনেশন পেয়েছেন যে ট্রাম্প তাকে বিতর্ক অনুষ্ঠানে দেখার জন্য ২৬ সেপ্টেম্বর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। রাষ্ট্র পরিচালনার মতো শারীরিক সুস্থতা ও স্ট্যামিনা হিলারির নেই বলে বহুদিন ধরে ট্রাম্প অভিযোগ করছেন। এরই ভেতর গত ১১ সেপ্টেম্বর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংস স্মরণ অনুষ্ঠানে হিলারি অসুস্থ হওয়ার পর থেকে এ নিয়ে খোঁচা দেয়ার কোন সুযোগই হাতছাড়া করছেন না ট্রাম্প। গত ২১ সেপ্টেম্বর তারিখে টুইটারে ট্রাম্প লেখেন, ‘হিলারি আবারও একদিনের জন্য ছুটি নিয়েছেন। তার এখন বিশ্রাম দরকার। ভালমতো ঘুমান হিলারি। বিতর্কে দেখা হবে আপনার সঙ্গে।’ লেখক : আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক [email protected]
×