ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাকি এখন মেজর জিয়া, মারজান ও রাজীব বা সুভাষ গান্ধী (ছদ্ম নাম)

নব্য জেএমবির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গেছে

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৬

নব্য জেএমবির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গেছে

শংকর কুমার দে ॥ ‘নব্য জেএমবি, যেই নালে উৎপত্তি-সেই নালে বিনাশ’। মাত্র দুই বছরের মাথায় নেটওয়ার্ক বা মেরুদ- ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেছে এই জঙ্গী সংগঠনটির। জঙ্গী সংগঠনটির শীর্ষস্থানীয় জঙ্গী নেতা, অর্থের যোগানদাতা, নির্দেশদাতা, পরিকল্পনাকারী, অপারেশনাল কমান্ডার, আত্মঘাতী দলের সদস্যদের অনেকেই নিহত নয়তো পলাতক। গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড নুরুল ইসলাম মারজান, আজিমপুরের জঙ্গী আস্তানায় যাতায়াতকারী মোঃ বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট, উত্তরাঞ্চলের ত্রাস রাজীব গান্ধী ওরফে সুভাষ গান্ধী- এখন হাতেগোনা এই তিন শীর্ষ জঙ্গী নিশ্চিহ্ন হলেই নব্য জেএমবি নামক জঙ্গী সংগঠনটির খেলা খতম। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, প্রায় দুই বছর ধরে উচ্চ শিক্ষিত, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্র, বিত্তবান পরিবারের সন্তান ধীরে ধীরে সংগঠিত হয়ে ওঠে নব্য জেএমবি। এই দুই বছরে একে একে প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার, প্রকাশক, অধ্যাপক, পুলিশ, বিদেশী নাগরিক, ধর্মযাজক, পুরোহিত, ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যা করে কখনও আইএস আবার কখনও আল কায়েদা এর নামে দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেশ-বিদেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জঙ্গী সংগঠনটি। আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনের স্টাইলে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিত হামলা করে জঙ্গীবাদের নতুন ধারার আত্মপ্রকাশ ঘটানোর ধারাবাহিকতায় শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলা করে জঙ্গী সংগঠনটির জঙ্গী দলে কারা চিহ্নিত হয়ে যায়। তারপর গত কয়েক মাসে কল্যাণপুর, নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়া, মিরপুরের রূপনগর, আজিমপুরের জঙ্গী আস্তানা ও উত্তরাঞ্চলে অভিযানে শীর্ষ নেতাদের বেশিরভাগই বিভিন্ন সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন। বাকিদের একটি বড় অংশ ধরা পড়েছেন গোয়েন্দাজালে। দলের প্রথম সারির শীর্ষ জঙ্গীদের অনেকেই দেশ-বিদেশে আত্মগোপনে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নব্য জেএমবির এখনও পলাতক পাঁচ সদস্য এখন মূর্তমান আতঙ্ক। এই পাঁচজন হলো নুরুল ইসলাম মারজান, রাজীব গান্ধী ওরফে সুভাষ গান্ধী ওরফে গান্ধী, মোঃ বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট বাশার ওরফে চকলেট, রিপন ও খালিদ। পাঁচজন বাইরে তৎপর থাকায় এই জঙ্গী সংগঠনটিকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা যায়নি। তারা যে কোন সময়ে যে কোন ধরনের হামলা ও নাশকতা চালাতে পারে বলে গোয়েন্দারা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, ‘গুলশান ও শোলাকিয়ার হামলার ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে অনেকের নাম পেয়েছি। নব্য জেএমবির অনেকে পুলিশের অভিযানে নিহত হয়েছে। অনেকে গ্রেফতার হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। বিভিন্ন অভিযানে নব্য জেএমবির ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ক্ষমতা