ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মিউজিয়াম অব রাজাস

হাছন রাজার হরেক স্মৃতি অধ্যাত্মবাদ, দুর্লভ নিদর্শনে খুঁজে ফেরা

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৬

হাছন রাজার হরেক স্মৃতি অধ্যাত্মবাদ, দুর্লভ নিদর্শনে খুঁজে ফেরা

মোরসালিন মিজান, সিলেট থেকে ফিরে ॥ ধাক্ ধাক্ করিয়া উঠিল আগুন ধৈল আমার প্রাণে/ সুরমা নদীর জল দিলে নিভে না সে কেনে...। সুরমা নদীর জল ঢেলে দিয়েও আগুন নেভাতে পারেননি হাছন রাজা। মনে যে আগুন হঠাৎ লেগেছিল, সে আগুনে এমনকি নিঃশেষ হয়ে যায় জমিদারি। ভোগবিলাসের জীবন ছেড়ে বৈরাগ্য গ্রহণ করেন তিনি। সঙ্গীতের আশ্রয়ে পরমাত্মার সন্ধান করেন। মরমী কবির ঘটনাবহুল জীবন ও দর্শন সম্পর্কে কৌতূহলের শেষ নেই। আজও মানুষ তার স্মৃতি খুঁজে ফেরে। সে দিকটি বিবেচনায় রেখে সিলেট শহরের প্রাণকেন্দ্রে গড়ে তোলা হয়েছে একটি জাদুঘর। নাম- মিউজিয়াম অব রাজাস। ভাটিবাংলার সাধক পুরুষ হাছন রাজা ও তার সময়কে তুলে ধরার প্রয়াস এখানে। সেই সঙ্গে এসেছে বাকি রাজাদের খুঁটিনাটি। ছোট পরিসর। সীমিত উপস্থাপনা। এর পরও হাছন রাজায় বুঁদ হয়ে থাকা যায়। জীবনের গভীরতর বোধগুলোকে নতুন করে জাগিয়ে তুলে, নাড়া দেয় মিউজিয়াম অব রাজাস। জাদুঘর ভবনটি শহরের জিন্দাবাজার এলাকায়। প্রধান সড়ক প্রায় ছুঁয়ে আছে। আশপাশে আধুনিক ভবন। সুউচ্চ অট্টালিকা। ওসবের ভিড়ে একটিই পুরনো এবং ভূমিসংলগ্ন বাড়ি। টিনের একতলা। দেখেই মনে পড়ে যায় হাছন রাজার সেই বিখ্যাত গানÑ লোকে বলে, বলে রে/ ঘর বাড়ি ভালা না আমার...। ঘর বাড়ির বিবেচনায় ভাল নয় বটে, আভিজাত্যটুকু শতভাগ ধরে রেখেছে। হাছন রাজার ব্বংশধরদের ব্যবহৃত বাড়ির পুরোটা নিয়ে ২০০৬ সালে গড়ে তোলা হয় মিউজিয়াম অব রাজাস। দেওয়ান তালেবুর রাজা ট্রাস্টের উদ্যোগটি দারুণ প্রশংসিত। জাদুঘরের প্রবেশদ্বারের দুই পাশে দুটি সিংহ। বহুকাল আগের পাথর মূর্তি। স্বাগত জানানোর ভঙ্গিতে বসে আছে। জমিদার বাড়ির আবহ তৈরি করতেই এমন সংযোজন। ভেতরে প্রবেশ করলে দুটো কামরা। বেশ কয়েকটি গ্লাস শোকেস। বিভিন্ন নিদর্শন দিয়ে সাজানো। একটি গ্লাস শোকেসে হাছন রাজার গানের পা-ুলিপি। নিজের হাতে লেখা। মূল কপি না হলেও, পড়া যায়। বাঁশের কঞ্চি কেটে তৈরি কলম আর কালিতে লেখা গীতিকবিতা হাছন রাজার সৃজনশীলতার অনিন্দ্য প্রকাশ। হাছন রাজার অধ্যাত্মবাদের যে পরিচয় মেলে, তাও মূলত সঙ্গীতে। একাধিক গ্লাসশোকেস সাজানো হয়েছে লোকবাদ্যযন্ত্র দিয়ে। একতারা, দোতরা, ঢোল আদি রূপ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে এখানে। দ্বিতীয় কক্ষের একটি দেয়ালঘেঁষে রাখা হয়েছে হাছন রাজার নিজের রচনা ও তাকে নিয়ে লেখা বই। গ্রন্থসম্ভার। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত বই ও পা-লিপি হাছন রাজা বিষয়ক গবেষণার ফল। রাজা পরিবারে ব্যবহৃত বিভিন্ন নিদর্শন থেকেও হাছন রাজাকে খুঁজে নেয়া যায়। উদাহরণ হতে পারে প্রথম কক্ষের মাঝখানে রাখা লোহার সিন্দুকটি। হাছন রাজার পরিবারে ব্যবহৃত ৩০০ কেজি ওজনের সিন্দুক তাদের অঢেল ধনসম্পদের, মনে করা যেতে পারে, প্রতীকি উপস্থাপনা। ওই সময় বিশেষ এক ধরনের পাদুকা ব্যবহার করা হতো, যার নাম খড়ম। একাধিক আলোকচিত্রে হাছন রাজাকে খড়ম পায়ে দেখা গেছে। জাদুঘরের এককোণে রাখা হয়েছে অনরূপ দেখতে খড়ম। হাছন রাজার পোশাক সম্পর্কে ধারণা দেয় একাধিক আলোকচিত্র। হাছন রাজার আলোচনায় কিছু পশু-পাখির নাম সব সময়ই এসেছে। এ সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য দিচ্ছে জাদুঘর। জানাচ্ছে, হাছন রাজার ঘোড়াগুলোর ছিল আলাদা আলাদা নাম। যেমনÑ কদমবাজ, লাল বড় ঘুড়ি, জিন ঘুড়ি, চান্দা, খুস দিল, বাক্কা বাহাদুর, শিং বাহাদুর, জয় বাহাদুর, সোনা লাল, বিজলি ঘুড়ি, মালতী। কত কত নাম! মোট ৭৮ টি নামের উল্লেখ পাওয়া যায় জাদুঘরে। পাশের একটি ওয়াল শোকেসে রাখা আছে হাছন রাজার ব্যবহার করা ঘোড়ার লাগাম। চামড়ার বেল্টের মতো দেখতে সামান্য বস্তু এখন অমূল্য স্মারক। জাদুঘরে উপস্থাপন করা হয়েছে বেশ কিছু হাতির নাম। নামগুলোর মধ্যে রয়েছে জিবা, জঙ্গ বাহাদুর, বাংলা বাহাদুর, মাসুকজান, মুকনা, রাজরানী, সুরত জান, মঙ্গল প্যারী ও হাছন প্যারী। হাছন রাজার কোড়ার কথা তো বার বার এসেছে গানে। এই পাখি খুব যতœ করে পালতেন হাছন রাজা। খান বাহাদুর দেওয়ান গণিউর রাজার ডায়েরি থেকে কোড়াদের বিভিন্ন নাম সংগ্রহ করেছে জাদুঘর। টানানো তালিকায় আছে ৮০টি নাম। লাল মইন, চাকার কোড়া, টক্করিয়া, হাছন জান, হাছন বাহার, বাঘা, জল্লা, মহারাজ, ভাজ রাঙ্গিয়া ইত্যাদি নাম হাতির চরিত্র সম্পর্কেও একটি ধারণা দেয়। শখেরবসে পশু শিকারও করতেন রাজা পরিবারের সদস্যরা। তখনকার সময় এটি ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। শিকার করা পশুর সিং-চামড়া জমিদারদের শৌর্য-বীর্যের প্রতিক হয়ে দেয়ালে শোভা পেত। জাদঘরে রাখা হরিণের শিং যেন সেই কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। হাছন রাজা পরিবারের ঐতিহ্য আভিজাত্যের স্মারক হয়ে আছে তাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন বাসনকোষন, পোশাক পরিচ্ছদ। বেগম মেহেরজান বানুর পোশাকের ছিন্ন অংশ রাখা আছে জাদুঘরে। স্বর্ণ ও রৌপ্য খচিত পোশাক দেখে বিস্ময় কাটে না। শ্বেতপাথরের বাসনকোষনও মুগ্ধ হয়ে দেখতে হয়। একটি কাঁচের থালা দুইস্তর বিশিষ্ট। মাঝখানে গরম পানি রাখার ব্যবস্থা আছে। তার ওপর খাবার পরিবেশন করা হতো। ফলে খাবার থাকত গরম! এভাবে ছোট্ট জাদুঘর হলেও আকৃষ্ট করে রাখে। হাছন রাজা ও তার ব্বংশধরদের ইতিহাস জানতে জাদুঘরটি বেশ সহায়ক। একই সঙ্গে আছে সীমাবদ্ধতাও। জাদুঘরটি নিয়ে অনেক কাজ করার আছে বলেই মনে হয়েছে। দর্শনার্থীদের জাদুঘর ঘুরে দেখানোর কাজ করেন মাহাবুব রহমান। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, অনেক আন্তরিকতা ও আবেগ নিয়ে জাদুঘরটি গড়ে তোলা হয়েছিল। কিন্তু প্রধান উদ্যোক্তা দেওয়ান মোহাম্মদ তাছাওয়ার রাজা অসুস্থ থাকায় কিছু কাজ এগোচ্ছে না। তবে, স্থানীয়রা চান, জাদুঘরটি আরও সমৃদ্ধ হোক। কার্যক্রম এগিয়ে যাক। মিউজিয়াম অব রাজাস রবিবার ছাড়া প্রতিদিনই উন্মুক্ত থাকে দর্শনার্থীদের জন্য।
×