ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘দেখো হে বিশ্ব! আমি যে কোন কিছু করে দেখাতে পারি’

প্রকাশিত: ০৭:০৫, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

‘দেখো হে বিশ্ব! আমি যে কোন কিছু করে দেখাতে পারি’

ধৃতরাষ্ট্রকে আমরা সবাই চিনি। জন্ম থেকে অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও পা-ুর অবর্তমানে রাজা হয়েছিল সেই। কিন্তু আমরা আজ শুনব এমন একজনের গল্প, যে হয়ত আজকের যুগে দাঁড়িয়ে ছাপিয়ে গেছে ধৃতরাষ্ট্রকেও। বাবা-মা এত দরিদ্র ছিলেন চাননি তাদের ছয়জনের সংসারে নতুন শিশু আসুক। ভারতের হায়দরাবাদের গ্রামের এক অখ্যাত গ্রামে জন্ম নিল এক অপুষ্ট প্রিম্যাচিউরড শিশু। শুধু অপুষ্টই না একেবারে জন্মান্ধ। এই সন্তানকে দিয়ে কি হবে! শিশুটি যতই বড় হতে লাগল-চোখ দিয়ে দেখতে না পারলেও হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করতে পারল- সে এই সমাজের জন্য একেবারে আনফিট, দমে গেলে যমে নেয়ার আগে মানুষেই তাকে থামিয়ে দেবে। হাতের স্পর্শে বই পড়ে শুরু হলো তার অক্লান্ত পরিশ্রম। আমি এতক্ষণ যার কথা বলছি তিনি হলেনÑ হায়দরাবাদের প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে শ্রীকান্ত বোলা। হায়দরাবাদের স্কুলে পড়ে নিজেকে শাণিত করেছেন শ্রীকান্ত। সন্তান যেমনই হোক পিতা-মাতার কাছে সে রাজপুত্র। রাজপুত্রের চাইতেই বা কম কি! শ্রীকান্তকে সৃষ্টিকর্তা চোখের দৃষ্টি দেননি। তবে নিরাশও করেননি। দিয়েছেন মনের দূরদৃষ্টি। সেই মনের চোখ এতটাই প্রখর যে নিজ কর্ম দিয়ে তিনি প্রমাণ করতে পেরেছেন অভিশাপ নয় আশীর্বাদ হয়েই এসেছেন তিনি। বড় হতে চাওয়ার ইচ্ছেগুলো সমাজ থেকেই মেরে ফেলা হয়। শ্রীকান্ত চেয়েছিলেন পড়ালেখা করবেন। তবে তার চারপাশের মানুষগুলোর নিদারুণ হেয়ালি-‘এই ছেলে কীভাবে পড়ালেখা করবে, যে কিনা চোখেই দেখে না!’ শ্রীকান্ত চেয়েছিলেন খেলাধুলা করবেন। সেখানে তাকে থাকতে হয়েছে ‘দুধ-ভাত’ হিসেবে। শারীরিক শিক্ষার ক্লাসগুলোতে তাকে সুযোগ দেয়া হতো না। স্কুল ঘরে সবসময় তার জায়গা হতো পেছনের বেঞ্চগুলোতে। বন্ধু বলতে কেউ ছিল না, বড়জোর তাদের বলা যায় সহপাঠী। তারাই তাকে তাচ্ছিল্য করে পেছনের দিকে পাঠাতো। এসব মুখ বুঝে সহ্য করতে হতো তাকে। একটা মানুষ যখন এতটা অবহেলার শিকার হয় তখন তার মানসিক অবস্থা কেমন হয় সেটা বোঝার মতো কেউ ছিল না। ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’র মতো একাই লড়াই চালিয়ে গেলেন শ্রীকান্ত। শুধু ইচ্ছাশক্তির জোরে এত বঞ্চনার মাঝেও তিনি হাল ছেড়ে দেয়নি। সবকিছুতেই তাঁর অর্জন চোখ কপালে ওঠার মতো। ৯০ শতাংশ নম্বর পেয়েছিলেন দশম শ্রেণীর বোর্ড পরীক্ষায়। স্বপ্ন দেখেছেন উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়বার। এখানেও ‘না’ শুনতে হয়েছে আজন্ম বাধার সাঁতার কেটে কেটে বড় হওয়া শ্রীকান্তকে। বোর্ড থেকে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে সর্বোচ্চ আর্টস নিয়ে পড়ার সুযোগ পাবে শ্রীকান্ত। সংগ্রামের মাঝেই যার জীবন, সেই শ্রীকান্ত এবারও হাল ছাড়লেন না। মামলা ঠুকে দিলেন। অতঃপর ছ’মাস পর রায় দিল কোর্ট শ্রীকান্তের পক্ষে। রায়ের প্রতি সুবিচার করলেন শ্রীকান্ত। উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ৯৮ শতাংশ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হলেন। এরপর এলো আরও বড় বাধা। প্রকৌশল নিয়ে পড়ার স্বনামধন্য ভারতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (আইআইটি) ভর্তি পরীক্ষার জন্য তাকে প্রবেশপত্র দেয়া হয়নি। তখন শ্রীকান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন, ‘আইআইটি আমাকে চায় না, ঠিক আছে, আমিও তাকে চাই না।’ আবেদন করলেন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় এমআইটিতে। এমআইটির ইতিহাসে প্রথম অন্ধ শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি সেখানে গ্র্যাজুয়েশন করার সুযোগ পান নিজ যোগ্যতা বলে। ২০১২ সালে তৈরি করলেন হায়দরাবাদের বোলান্ট ইন্ডাস্ট্রি। প্রতিষ্ঠাতা এবং একই সঙ্গে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তিনি। যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার। যেখানে আজ ৪৫০ জন কর্মকর্তা, কর্মচারী কাজ করে। যাদের ৮৫ ভাগই বিভিন্নভাবে শারীরিকভাবে অক্ষম, প্রতিবন্ধী। শ্রীকান্ত বোলা’র মতে- মানুষ বলেছিল- আমি অক্ষম, আমি সমাজের বোঝা, আমার দ্বারা কিছুই হবে না। কিন্তু আমি জানতামÑ মানুষের অদম্য ইচ্ছার কাছে হবে না, পারব না বলে এমন কিছুই নেই। আমি শুধু নিজেই যে পেরেছি তা না। আমি একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষ হিসেবে সমাজের আরও অক্ষম অথবা সক্ষম, অুজহাতের কাছে বন্দী অথবা শারীরিক প্রতিবন্ধী এমন মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করতে চাই। ইকো-ফ্রেন্ডলি পণ্য প্রস্তুতকরণ কাজে এই প্রতিষ্ঠানে তিনি সুযোগ দিচ্ছেন স্বল্পশিক্ষিত এবং শারীরিক ত্রুটি নিয়ে নিগৃহীত জীবনযাপন করা মানুষগুলোকে। তাদের ত্রুটিমুক্ত কাজ এবং একাগ্রতা থাকায় স্বল্পসময়ে আজ এই প্রতিষ্ঠান উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে ভারতে। বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠানে পরিবেশবান্ধব পণ্য প্রস্তুতের পাঁচটি ইউনিটে কাজ করছে ১৫০ জন শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষ। বার্ষিক আয় ৭০ মিলিয়ন রুপি ছাড়িয়ে গেছে প্রতিষ্ঠানের। আজকে শ্রীকান্তের নিজস্ব চারটে প্রোডাকশন ইউনিট আছে, কর্ণাটকের হাবলি, তেলেঙ্গানার নিযামাবাদে একটা করে আর হায়দরাবাদে দুটো। কিছু দিনের মধ্যেই অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রী সিটিতে সম্পূর্ণ সোলার নিয়ন্ত্রিত একটা নতুন প্ল্যান্ট তৈরি হতে চলেছে। এসব দেখেই ইনভেস্টর রবি মান্থা দেখা করেছিলেন শ্রীকান্তের সঙ্গে বছর দুয়েক আগে। তাঁর সঙ্গে কথা বলে, তাঁর ব্যবসায়িক বুদ্ধি, দূরদৃষ্টি দেখে সে বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল, আর এসব থেকেই তিনি শ্রীকান্তের মেন্টর হতে চেয়েছেন, সঙ্গে ইনভেস্ট করেছেন তাঁর কোম্পানিতে। তারা এরমধ্যেই প্রায় ১৩ কোটি টাকা ঢেলেছে আর প্রায় ৯ কোটি টাকা উঠেও এসেছে। রবির ইচ্ছা আছে এরপর এই কোম্পানিকে ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিংয়ের আওতায় নিয়ে যাওয়া। একটা প্রতিষ্ঠান, যেখানে ৭০ শতাংশ কর্মী কোনভাবে প্রতিবন্ধী আবার যাদের সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় পঞ্চাশ কোটি। শ্রীকান্ত বলেন, তিনি শারীরিক ত্রুটিসম্পন্ন মানুষ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা পরিবর্তন করতে চান। তাদের সক্ষমতার প্রমাণ তুলে ধরতে চান সবার কাছে। এক সময় পুরো দুনিয়া তাকে বলেছিল, ‘শ্রীকান্ত তুমি কিছু করতে পারবে না।’ আজ এই সাফল্যমুখর দিনে তিনি পেছনে ফিরে তাকান। সেইসব দিনগুলোর কথা স্মরণ করেন। আজ তো তিনি বলতেই পারেন, ‘দেখো হে বিশ্ব! আমি যে কোন কিছু করে দেখাতে পারি।’ ডিপ্রজন্ম ডেস্ক
×