ক্ষয় হয়েছে। তবে এখনও এই জঙ্গী সংগঠনের কমান্ডিং পর্যায়ের বেশ কয়েকজন বাইরে রয়েছে। তাদের মধ্যে মোঃ নুরুল ইসলাম মারজান, মোঃ বাশারুজ্জামান ওরফে বাশার চকলেট, রাজীব গান্ধী ওরফে সুভাষ গান্ধী ওরফে গান্ধী, রিপন ও খালিদ অন্যতম। তদন্ত সূত্র জানান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করিম হত্যার পর গত এপ্রিলের শেষ দিকে ভারত পালিয়ে যায় রিপন ও খালিদ। তারা আর দেশে আসেনি। গত এপ্রিলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে খুন করে জঙ্গীরা। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল ওই দুই জঙ্গী। তবে রিপন ও খালিদ ভারতে পালিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়ার পাশাপাশি তাদের দেশের জঙ্গীদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানা গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, গত ১ জুলাই সংঘটিত গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার ঘটনাটি জঙ্গী দমনে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। হলি আর্টিজান বেকারিতে যারা ঢুকেছিল এবং যারা পেছনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে তাদের পরিচয় নিশ্চিত হয়েছেন তদন্তকারীরা। কেউ কেউ ধরা পেড়েছে। অভিযানে নিহত হচ্ছে। কেউ গ্রেফতার হচ্ছে। ১ জুলাই গুলশানে হামলার মাত্র ৭ দিনের মাথায় গত ৭ জুলাই সংঘটিত শোলাকিয়ার ঘটনা ঘটে, যার শীর্ষস্থানীয় জঙ্গী প্রশিক্ষক ছিলেন আবু রায়হান তারেক। আবু রায়হান তারেক কল্যাণপুরে জঙ্গী অভিযানে নিহত হয়েছে। সে গুলশানের হামলাকারীদের প্রশিক্ষক ছিল। রিগ্যান নামে একজনকে জীবিত ধরা হয়েছে, যে ইতোমধ্যেই আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দী দিয়েছে। সে কোরানের শিক্ষা দিত জঙ্গীদের। এছাড়া মিরপুরের রূপনগরে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জাহিদুল ইসলাম ওরফে মেজর মুরাদ পুলিশি অভিযানে নিহত হয়েছে। সেও জঙ্গী প্রশিক্ষক ছিল। মূলত গুলশান ও শোলাকিয়ার প্রশিক্ষক ছিল মুরাদ ও তানভীর। সবকিছুর সমন্বয়ক ও অর্থ যোগানদাতা ছিল তামীম চৌধুরী। সেও নারায়ণগঞ্জে মারা গেছে। আরেকজন বসুন্ধরায় বাসাভাড়া নিয়েছিল আব্দুল করীম নামে, যার প্রকৃত নাম তানভীর কাদেরী। সেও আজিমপুরে নিহত হয়েছে। আরও কিছু নাম আসছে। অর্থের উৎসটা কিছুটা তথ্য পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে অস্ত্রের গতিপথের তথ্যও। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, নব্য জেএমবির উত্তরবঙ্গের কমান্ডার হচ্ছে, রাজীব গান্ধী ওরফে সুভাষ গান্ধী ওরফে গান্ধী । গুলশান ও শোলাকিয়ার হামলায় সে জঙ্গী পাঠিয়েছিল। যখন কোন হামলায় দক্ষ সন্ত্রাসীর প্রয়োজন হয়, তখন সে তা সরবরাহ করত। গুলশানে দুই জন এবং শোলাকিয়া একজন জঙ্গী পাঠিয়েছিল সে। তবে রাজীব গান্ধীর প্রকৃত পরিচয় এখনও জানতে পারেননি তদন্তকারীরা। তবে সে মূলত: উত্তরাঞ্চল ভিত্তিক জঙ্গী তৎপরতায় যুক্ত থাকালেও এখন আত্মগোপনে থেকে অনেকটাই নিষ্ক্রিয় বলে তথ্য পাওয়া গেছে। র‌্যাবের প্রকাশিত নিখোঁজের তালিকার ১৮ নম্বরে ছিল বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট বাশার ওরফে চকলেট। তার গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর তানোর উপজেলার লালপুরে। সে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল। তার নিখোঁজের ঘটনায় কলাবাগান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) রয়েছে। গত ৫ জানুয়ারি থেকে সে নিখোঁজ রয়েছে। বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট বাশার ওরফে চকলেট