ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রাম্পের গোমর ফাঁস

প্রকাশিত: ০৭:১১, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৬

ট্রাম্পের গোমর ফাঁস

বেআইনী অভিবাসীদের নিয়ে ট্রাম্পের বিষোদগারের শেষ নেই। ক্ষমতায় এলে তিনি এদের সবাইকে দেশ থেকে বের করে দেবেন বলে হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু এই বেআইনী অভিবাসীদেরই তিনি নিজে আবার সস্তা শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তাদের অনেককে তিনি ঠিকমতো পারিশ্রমিকও দেননি যার জন্য ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছিল। সেটা ১৯৮০ সালের গ্রীষ্মের কথা। তখন ম্যানহাটানে একটি পুরনো ইমারত ভেঙ্গে জায়গাটা সাফসুরত করে আজকের বিখ্যাত ট্রাম্প টাওয়ার নির্মাণ করা হচ্ছিল। এ ভাঙ্গাভাঙ্গির কাজে ও ভাঙ্গা ইট, সুরকি ও লোহা অপসারণে পোল্যান্ডের বেআইনী অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়োগ করা হয়েছিল। ট্রাম্প তা ভালভাবেই জানতেন। সস্তা শ্রমে ভাঙ্গার কাজ সারার জন্যই পোলিশ শ্রমিকদের লাগানো হয়েছিল। সিনেটর মার্কো রুবিও এ বছর রিপাবলিকান প্রাইমারী এক বিতর্কে তথ্যটি ফাঁস করে দেন। ট্রাম্প অবশ্য নিজে সাফাই গাইতে গিয়ে বলেন ‘আমি তো ও কাজে ঠিকাদার নিয়োগ করেছিলাম। ঠিকাদার কাদের দিয়ে ভাঙ্গার কাজ করিয়েছে কিভাবে জানব। তাছাড়া ৩৫ বছর আগের কথা। এত কিছু তো মনে থাকার কথা নয়।’ ট্রাম্প মনে না থাকার দোহাই পারতে পারেন। কিন্তু সেই মামলার হাজার হাজার পৃষ্ঠার নথিপত্র তো আছে সাক্ষীদের সাক্ষ্য আছে। সেগুলো ঘেঁটে টাইম ম্যাগাজিনের রিপোর্টাররা ভিন্ন এক কাহিনী বের করেছেন। তারা দেখিয়েছেন যে ট্রাম্প পুরনো ইমারত ভাঙ্গার কাজে কৌশলে পোলদের কম মজুরিতে খাটিয়েছিলেন। অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে তার ট্রাম্প টাওয়ারটাও বিধিসম্মত ছিল না এবং সেখানেও অন্যায় কলাকৌশল খাটানো হয়েছিল। ১৯৭৯ সালে তিনি ম্যানহাটানের ফিফ্থ এ্যাভিনিউর পুরনো বনউইট টেলার ভবনটির লিজ কৌশলে হাতিয়ে নেন এবং সে জায়গায় নগরীর উচ্চতম গ্লাস কাঠামো ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেন। এক্ষেত্রে এলাকাগত বিধিনিষেধ থাকায় ট্রাম্প রাজনীতিকদের মোটা অঙ্কের চাঁদা দিয়ে হাত করেন এবং নিউইয়র্ক বোর্ডের প্রভাবশালী সদস্যদের আনুকূল্য কিনে নেন। এইভাবে গ্লাসকাঠামোর টাওয়ার নির্মাণের অনুমোদন ম্যানেজ করে নিয়ে ট্রাম্প ভবন নির্মাণে নেমে পড়েন। ১৯৭৯ সালের শেষদিকে অন্য এক জায়গায় সংস্কার কাজ দেখতে গিয়ে তিনি পোল শ্রমিকদের কাজ করতে দেখেন। আদালতের সংরক্ষিত নথিপত্র অনুযায়ী তিনি কঠোর পরিশ্রমী এই পোল শ্রমিকদের বস উইলিয়াম কাসজাইগিকে ফিফ্থ এ্যাভিনিউতে নিজের বিলাসবহুল অফিসে ডেকে আনেন। কাসজাইকির কোম্পানি জানালা এবং কর্মস্থল এলাকা পরিষ্কার করার কাজে দক্ষ ছিল। ম্যানহাটানের মতো নগরীর কেন্দ্রস্থলে ১২ তলা ভবন ভাঙ্গার মতো ভারি কাজ তারা কখনও করেনি। ট্রাম্প সেই কাসজাইকিকে তার লিজ নেয়া ১২ তলা পুরনো ভবনটি ভাঙ্গার অফার দেন। এজন্য এক নতুন কোম্পানি গঠন করতে বলেন সেখানে এই ভাঙ্গার কাজের জন্য নতুন ও ভিন্ন ধরনের বীমার ব্যবস্থা থাকবে। আদালতে প্রদত্ত সাক্ষ্যে কাসজাইকি তখন জানিয়েছিলেন যে ভবন ভাঙ্গার জন্য