ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ইউনেস্কোর উদ্বেগের জবাব তৈরি সরকারের

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬

ইউনেস্কোর উদ্বেগের জবাব তৈরি সরকারের

রশিদ মামুন ॥ রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র নিয়ে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর উদ্বেগের জবাব তৈরি করেছে সরকার। ইউনেস্কো মূলত সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কয়লা পরিবহনের বিষয়টি তুলে ধরে বলেছে এতে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে। কিন্তু একই নৌরুট ব্যবহার করছে মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ। পরিসংখ্যান বলছে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মংলা বন্দরে ৪৮২টি জাহাজ নোঙর করেছে। অন্যদিকে রামপালের জন্য সপ্তাহে একটা থেকে দুটো বড় জাহাজ আসবে। সেখান থেকে প্রতিদিন একটি কাভার্ড লাইটার্জে করে কয়লা আনা হবে প্রকল্প এলাকাতে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে একই উদ্বেগের বিষয়ে এর আগেও ইউনেস্কো এবং দেশের পরিবেশবাদীদের আশস্ত করা হয়েছে। কিন্তু তারা কোন কথাই শুনতে না চাওয়ায় খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একই বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। চলতি বছর মার্চে ইউনেস্কোর প্রতিনিধিদল রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রের অবস্থান দেখতে ঢাকা আসেন। ওই সময় ইউনেস্কোর প্রতিনিধিদলে ছিলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিনের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সরদার শফিকুল ইসলাম। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বুধবার তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, তাদের সঙ্গে আমাদের যতটুকু কথা হয়েছে তাতে মনে হয়নি এই প্রকল্পর বিষয়ে তারা নেতিবাচক কিছু চিন্তা করছে। আমাদের কাছে ওই সময় পর্যন্ত ইউনেস্কোর প্রতিনিধিদলকে রামপালের বিষয়ে ইতিবাচক বলে মনে হয়েছে। বিদ্যুত বিভাগ সূত্র বলছে ইউনেস্কো সুনির্দিষ্টভাবে বিদ্যুত কেন্দ্রের কোন কোন বিষয়ে কি ক্ষতি হবে তা উল্লেখ করেনি। বিদ্যুত বিভাগ দাবি করছে দেশের পরিবেশবাদীরা বৈজ্ঞানিক কোন তথ্য ছাড়াই যেভাবে রামপালবিরোধী অবস্থান নিয়েছে ইউনেস্কোও একইভাবে তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে। ইউনেস্কোর প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুত জ্বালানি এবং খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ইউনেস্কো বিদ্যুতকেন্দ্রের কাজসহ পশুর নদ খননের কাজও বন্ধ রাখার অনুরোধ করেছে। পশুর নদ খননের বিষয় আলাদা একটি মন্ত্রণালয় দেখবে। এর সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত। এই মুহূর্তে আমরা কোন কাজ বন্ধ করছি না। তবে ইউনেস্কোর উদ্বেগ দূর করার ব্যবস্থা নিয়েছি। তাদের বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যেই আমরা তাদের সব কিছু অবহিত করব। তিনি বলেন, আমাদের কাছে যে সুনির্দিষ্ট গবেষণা রিপোর্ট রয়েছে তার ভিত্তিতে আমরা মনে করছি বিদ্যুত কেন্দ্রটি পরিবেশের কোন ক্ষতি করবে না। কিন্তু ইউনেস্কো কোন ধরনের গবেষণা না করেই একটি অপেশাদার প্রতিবেদন দিয়েছে। এটি ইউনেস্কোর মতো প্রতিষ্ঠানের কাছে আমরা আশা করিনি। তিনি বলেন, ‘ইউনেস্কোর প্রতিনিধিদল সুন্দরবনে গিয়েছিল। আমরা আশা করেছিলাম, তারা টেকনিক্যাল বিষয়গুলো নিয়ে বলবে। যেমন কয়লা পরিবহন হলে ঠিক কি পরিমাণ কয়লা নদীতে মিশতে পারে, এতে নদীর পানির ঠিক কী কী পরিবর্তন হতে পারে, কিংবা কেন্দ্রর কারণে কী পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হবে আর তাতে সুন্দরবনের কী কী ক্ষতি হতে পারে। ইউনেস্কোর প্রতিবেদনে এ ধরনের কোন বিষয়ে নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। তারা যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করেছে তা এই বিদ্যুতকেন্দ্র