ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মূলঃ ড. পারভেজ হুদভয়;###;অনুবাদক ঃ মাহমুদ হাসান

মীর কাশেমদের ফাঁসি পাকিস্তান কেন মর্মাহত!

প্রকাশিত: ০৬:২১, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৬

মীর কাশেমদের ফাঁসি পাকিস্তান কেন মর্মাহত!

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দফতর থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশে মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদণ্ডে পাকিস্তান ‘গভীরভাবে মর্মাহত’। বাংলাদেশের আদালত অত্যাচার, গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগের জন্য অপরাধী সাব্যস্ত করে মীর কাশেম আলীকে ২০১৩ সালে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে, যাকে পাকিস্তান ‘ভুল বিচার পদ্ধতি’ বলেছে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার নৈতিকতায় পাকিস্তানের মাথাব্যথা কেন? অমানবিক অপরাধের শাস্তির পর অন্য একটি দেশের নাগরিকের মৃত্যুদণ্ডে পাকিস্তান সরকারের কেন এই উৎকণ্ঠা? এর উত্তর মীর কাশেম আলীর প্রতি পাকিস্তানের এই মনোভাবকে মানবিকতার মানদণ্ডের খাতিরে আড়াল করা সম্ভব নয়। কারণ আরও অনেক দেশে অনেক নাগরিকের মৃত্যুদণ্ড হয়ে আসছে; কিন্তু সেইসব মারাত্মক অপরাধীকে নিয়ে পাকিস্তানের সুশীল সমাজ কিংবা সেনাবাহিনীর বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ ওঠেনি। এমনকি বিদেশের মাটিতে পাকিস্তানের নাগরিকদের মৃত্যুদণ্ডেও পাকিস্তান একেবারেই নিশ্চুপ। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ মাদক পাচারের অপরাধে সৌদি আরবে ক্যাঙ্গার কোর্টে অনেক পাকিস্তানী নাগরিকের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থন না করে পাকিস্তানের উচিত বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা ও সিদ্ধতা সম্পর্কে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ আরও কিছু মানবাধিকার সংগঠন উদ্বিগ্ন ও সন্দিহান ছিল। তাদের বক্তব্য, আসামিপক্ষের উকিলদের পর্যাপ্ত সময় দেয়া হয়নি এবং অযৌক্তিকভাবে আসামিপক্ষের সাক্ষীদের সংখ্যা সীমিত করা হয়। কিন্তু পাকিস্তানের নিজস্ব বিচার ব্যবস্থা যেখানে আরও সমস্যাসঙ্কুল সেখানে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে পাকিস্তানের অভিযোগ অশোভন এবং অযৌক্তিক। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যেখানে বেসামরিক আদালতে সংঘটিত হলো, সেখানে পাকিস্তানে দেশদ্রোহীদের বিচার করা হলো লোকচক্ষুর আড়ালে সামরিক আদালতে। উপরন্তু, এই আসামিদের ইচ্ছানুযায়ী উকিল নিযুক্ত এবং সামরিক আদালতের তথ্য কিংবা দলিল সম্পর্কে অবহিত হওয়ার কোন প্রকার সুযোগ তাদের দেয়া হয়নি। পাকিস্তানের এই বিচার প্রক্রিয়া বর্তমানের বিচার ব্যবস্থার নীতির প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যহীন। মীর কাশেম আলীর বিচার প্রক্রিয়া এবং মৃত্যুদণ্ড পাকিস্তানের উদ্বেগের একমাত্র কারণ তিনি ছিলেন পাকিস্তানের দোসর আল-বদর বাহিনীর প্রধান। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের হিংস্র সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আল-শামস বাহিনীও রাজাকার বাহিনীর পাশাপাশি আল-বদর বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে হাত মেলায়। তাদের প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ প্রমাণ করে পাকিস্তান ভেঙ্গে জন্ম হয় স্বাধীন বাংলাদেশের। মীর কাশেম আলীই শুধু নয়, ২০১৩ সাল থেকে শুরু করে তার আগে আরও পাঁচজন বিখ্যাত যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও মৃত্যুদণ্ড হয় বাংলাদেশে। তারা যা কিছুই করে থাকুক প্রতিবারই পাকিস্তান দ্বিজাতিতত্ত্বের সমর্থক এই যুদ্ধাপরাধীদের পাশে দাঁড়ানোকে কর্তব্য বলে মনে করেছে। স্কুল জীবনে পাঠ্যপুস্তক থেকে আমি জেনেছিলাম, ইতিহাসে এই দ্বিজাতিতত্ত্ব ছিল পাকিস্তানের জন্ম-ভিত্তি। এই তত্ত্ব দুটি বিষয়ের ওপরে নির্ভরশীল। প্রথম, হিন্দু ও মুসলমান মৌলিকভাবেই আলাদা, তারা সহাবস্থান করতে পারে না। সুতরাং তাদের আলাদা বসবাসের প্রয়োজন। এই কারণেই মুসলমানদের আবাসভূমি হিসেবে পাকিস্তান দরকার। দ্বিতীয়ত, সকল মুসলমান এক উম্মাহ এবং ভাই ভাই। একটি জাতি হিসেবে টিকে থাকার জন্য ভাষা, সংস্কৃতি, সম্প্রদায় কিংবা দলগত পার্থক্য তাদের জন্য কোন সমস্যাই নয়। এই মতবাদের প্রথম