নব্য জেএমবির শীর্ষ কমান্ডারদের মধ্যে অন্যতম। আজিমপুরে জঙ্গী হামলার সময়ে নিহত তানভীর কাদেরীর যমজ সন্তানদের একজন তার কাছে রয়েছে এমন তথ্য পেয়েছেন তদন্তকারীরা। যমজ ভাইদের মধ্যে একজন তাহরীম কাদেরীকে তিন দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তার অপর যমজ ভাইকে নিয়ে আত্মপোন করে আছে শীর্ষস্থানীয় জঙ্গী বাশারুজ্জামান। বাশারুজ্জামানের স্ত্রী শায়লা আফরিন আজিমপুর অভিযানের সময়ে আহত অবস্থায় আটক হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। নব্য জেএমবি নামক জঙ্গী সংগঠনটির সবচেয়ে কমবয়সী কমান্ডার নুরুল ইসলাম মারজান (২৩)। সাংগঠনিক কার্যক্রমে তার দক্ষতা, সদস্য সংগ্রহ এবং কাউন্সিলিং করে আত্মঘাতী হামলায় শিক্ষিত তরুণদের উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে বিশেষ পারদর্শিতার কারণে সে এই কমান্ডিং পদবি পেয়েছে বলে গোয়েন্দারা জানিয়েছেন। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার মাস্টারমাইন্ড পলাতক নুরুল ইসলাম মারজান। মারজানের স্ত্রী আফরিন ওরফে প্রিয়তি। আজিমপুরে অভিযানের সময়ে আহত অবস্থায় আটক হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে মারজানের স্ত্রী প্রিয়তি। তদন্তকারীদের ধারণা, মারজান নব্য জেএমবির অপারেশন ও ন্যাশনাল কমান্ডার। সে অত্যন্ত ধূর্ত ও জঙ্গী সাংগঠনিকতায় দক্ষ। পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে কয়েকজন কমান্ডার নিহত হওয়ার পর তার কাঁধে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। জঙ্গী সংগঠনটিতে উচ্চশিক্ষিত নতুন সদস্যদের জেএমবিতে ভেড়ানোর মূল চাবিকাঠি তার হাতে। সে সমন্বয় করে থাকে। গুলশানের ঘটনায় শিক্ষিত একটি শ্রেণীকে নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দেয়া এবং অভিযানে পাঠানোর পেছনে তার ভূমিকা অগ্রগণ্য। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে তার ওপর আরও ২/৩ জন থাকলেও অপারেশন কমান্ডার হিসেবে মারজান দলের চাবিকাঠি নাড়ায়। জেএমবির ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ শক্তি খর্ব করা হওয়া প্রসঙ্গে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, সম্প্রতি ৪টি ঘটনায় নব্য জেএমবির কমান্ডিং পর্যায়ের নেতা, সমন্বয়কারী এবং প্রশিক্ষক নিহত হয়েছে। এর মধ্যে কল্যাণপুরের অভিযানে ৪ জন কমান্ডিং পর্যায়ের নেতা, মিরপুরের রূপনগরে প্রশিক্ষক জাহিদুল ইসলাম (মেজর মুরাদ), জঙ্গীদের জন্য বিভিন্ন জায়গায় বাসা ভাড়া করে দেয়ার সমন্বয়কারী জঙ্গী তানভীর (করিম) এবং মূল সমন্বয়কারী তামিম চৌধুরী নারায়ণগঞ্জে নিহত হয়েছে। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, গত কয়েক মাসের সফল অভিযানে সশস্ত্র জঙ্গীদের নেটওয়ার্কের পাশাপাশি তাদের দৃঢ় মনোবলও গুঁড়িয়ে গেছে। সশস্ত্র জঙ্গী আস্তানা, হামলার ছক, বাস্তবায়নের কৌশল ও অস্ত্র-গোলাবারুদ সংগ্রহের রুট সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলছে। এমনকি জঙ্গী কার্যক্রম পরিচালনার অর্থের জোগানদাতাদের নাম-ধাম, পরিচয়ের তথ্যও গোয়েন্দাদের হস্তগত, যার ধারাবাহিকতায় নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার ও তাদের আস্তানায় হানা দেয়া তাদের পক্ষে সহজ হয়েছে। এতদিন জান্নাতি হুর প্রাপ্তির লোভ দেখিয়ে তরুণদের মগজ ধোলাই করে শহীদ হওয়ার নেশার জাগান দেয়ানো হলেও পুলিশ অভিযানে জঙ্গীদের করুণ মৃত্যু, পরিবারের ও সমাজের ঘৃণায় সেই নেশার ঘোর কেটে গেছে। এখন অনেকেই জঙ্গীদের অন্ধকার জগত ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার চেষ্টা করছেন।
×