বিরোধী আন্দোলনকারীদেরও। এসব বিষয়ে আমরা সব সময় কথা বলছি। আমরা আমাদের অবস্থান বারবার পরিষ্কার করছি। সূত্র বলছে, গত ১ ফেব্রুয়ারি পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন বাপা আর সুন্দরবন রক্ষা কমিটিসহ কয়েকটি সংগঠন ইউনেস্কোর কাছে একটি চিঠি লেখে। সেখানে রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রের ক্ষতিকর বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়। ওই চিঠির মূল বিষয় ছিল সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নৌ রুটটি। ওই চিঠিতে সুন্দরবনের ভেতরের নৌরুটে তেলের জাহাজ ডুবে যাওয়ার ছবিও পাঠানো হয়। ৩১ পৃষ্ঠার ওই চিঠিতে রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র বাতিলের পক্ষে ইউনেস্কোকে অবস্থান নেয়ার অনুরোধ জানানো হয়। এছাড়াও পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতারা বিভিন্ন সময় স্কাইপে, মেইলে ইউনেস্কোর সঙ্গে যোগাযোগ করে। ইউনেস্কোকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয় বাংলাদেশের একটি বড় অংশ রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রের বিরোধিতা করছে। দেশের মানুষ চায় না। রামপালে বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মাণ হোক। বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ কোম্পানি সূত্র জানায়, মংলা থেকে রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার ক্যাপিটাল ড্রেজিং করা হবে। নতুন এই রুটের দুই পাড়ে মংলা এবং চালনা উপজেলা। পশুর নদীর ডান পাশে এই নৌরুটটি। গ্রামে মানুষের বসতির ভেতর দিয়ে প্রবাহিত। এখানে কোন জায়গাতে সুন্দরবন নেই। মংলা বন্দর থেকে সুন্দরবনের দূরত্ব ৭ কিলোমিটার। কোম্পানিটি বলছে ১৪ কিলোমিটার নৌরুট খনন করে দেবে মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ। তবে বিদ্যুত কেন্দ্রে যখন কয়লা প্রয়োজন হবে তার আগে খনন শুরু করা হবে। একনেক এই প্রকল্প অনুমোদন করেছে। এর বাইরে মংলা বন্দর যে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করছে তার সঙ্গে রামপালের আপাতত কোন সম্পর্ক নেই। জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ইউনেস্কো যে চিঠি দিয়েছে সেখানেও বলা হয়েছে এটি বাংলাদেশের পরিবেশবাদীদের আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা তাদের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য আশা করছিলাম। তিনি বলেন, আমরা সবগুলো বিষয়ে আমাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বক্তব্য তৈরি করছি। পরিববেশ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ইউনেস্কোর কাছে পাঠানো হবে। প্রসঙ্গত রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রটির নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখতে সরকারকে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেয় ইউনেস্কো। ৫০ পৃষ্ঠার ওই চিঠিতে নিরপেক্ষ সংস্থা দিয়ে পরিবেশের চূড়ান্ত সমীক্ষা বা ইআইএ না করার আগ পর্যন্ত রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রের কাজ বন্ধ রাখার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এছাড়া পশুর নদ খননের কাজও এ সময় বন্ধ রাখার অনুরোধ জানানো হয়। সেই সঙ্গে বিদ্যুত কেন্দ্রটি অন্যত্র সরিয়ে নিতে বলছে তারা। এদিকে রামপাল বিদ্বেষের চেয়ে দেশে ভারত বিরোধিতা বড় হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মাণ শুরুর ক্ষণ এগিয়ে আসায় ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসি, বিদ্যুতের দর, ভারতের কয়লা বিক্রি, ভারতের ঋণের সমালোচনাও মুখর হয়েছে বিরোধিতাকারীরা। ফলে শুরুতে বিদ্যুত কেন্দ্রটির জন্য পরিবেশের ক্ষতির বিষয়টি এখন আর পরিবেশের মধ্যে আটকে নেই। সরকারবিরোধী একটি অংশ নতুন এই বিতর্কের সূচনা করছে। এসব বিষয় নিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন একটি সংবাদ সম্মেলন করে পরিবেশবাদীদের সমর্থন জানিয়েছেন।
×