বিষয় নিয়ে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। কারণ ভারত ও পাকিস্তান দুটি স্বতন্ত্র দেশ হিসেবে নিজ নিজ অবস্থান সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে। বর্তমানে পাকিস্তানে হিন্দু সম্প্রদায় জনগণের এক বা দুই শতাংশ এবং এ সংখ্যা দিনে দিনে কমে আসছে। রাষ্ট্রের ওপরে ভীতসন্ত্রস্ত এই ছোট্ট জনগোষ্ঠীর কোন প্রভাব নেই। দ্বিতীয় বিষয়টিকে ১৯৭১ সালের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করা প্রয়োজন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে আল-কায়েদা, টিটিপি, আইসিস জাতীয় কিছু জিহাদী দলের রক্তাক্ত বিরোধ বহুদিন ধরে চলছে। এছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিবেশী মুসলমান দেশ, যেমন আফগানিস্তান ও ইরানের রেষারেষি প্রমাণ করে যে, মুসলমান দেশগুলোর মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য শুধু ধর্মই যথেষ্ট নয়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ভ্রাতৃত্বহীনতা ও সার্বক্ষণিক সংঘাত, সম্প্রতি সৌদি আরবের প্রধান মুফতির ইরানী শিয়াদের অমুসলমান ঘোষণা, সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরাইলের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কÑ এ থেকে সহজেই অনুমেয় যে, ইসলামিক উম্মাহর ধারণাটি সন্দেহজনক। যাই হোক, একাত্তরের পরে দ্বিজাতিতত্ত্ব অপ্রাসঙ্গিক হবার পরেও পাকিস্তান নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে এটা তার সাফল্য। এটা করতে গিয়ে আশ্চর্য হলেও সত্যি, যে তত্ত্বের ভিত্তিতে তার জন্ম হয়েছিল সেটা বাদ দিয়েও পাকিস্তান টিকে থাকতে ও উন্নতি করতে পারে। বর্তমানে পাকিস্তান বিশ্ব উম্মাহর তত্ত্বে শুধু ফাঁকা বুলি আওড়াচ্ছে। বস্তুতপক্ষে, চরম বাস্তবতা ও জাতিগঠনে জরুরী বিষয়ে মনোযোগ দিয়েই পাকিস্তান একটা স্বাভাবিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মুসলিম হিসেবে কমিউনিজম প্রচণ্ড অপছন্দ করলেও চীনের সঙ্গে ‘চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর’ পাকিস্তানকে অভূতপূর্ব শক্তিশালী করবে। দ্বিজাতিতত্ত্বকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে হবেÑ এই মতবাদ পাকিস্তানের জন্ম দিলেও বর্তমানে এই মতবাদ ত্যাগ করলে কোন ক্ষতি নেই। একটি রাষ্ট্র কোন মতবাদ ছাড়াও সফলভাবে টিকে থাকতে পারে। এর উদাহরণ নেদারল্যান্ডস এবং আর্জেন্টিনার মতো সমৃদ্ধশালী দেশের কোন ‘তত্ত্ব’ নেই। সময়ের ফাঁদ থেকে পাকিস্তানকে বেরিয়ে আসতে হবে। পাকিস্তানের অবশ্যই উপলব্ধি করার সময় এসেছে যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জাতিগত, ভাষাগত এবং সংস্কৃতির তারতম্যের জন্য ভারত দায়ী নয়। একই মায়ের জরায়ুতে জন্ম নেয়া যমজ দুটি সন্তানের মাঝে যেমন অসঙ্গতি দেখা যায়, ঠিক তেমনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানেরও একত্রে টিকে থাকার সম্ভাবনা ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। সুশাসনের অভাব এই ভাঙ্গনকে ত্বরান্বিত করেছে। আমাদের যোগসূত্র ভেঙ্গে ভারত বাংলাদেশের জন্মগ্রহণে সহায়তা করেছে মাত্র, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে অসঙ্গতির সৃষ্টি করেনি। পূর্ব ও পশ্চিমের এ ভাঙ্গন সেদিনই স্পষ্ট হয়েছে যেদিন জুলফিকার আলী ভুট্টো তার বিখ্যাত ভাষণে বলেন, ইধার হাম, উধার তুম। বাংলাদেশের এখন সময় এসেছে জন্মকালের খুঁটিনাটি পেছনে রেখে ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি তৃপ্তি দিতে পারে; কিন্তু শান্তি, শৃঙ্খলা ও গণতন্ত্র দিতে পারে না। অন্যদিকে পাকিস্তানের অনেক বেশি করণীয় রয়েছে বাংলাদেশের চেয়ে। স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের বিকৃত ইতিহাস দিয়ে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করা বন্ধ করা দরকার। কারণ সেগুলো ১৯৭১ সালে বাঙালীর ও পরে পশ্চিম পাকিস্তানের ভয়াবহ অত্যাচারকে গোপন করে। ১৯৭১-এর সত্যকে গোপন করা এবং যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করার চেষ্টা বাদ দিয়ে সত্যকে গ্রহণ করে বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনই হবে পাকিস্তানের জন্য সঠিক পদক্ষেপ। : সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৬ তারিখে পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় প্রকাশিত এই নিবন্ধের লেখক লাহোর ও ইসলামাবাদে পদার্থবিজ্ঞানে শিক্ষকতা করেন।
×