ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বজিত রায়

অভিমত ॥ সড়ক দুর্ঘটনা যেন পথের বলি

প্রকাশিত: ০৬:২০, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৬

অভিমত ॥ সড়ক দুর্ঘটনা যেন পথের বলি

ঈদের ছুটিতে বাড়ি ফেরা। অতঃপর কর্মস্থলে ছুটে চলা। আসা-যাওয়ার এই মাঝখানে অনেকেই চলে গেছেন না ফেরার দেশে। যারা সড়ক দুর্ঘটনায় অস্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের স্বজন ও পরিবার-পরিজনকে স্পর্শ করেছে গভীর বেদনা। যে শোক সইবার সামর্থ্য কারও নেই। প্রিয়জন হারিয়ে বুকের ভেতর সৃষ্টি হওয়া দীর্ঘ শূন্যতা স্বজনহারা মানুষদের কাঁদাবে আজীবন। এই কান্না, আহাজারি, আর্তনাদ আর কতকাল-কতদিন বয়ে বেড়াতে হবে? কখন, কোথায়, কিভাবে যে কার জীবন নিমিষেই মিশে যাবে সড়ক-মহাসড়কে কেউ তা জানে না। দুর্ঘটনার নামে রাস্তাঘাটে যেভাবে মানুষ পথের বলি হচ্ছে তাতে অনেকটা পরিকল্পিত হত্যাকা- বলেই ধরে নেয়া যায়। কিন্তু এই অশুভ অঘটন থেকে রেহাই পাওয়ার কি কোন পথ খোলা নেই? দুর্ঘটনার ধারাবাহিকতা স্পষ্টতই জানান দিচ্ছে, আপাতত শঙ্কামুক্ত কোন জবাব নেই কারও কাছে। পত্রিকা কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় চোখ বুলালে দুর্ঘটনার করুণ চিত্র মনগহীনে শঙ্কা এবং ভয়ের জন্ম দেয়। গত ১৬ সেপ্টেম্বর শুক্রবারের সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের শিরোনাম ছিল ‘ঈদের ছুটিতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল ৪২ জনের।’ ১৭ সেপ্টেম্বর শনিবারের শিরোনাম ‘সড়কে ঝরল ২৩ প্রাণ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বরসহ নিহত ৮।’ পরদিন ১৮ সেপ্টেম্বর রবিবারের শিরোনাম ‘সড়ক দুর্ঘটনায় সারাদেশে নিহত ২৫।’ সারা বছর সড়ক দুর্ঘটনার খবর নিয়মিত হলেও ঈদ এলে এর মাত্রা আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়। তার মানে দুর্ঘটনায় অস্বাভাবিক মৃত্যু আমাদের কপালে নিত্য লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন। ঈদ আয়োজনে সঙ্গী হতে বাড়ি ছুটে চলা কিংবা কর্মস্থলে ফিরতে পথিমধ্যে তরতাজা প্রাণ বধকারী সড়ক দুর্ঘটনা অসংখ্য পরিবারে সৃষ্টি করেছে শোকের মাতম। খবরে প্রকাশ, এবার ঈদে দেশের সড়ক-মহাসড়ক প্রাণঘাতী রূপ নিয়েছে। বেসরকারী হিসাবে ঈদযাত্রায় প্রতিদিন গড়ে ১৭ জনের বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ঈদে যানবাহনের মালিক ও চালক উভয়ই অতিরিক্ত আয়ের নেশায় বিরামহীনভাবে যানবাহন পরিচালনা করেন। তবে যানজট থাকলে ট্রিপ (যাত্রা) কমে যায়। তখন ক্লান্ত চালক আয় বৃদ্ধির জন্য ফাঁকা রাস্তা পেলেই গতির ঝড় তোলেন। বাংলাদেশের সড়কের যে সক্ষমতা তাতে ৬০-৭০ কিলোমিটারের বেশি গতি তোলার সুযোগ নেই। কিন্তু চালকরা ১০০-১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত গতিতে যাত্রীবাহী বাস চালাচ্ছেন। এটা ধরার যন্ত্র নেই, দোষী ব্যক্তি শাস্তিও পাচ্ছেন না। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। জাতিসংঘ ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দশককে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস দশক হিসেবে ঘোষণা করেছে। এ সময়ের মধ্যে সারা পৃথিবীতে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার অঙ্গীকার করে এ সংক্রান্ত নথিতে বাংলাদেশও সই করেছে। কিন্তু সরকার কয়েকটি সড়কের বাঁক সোজাকরণ ও সড়ক সম্প্রসারণ ছাড়া গতি নিয়ন্ত্রণ এবং চালকদের বেপরোয়া মনোভাব রুখতে তেমন কোন উদ্যোগ নেয়নি। পুলিশের হিসাব অনুযায়ী প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা কমলেও বেসরকারী হিসাবে ঠিক উল্টো। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত সংবাদের ওপর ভিত্তি করে সড়ক দুর্ঘটনার সমীক্ষা করে থাকে। সংস্থাটির হিসাবে এবারের ঈদ-উল-আযহা উপলক্ষে ৭ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ৮৮টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৫৭ জন। আহত হয়েছেন ৩৪৬ জন। ১০টি জাতীয় দৈনিক ও ৬টি আঞ্চলিক পত্রিকায় প্রকাশিত দুর্ঘটনার খবরের ওপর ভিত্তি করে সংগঠনটি এই হিসাব দিয়েছে। যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্যমতে গত ঈদ-উল-ফিতরে সারাদেশে ১২১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে ১৮৬ জনের। আহত হন ৭৪৪ জন। সমিতির হিসাবে ২০১৫ সালে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৮ হাজার ১৫২ জন। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণকারী এই মানুষগুলো কারও সন্তান বা কারও স্বজন। অস্বাভাবিক এই মৃত্যুর খবরটি তাদের স্বজনদের কাছে কতটুকু দুঃসংবাদÑ এমন প্রশ্নের তৃপ্তিদায়ক উত্তর কী কেউ দিতে পারবেন? হয়তবা না। আপনজন হারানোর বেদনা শুধু স্বজনরাই অনুভব করছেন বার বার। আর কতদিন এ দেশের মানুষকে প্রিয়জন হারানোর গভীর ক্ষত বয়ে বেড়াতে হবে? জীবিকানির্ভর প্রতিটি মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে প্রতিনিয়তই দেশের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সড়ক কিংবা নৌপথে যাতায়াত করে থাকেন। জীবন পরিচালনায় সবাই গ্রাম থেকে শহরে বা শহর থেকে গ্রামে যে কোন যানবাহনে ছুটে চলেন। বিশেষ করে যাতায়াত সুবিধার জন্য অধিকাংশ মানুষ এখন সড়ক পথকেই বেছে নেন। প্রতিটি মানুষই চান তাদের চলার পথ যেন হয় নিরাপদ। কিন্তু চলাচলের জন্য এ দেশের রাস্তাঘাট কতটুকু আপদমুক্ত? রাস্তাঘাটের বেহাল দশা, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, চালকের খামখেয়ালিপনা, অনভিজ্ঞ চালক দ্বারা গাড়ি পরিচালনাই সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ার অন্যতম কারণ। আর এতে অসময়েই প্রাণ হারাচ্ছেন অনেক মানুষ। স্বজন হারানোর বেদনা আজীবন সংক্রমিত করে পরিজনকে। তাই সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু পদক্ষেপ নিয়ে আইন প্রয়োগ করলেই চলবে না, আইনের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে হবে।
×