ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ফুটবলের সন্ধ্যাতারা জসীম উদ্দিন জোশি

প্রকাশিত: ০৬:৫৬, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৬

ফুটবলের সন্ধ্যাতারা জসীম উদ্দিন জোশি

কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণের পর প্রতিটা মানুষের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি একটা আলাদা অনুভূতির জন্ম হয়। সেই অনুভূতি থেকে ভাললাগা তারপর সেটা রূপ নেয় ভালবাসায়। খুলনার দৌলতপুরের রেলগেটের মাঠে ফুটবল খেলা সেই ছেলেটির কৈশোর থেকেই অনুভূতিটা ছিল অন্যখানে। সাদাকালো রঙের সঙ্গে মিশে যাওয়া মোহামেডান ক্লাবের প্রতি শুরু হয়ে যায় ভাললাগা তারপর ভালবাসা। দেশের হয়ে আর সাদাকালো জার্সি গায়ে মোহামেডানের হয়ে মাঠ কাঁপাবেন। এমন স্বপ্ন নিয়েই চলতে থাকে তার কঠোর অনুশীলন। অবশেষে তার সেই স্বপ্ন পূরণও হয়। ঠিকই দেশের এবং সাদাকালো জার্সি গায়ে চেপে প্রিয় ক্লাব মোহামেডানের হয়ে মাঠ মাতিয়েছেন। মন জয় করেছিলেন দেশের ফুটবল প্রেমীদের। সমর্থকরা তাকে আজও স্মরণ করেন। তিনি কাজী জসীম উদ্দিন জোশি। ফুটবল অঙ্গনে যিনি জোশি হিসেবেই পরিচিত। জোশির জন্ম খুলনা জেলায়। পুরো পরিবার ছিল খেলাধুলার সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেই সুবাদে খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ অন্যদের কাছ থেকে খুব একটা বাধাগ্রস্ত হয়নি। স্কুলের মাঠ থেকে পাড়া-মহল্লার মাঠে ফুটবল খেলেছেন দাপিয়ে। ছোটবেলা থেকেই বল নিয়ে ড্রিবলিং করার কারিস্মা সবার নজরে পড়ে। স্থানীয় ফুটবল বোদ্ধারা সেই থেকেই আঁচ করেছিলেন একদিন বড় মাপের ফুটবল খেলোয়াড় হবে এই জোশি। তাদের ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করেননি। সাবেক এই ফুটবলার ও বর্তমানে মোহামেডানের কোচের দায়িত্বে থাকা জোশির সঙ্গে আলাপচারিতা তুলে ধরা হলোÑ * মোহামেডানের সঙ্গে কিভাবে নিজেকে জড়ালেন? এমন প্রশ্নে তিনি হাসি দিয়ে জানান ছোটবেলা থেকেই সাদাকালো আর মোহামেডানের প্রতি দুর্বল ছিলাম। ১৯৮০ সালে ঢাকা মোহামেডান ক্লাব একবার খুলনায় এসেছিল বন্যার্থদের সাহাযার্থে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে। খুলনা জেলা দলে আমার জায়গা হয়। তবে দল আমার মতো এত জুনিয়র খেলোয়াড়কে মাঠে নামিয়ে প্রথমে ঝুঁকি নিতে চাননি। আমাকে নামানো হয় দ্বিতীয়ার্ধে। সবার মতে আমি লেফট উইঙ্গে নাকি দারুণ খেলেছিলাম। ঢাকার বেশ কয়েকটি ক্লাব আমাকে খেলার আমন্ত্রণ জানানোর পাশাপাশি মোহামেডানের কোচ টিপু ভাইও আমাকে পরের মৌসুমেই মোহামেডানের পক্ষে খেলার আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু খুলনার ওস্তাদ মনু ভাই চেয়েছিলেন আমি আবাহনীতে খেলি। আমি একটু দোটানায় পড়ে যাই। একদিকে সাদাকালোর প্রেম