তিনি ট্রাম্পের কাছ থেকে পৌনে আট লাখ ডলারের ফি গ্রহণ করেছিলেন। ভবন দ্রুত ভেঙ্গে ফেলা হলে তাকে আরও ২৫ হাজার ডলার দেয়ার অফারও ট্রাম্পের তরফ থেকে ছিল। কাসজাইকি তাকে কথা দিয়েছিলেন যে, পোলরা সপ্তাহে সাতদিনই দিনরাত কাজ করবে। এবং সত্যিই তারা তা করেছিলেন। সকাল-সন্ধ্যা ও সন্ধ্যা-সকাল এই দুই শিফটে কাজ করেছিলেন। কেউ কেউ আবার সাক্ষ্য দিয়েছিলেন যে তারা ২৪ ঘণ্টার শিফটেও কাজ করেছেন। ঘণ্টায় তাদের ৪ থেকে ৫ ডলার দেয়া হতো। সে সময় সেটা ছিল প্রচলিত ইউনিয়ন শ্রমিকদের মজুরির অর্ধেকেরও কম। এবং রাষ্ট্রচালিত ন্যূনতম মজুরির সামান্য উপরে। ভাঙ্গার কাজটা ছিল বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ এবং শ্রমিকদের কোন নিরাপত্তা সরঞ্জামও ছিল না। কিন্তু এসব বিষয় নয় বরং টাকা পয়সা নিয়েই গোল বেধিছিল। এবং ট্রাম্প মস্ত সমস্যায় পড়েছিলেন। অনিবন্ধিত পেলদের এত অল্প মজুরিতে কাজ করানো নিয়ে জন সাজানো নামে এক আইনজীবী তাদের পক্ষে লড়াই শুরু করেন। তিনি ট্রাম্পকে লিগ্যাল নোটিস পাঠিয়ে বলেন যে তার ক্লায়েন্টদের। ঠিকমতো মজুরি দিতে হবে নইলে তিনি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কঠিন আইনগত ব্যবস্থা নেবেন। বাধ্য হয়ে ট্রাম্পকে ইস্যুটির মোকাবেলা করতে হয়। সে বছরের এক কথায় তিনি তার ভবন ভাঙ্গার শ্রমিকদের কয়েকজনের সঙ্গে বসেন এবং জানতে পারেন যে কাসজাইকি কাজে আসছে না ফলে শ্রমিকরাও মজুরি পাচ্ছেন না। এ নিয়ে পোলরা রীতিমতো ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ট্রাম্প তখন তাদের বলেন যে কাসজাইকি যদি একেবারেই এ কাজটা ছেড়ে দেয় তাহলে তিনি নিজেই শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধ করবেন। প্রথম প্রথম তিনি কথাও রেখেছিলেন একটা ব্যাংক এ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সে কাজটা করা হতো। পরে মজুরি দেয়া অনিয়মিত ও অসামাঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। তখন পোলারদের আইনজীবী সাজানো ট্রাম্পকে ‘মেকানিকস লিয়েন’ প্রদান করেন। এটা একটা আইনী অস্ত্র যার বলে একজন শ্রমিকের সে যে সম্পত্তির ওপর কাজ করেছিলেন তার স্বত্বের ওপর আংশিক অধিকার এসে যায়। আরও খারাপ খবর হলো শ্রমিকরা মারপিট করার হুমকি দিতে থাকে। এ অবস্থায় শ্রম উপদেষ্টার পরামর্শে ট্রাম্প পোল শ্রমিকদের সবাইকে ছাঁটাই করে দিয়ে শুধু ইউনিয়ন শ্রমিকদের দ্বারা ভবন ভাঙ্গার পদক্ষেপের দিকে এগোতে থাকেন। এবার পোলরা প্রমাদ গুনে যে তাদের প্রাপ্য অর্থ তারা আর কখনই ফেরত পাবে না। তাদের আইনজীবী তখন ট্রাম্পের নামে সম্পত্তির ওপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় লিয়েন ইস্যু করেন যার অর্থ দাঁড়ায় পোল শ্রমিকদের প্রাপ্য মজুরি শোধ না করা পর্যন্ত ট্রাম্প তার টাওয়ারের কোন অংশ বিক্রি করতে পারবেন না। ট্রাম্প এবার নতুন চাল চালেন। তিনি হুমকি দেন যে পোল শ্রমিকরা যেহেতু বেআইনী অভিবাসী তাই তাদেরকে দেশ থেকে বের করে দেয়ার জন্য তিনি ইমিগ্রেশন বিভাগকে অনুরোধ জানাবেন। এ অবস্থায় পোলদের পিছু হটা ছাড়া আর উপায় ছিল না। নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য গরিব মানুষদের শ্রমকে আত্মসাত করার এক ন্যক্কারজনক ঘটনার এভাবে জন্ম দিয়েছিলেন ট্রাম্প। সূত্র : টাইম
×