ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মানব পাচারকারীদের শাস্তি হচ্ছে না, নানাভাবে বেরিয়ে যাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬

মানব পাচারকারীদের শাস্তি হচ্ছে না, নানাভাবে বেরিয়ে যাচ্ছে

আরাফাত মুন্না ॥ লেবাননে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ২০০৬ সালের ১৭ নবেম্বর বিভিন্ন জেলার ৩১ নারীকে জড়ো করা হয়েছিল ঢাকার বিমানবন্দরে। ভিসা জাল হওয়ায় ওই নারীদের যাত্রা বাতিলের পাশাপাশি মানব পাচারের চেষ্টার অভিযোগে ওইদিন বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা করে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ। বহুল আলোচিত এ মামলায় ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ তদন্ত শেষে ৫১ আসামির বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশীট দেয় পুলিশ। তবে দুর্বল তদন্ত, বিচারে বিলম্ব, সাক্ষীদের অনুপস্থিতিসহ নানা কারণে একজন আসামির বিরুদ্ধেও অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। গত ১৪ জুলাই চার্জশীটভুক্ত ৫১ আসামির সবাইকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত। কক্সবাজার জেলার টেকনাফের আবু শামা ওরফে বাড়ু হাজির ছেলে ফিরোজ আহমেদ মানব পাচারের অভিযোগে করা চারটি মামলায় পুলিশের তালিকাভুক্ত আসামি। এর মধ্যে ২০১১ সালে করা দুটি মামলায় সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ থাকার পরও খালাস পেয়েছেন ফিরোজ। অন্য দুটি মামলার একটিতে জামিন নিয়ে পলাতক তিনি। এ দুটি ঘটনাই নয়, মানব পাচারের অধিকাংশ মামলায়ই সুুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ গ্রেফতার করলেও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে জামিনে মুক্ত হয়ে যাচ্ছে আসামিরা। জানা গেছে, পরে এসব আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলেও তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার পুলিশ যেসব আসামির বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশীট দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারছেন না রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। বিভিন্ন মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মানব পাচার মামলায় পুলিশ যাদের আটক করছে, তাদের বেশিদিন আটক রাখা যাচ্ছে না। কয়েক মাস যেতে না যেতে জামিনে বের হয়ে যাচ্ছেন তারা। আবার যে মামলার বিচার সম্পন্ন হচ্ছে, সেগুলোতেও আসামিরা খালাস পাচ্ছেন। এতে ন্যায়বিচার বঞ্চিত হচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা। আইনজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রপক্ষের ব্যর্থতার কারণে মানব পাচার মামলায় বিচারের এ দৈন্যদশা। সঠিকভাবে আদালতে সাক্ষী হাজির না করা এবং চার্জশীট হওয়ার পর আসামি ও বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে আপোস-মীমাংসা হচ্ছে। কক্সবাজার জেলা আদালতে বিচারাধীন ৫১টি মামলা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ওই আদালতের ২০টি মামলায় এ মুহূর্তে ২৭ আসামি পলাতক। আসামিদের মধ্যে অনেকেই আটক হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন। এরপর আসামিরা হাজিরা না দেয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ফের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। জামিন নিয়ে পলাতক আসামিরা প্রায় সবাই একাধিক মামলার এজাহার বা চার্জশীটভুক্ত আসামি। এছাড়া এই ৫১টি মামলার মধ্যে ১৭টির বিচার শেষ হলেও সব আসামি অব্যাহতি পেয়েছেন। শুধু কক্সবাজারে ৫১টি মামলার ক্ষেত্রেই এমন চিত্র নয়। যশোর, সাতক্ষীরা, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন মানব পাচারের মামলায় একই রকম ঘটনা ঘটছে। এসব মামলায় শত আসামি গ্রেফতার হলেও আদালতে তা প্রমাণ হচ্ছে না। প্রসিকিউশনের ব্যর্থতা, তদন্তে ত্রুটি, দুর্বল চার্জশীট এবং বিচারপ্রার্থী ও আসামিদের মধ্যে আপোস-মীমাংসার কারণে অধিকাংশ মামলা নিম্ন আদালতেই খারিজ হচ্ছে অথবা আসামিরা খালাস পাচ্ছেন। কক্সবাজারে পলাতক ২৭ আসামি ॥ জেলা আদালতের তথ্য অনুসারে পলাতক আসামিরা হলেন শাহপরীর দ্বীপের ইসমাইল, ফিরোজ আহমেদ, দেলোয়ার হোসেন, শরীফ হোসেন, শাহপরীর দ্বীপের নুর হাকিম, কুচুবুনিয়ার নজির আহমেদ ওরফে নজির ডাকাত, আবদুর হামিদ, কাসেম ওরফে জিমা কাসেম, ইসলাম ওরফে বান্ডু, সাববাংয়ের আক্তার কামাল, ইনানীর রুস্তম মাঝি, পশ্চিম লীদা হ্নীলার নুরুল কবির, শাহপরীর দ্বীপের বেলাল উদ্দিন, মিস্ত্রীপাড়ার নরুল আলম, ঘোলাপাড়ার শামছুল আলম, মাঝেরপাড়ার ছব্বির আহম্মদ, হরিয়াখালীর সাদ্দাম, কাটবনিয়ার নুরুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর প্রমুখ। সাতক্ষীরাসহ সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলায় মানব পাচার রোধে কাজ করে সেন্টার ফর উইমেন এ্যান্ড চিলড্রেন স্টাডিজ। সংগঠনটির সভাপতি অধ্যাপক ইশরাত শামীম বলেন, ‘বিচারের বিলম্বের কারণে গ্রেফতারের পর কয়েক মাস না যেতেই আসামিরা আদালত থেকে আইনী মারপ্যাঁচে জামিনে মুক্ত হয়ে যায়। এরপর আসামিদের একমাত্র লক্ষ্য থাকে মামলাটির চার্জশীট দুর্বল করা বা আপোস-মীমাংসা করে মামলাটিই প্রত্যাহার করা। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আসামিরা সফল হচ্ছে, যে কারণে আদালতে মামলা প্রমাণ হচ্ছে না। এছাড়া পুলিশ বা রাষ্ট্রপক্ষের গাফিলতি তো রয়েছেই।’ বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ফৌজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, যে হারে মানব পাচার হচ্ছে, সে তুলনায় মামলা নগণ্য। তিনি মানব পাচারের ঘটনায় বিচার নিশ্চিত করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবি জানান। ঢাকার আদালতে ৫১ আসামির সবাই খালাস পাওয়া প্রসঙ্গে ওই আদালতের (নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনাল) স্পেশাল পিপি আলী আসগর স্বপন বলেন, সাক্ষীরা আদালতে সাক্ষ্য না দেয়ায় আসামি খালাস পাচ্ছে। আদালত রায়েও তা উল্লেখ করেছেন। তিনি জানান, যে ৩১ নারীকে পাচারের চেষ্টা করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে মাত্র একজন আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এছাড়া ভুয়া ছাড়পত্র জব্দ করার বিষয়ে বলা হলেও তা তদন্ত কর্তৃপক্ষ আদালতে দাখিল করেনি। পুলিশ সদর দফতরের হিসাব অনুসারে, স্বাধীনতার পর থেকে ১২ লাখের বেশি মানুষ পাচার হয়েছে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ১৫ হাজার মানুষ পাচার হয়, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। বিচারে বিলম্ব ॥ মানব পাচার বেড়ে যাওয়ায় ২০১২ সালে মানব পাচার প্রতিরোধ আইন সংশোধন করে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের বিধান যুক্ত করে তৎকালীন সরকার। ওই আইনে মামলায় অভিযোগ গঠনের ১৮০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করার বিধান রয়েছে। অথচ বেশিরভাগ মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করতে পারেনি পুলিশ। অনেক মামলার তদন্তই শেষ হয়নি। আবার সাক্ষী না আসায় অনেক মামলার বিচারকাজও দিনের পর দিন স্থগিত রয়েছে।
×