অন্যদিকে ওস্তাদ মনু ভাই। আবাহনীতে তখন দুর্র্ধর্ষ লেফট উইঙ্গার ছিলেন আশরাফ উদ্দিন। আমি হিসাব কষে দেখলাম চুন্নু ভাই থাকা অবস্থায় আমি মূল একাদশে হয়ত নিয়মিত খেলার সুযোগ পাব না। সবদিক বিবেচনা করে মোহামেডান শিবিরেই যোগ দেয়ার জন্য মন স্থির করে ফেলি। জোশি ১৯৮১ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত মোহামেডানেই ছিলেন। মাঝখানে ১৯৮৫ সালে ইনজুরিতে পড়লে ৮৬ সাল পুরোটাই বসে থাকতে হয়। ৮৮ সালে নিয়মের গ্যাঁড়াকলে পড়ে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মোহামেডান সমর্থকদের কাঁদিয়ে চলে যান আগ্রণী ব্যাংকে। ৯০ সালে ব্রাদার্সে যোগ দিয়ে ৯১ সালে আবারও প্রিয় ক্লাব মোহামেডানে যোগ দেন। * আবাহনীর বিরুদ্ধে আপনার সেরা ম্যাচ কোনটি? ১৯৮৩ সালের ফেডারেশন কাপ ফাইনাল। মোহামেডান তখন ১-০ গোলে এগিয়ে আছে। খেলার ৩৫ মিনিটের সময় লেফট হাফ পসজিসন থেকে বল ধরে তীব্র গতিতে এগিয়ে চলি। আমার মনে আছে পাকির আলী আর টুটুল এই দুই জাঁদরেল ডিফেন্ডার কে ডজ দিয়ে আবাহনীর বক্সে ঢুকে পড়ি। তারপর ঠা-া মাথায় বাঁ পায়ের তীব্র শটে গোল করে বিজয় সুনিশ্চিত করি। সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিম গ্যালারির গগনবিদারি চিৎকার যেন আজও কানে বাজে। * একটা সময় বলা হতো আবাহনীর ত্রাস জোশি, শুনতে কেমন লাগত? হাসি দিয়ে বলেন, অবশ্যই ভাল লাগত। মোহামেডান আবাহনীর ম্যাচ মানেই বাড়তি উত্তেজনা । এ বিষয়ে গোলাম হাফিজ ভাইয়ের কথা খুব মনে পড়ে। আমার প্রথম মোহামেডান আবাহনীর খেলার আগের দিন তিনি বলেছিলেন ‘অন্য দলের সঙ্গে কে কেমন খেলল সেটা মনে রাখার বিষয় নয় কিন্তু মোহামেডান আবাহনীর ম্যাচে কে কেমন খেলল সেটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’ ‘সেই থেকেই আমি অন্য দলের বিরুদ্ধে যাই খেলি না কেন আবাহনীর দিন জীবন দিয়েই খেলতাম। ৮৩-৮৪ এই দুই বছর এই দুই দলের মোকাবেলায় আমি পর পর চার ম্যাচেই গোল পেয়ে যাই। সেই থেকেই সমর্থকরা আমাকে আবাহনীর ত্রাস বলত।’ ১৯৮২ সালে জোশি ঢাকায় প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপ টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ সবুজ দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। ৮৩ সালে জাতীয় দলের হয়ে মারদেকা টুর্নামেন্ট খেলেছেন। ৮৫ সালে ইনজুরির কারণে জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েন। আবার ১৯৮৭ সালে জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পান। * আপনাদের সময়ের ফুটবলে তেমন টাকা ছিল না আর এখনকার ফুটবলে অনেক টাকা এটাকে কিভাবে দেখেন? জোশি খুব সাবলীলভাবে উত্তর দেন ‘তখনকার ফুটবলে হয়ত টাকা ছিল না কিন্তু ভালবাসা ছিল আর এখনকার ফুটবলে টাকা আছে কিন্তু ভালবাসা নেই।’ * একটু খোলাসা করে যদি বলতেন? ১৯৮৫ সালের ঘটনা। মোহামেডান ওয়ারির খেলা। ওই ম্যাচটা শামসুল আলম মঞ্জু ভাইয়ের অবসরের ম্যাচ। তখন আমার ফর্ম পুরা তুঙ্গে। এদিকে সালাম মুর্শেদি ভাই গোল খরায় ভুগছেন। একপর্যায়ে আমি বল নিয়ে দুই তিনজনকে কাটিয়ে ডি বক্সে ঢুকে গেছি। মুহূর্তেই স্থির করে ফেললাম সালাম ভাইকে দিয়ে গোলটা করাই। সালাম ভাইয়ের জন্য দু’এক সেকেন্ড জাস্ট অপেক্ষা করেছি। এর মাঝে ওয়ারীর শাজাহান ভাই এসেই আমাকে রাফ চার্জ করেন। মুহূর্তের মধ্যেই আমার হাঁটুর নিচের অংশ পুরোপুরি ঘুরে যায়। আমি মাটিতে পড়ে যাই। মাঠ থেকে ক্লাবে আসি। সেখান থেকে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। ক্লাবের গেটের কাছে তিনটা গাড়ি দাঁড়ানো। খেলা তখনও চলছিল বিধায় ওই তিন গাড়ির কোন ড্রাইভারই ছিল না। অগত্যা আমার সঙ্গে বেরিয়ে আসা সমর্থকরা গেটের সামনের গাড়িগুলো উঁচু করে ধরে সরিয়ে দেয়। আমার দুচোখ বেয়ে যে অশ্রু বয়েছিল তা আমার পায়ের ব্যথার জন্য নয় সেটা সমর্থকদের ভালবাসার বহির্প্রকাশ ছিল মাত্র। তাছাড়া পাড়া-মহল্লায় মসজিদে-মসজিদে আমার জন্য দোয়া হয়েছিল। এই ভালবাসা আমি কোটি টাকার বিনিময়েও পাব না। এই ভালবাসা শুধু যে মাত্র আমার জন্য ছিল তা কিন্তু নয়। দুই দলের খেলোয়াড়দের জন্য এ রকম অহরহ দেখা গেছে। বর্তমানে ফুটবলে কি এমন ভালবাসার নজির আছে? * আপনার মূল প্রতিপক্ষ আবাহনী থেকে কোন অফার আসেনি তখন? হ্যাঁ এসেছিল। কিন্তু টাকার মোহ আমাকে কখনই মোহামেডান থেকে টলাতে পারেনি। * ইনজুরির পর আবার কখন মাঠে ফিরে আসেন? সেটা ১৯৮৭ সালে। ১৯৮৭ সালের আর্মি স্টেডিয়ামের ম্যাচটি ছিল মোহামেডান আবাহনীর জীবনের শেষ ম্যাচ। পরবর্তীতে অগ্রণী ব্যাংক আর ব্রাদার্সে তিন বছর খেলে আবার ৯১ সালে মোহামেডানে এসে আমার খেলোয়াড়ি জীবনের অধ্যায় শেষ করি। * মোহামেডানে খেলেছেন আবার মোহামেডান দলের প্রশিক্ষক, কেমন লাগে? হাসি দিয়ে বলেন, যখন খেলাতাম তখন সমর্থকদের ভালবাসা পেয়েছি একতরফা। আর এখন মাঝে মাঝে ভালবাসার পাশাপাশি গালাগালিও শুনতে হয় (হেসে)। উল্লেখ্য, জোশি ১৯৯৯ সালে মোহামেডানের মূল কোচ হাসানুজ্জামান বাবলুর সঙ্গে সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । পরে ২০০৫ সালে মূল কোচের দায়িত্ব নেন। সেবার মোহামেডান রানার্স আপ হয়। ২০০৯ সালে বিয়ানীবাজার দলের কোচের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালে মোহামেডানের অনুর্ধ ১৬ এবং পরের বছর অনুর্ধ ১৮ দলের দায়িত্ব পালন করে দলকে চ্যাম্পিয়ন করান। ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে মোহামেডানের মূল দলের দায়িত্বে আছেন। * সমর্থকদের একটা অভিযোগ হলো আপনি সিনিয়র খেলোয়াড়দের মাঠে নামান না, কথাটা কি সত্যি? প্রথমত কথা হচ্ছেÑ আমি নিজেই একজন মোহামেডান ভক্ত। আমি সমর্থকদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি বিশ্বে এমন কোন কোচ কি আছেন যিনি তার নিজের ক্যারিয়ারের কথা ভাবেন না? সমর্থকরা গ্যালারিতে বসে খেলা দেখেন আর কোচরা প্রশিক্ষণ দেন তাদের সান্নিদ্ধে থেকে। একজন কোচ কখনই চান না ভাল কোন খেলোয়াড়কে বসিয়ে খারাপকে খেলাতে। * মোহামেডান আর ছোট দলগুলোতে একই মাপের খেলোয়াড়, কিন্তু মোহামেডান মোটেও সুবিধা করতে পারছে না কেন? ছোট দলগুলোতে যেসব খেলোয়াড়রা আছে তারা গত বছর লীগের নিয়মিত একাদশে ছিল। যার কারণে তাদের ধারাবাহিকতাটা থেকে গেছে। আমার দলে এখানে একটু ঘাটতি আছে। তাছাড়া আমরা তিনটা খেলায় সুবিধাজনক অবস্থায় থেকে ম্যাচ ড্র করেছি। সেই খেলাগুলোতে একটা ভাল পয়েন্ট পেলে দলের পজিশন অন্যরকম হতো। আশা করি আগামী ম্যাচ থেকে আমার দল আর ভাল খেলবে। * আপনার পজিশনে আপনি কাকে একজন সফল উইঙ্গার হিসেবে দেখেন? অবশ্যই আশরাফ উদ্দিন চুন্নু ভাই। আমার জীবনে খুব ইচ্ছে ছিল চুন্নু ভাইয়ের মতো খেলোয়াড় হওয়া। চুন্নু ভাই জায়গায় দাঁড়িয়ে যে ডজ দিতেন তা ছিল দেখার মতো। এমন কুশলী ফুটবলার বাংলাদেশে আর দেখা যায় না। * বাংলাদেশ মালদ্বীপের কাছে ৫-০ গোলের ব্যবধানে হারল, এই বিষয়টা কিভাবে দেখছেন? আমি কেন কেউই ভালভাবে দেখছে না। যেখানে আগে আমাদের দেশের ক্লাবগুলো এই ভুটান মালদ্বীপ নেপালের ক্লাবকে হালি হালি গোল দিয়েছে সেখানে উল্টো আমদের জাতীয় দল তাদের কাছে বিশাল ব্যবধানে পরাজয়বরণ করছে। ভাবতেই কষ্ট লাগে। * এ থেকে উত্তরণের উপায় কি? দেখেন কারও কাছে কিন্তু জাদুর কাঠি নেই। হুট করে কখনই কোন ভাল ফলাফল আশা করা যায় না। সাফল্য পেতে হলে আপনাকে অবশ্যই একটা প্লানমাফিক এগোতে হবে। খেলোয়াড় তৈরির দিকে মনোযোগী হতে হবে। বিশেষ করে দেশে বিভিন্ন এজ গ্রুপভিত্তিক দল বানিয়ে দীর্ঘমেয়াদী ভাল প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। জোশি ১৯৯০ সালে সালেহা পারভীন মালার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মেয়ে কাজী জুবাইদা আহমেদ মীম’মা ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ পড়ছে। কাজী সাজিদ আহমেদ সিটি কলেজে প্রথম বর্ষে। আকাশের সন্ধ্যা তারার সময়কাল খুব অল্প। জোশির ফুটবল ক্যারিয়ার সেই সন্ধ্যা তারার মতোই। তবে তিনি এই অল্প সময়েই জাতীয় দল তথা ক্লাবের হয়ে পূর্ণিমার চাঁদের মতোই আলো ছড়িয়েছেন দীর্ঘক্ষণ। যে কোন সময়ই ক্লাব থেকে বিদায় নিতে চান হাসিমুখে। যদি অন্যান্য কোচের মতো পরিস্থিতিতে পড়তে হয় তবে তা হবে বেদনাদায়ক। সত্যিই যদি তাই হয় তবে মোহামেডানপ্রেমী কাজী জসীম উদ্দিন জোশিকে নিভৃতে মেনে নিতে হবে শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসের সেই বিখ্যাত উক্তিটি ‘বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না বরং দূরেও ঠেলিয়া দেয়।
×