ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গোপসাগরের বুকে ‘বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড’

বিশাল জলরাশি-পাখির কিচিরমিচির ॥ উত্তাল ঢেউ, শোঁ শোঁ শব্দ

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

বিশাল জলরাশি-পাখির কিচিরমিচির ॥ উত্তাল ঢেউ, শোঁ শোঁ শব্দ

বাবুল সরদার ॥ পূর্ণিমার ভর জোয়ারে প্রবল বাতাসের ছোঁয়ায় জলের ওপর চাঁদের মুখ ভাঙছে, মিলছে, মিলাচ্ছে, আবার ভাঙছে। দোল-দুলুনি আর ভাঙ্গা-গড়া। চাঁদমামার সঙ্গে জলের দারুণ খুনসুটি। আবার ভাটি না গড়াতেই বিশাল চর। সূর্যালোকে বালুকাবেলার রূপালী ঝিকমিক। সুন্দরবনের দুবলারচর-হিরণ পয়েন্ট থেকে ১০ নটিক্যাল মাইল দূরে সাগরের বুকে এ যেন বাংলাদেশের আরেক ‘সেন্ট মার্টিন’। এক যুগ আগে মাছ ধরতে গিয়ে রামপল উপজেলার শ্রীফলতলা গ্রামের মালেক ফরাজী নামে এক জেলে দ্বীপটির নাম রেখেছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড’। তিনি এ নামে একটি সাইবোর্ড লিখে দ্বীপে টাঙিয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা বিশাল এ ভূখ-ের ডাকনাম ‘বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড’। দ্বীপের চারপাশে সমুদ্রের উত্তাল জলরাশি। নানান প্রজাতির পাখির কিচিরমিচির। সৈকতে আছড়ে পড়া ঢেউ। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ। মাইলের পর মাইলজুড়ে জেগে ওঠা নতুন চর। দীর্ঘ এ চরের সমুদ্র সৈকতে বসে অনায়াসে দেখা মেলে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের। কোলাহলমুক্ত আর জনশূন্য। এমন অপরূপ প্রকৃতি মনে গভীরতম অব্যাক্ত অনুভূতি জাগায়। প্রায় দশ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকতসহ দ্বীপজুড়ে ঘুরে ফিরছে হরিণসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী, কচ্ছপ, হাজারো লাল রঙের ছোট ছোট শিলা কাঁকড়া। স্বচ্ছ নীল জলে ঘুরছে বিভিন্ন প্রজাতির ছোট-বড় সামুদ্রিক মাছ, কখনও কখনও দেখা মিলছে ডলফিনের। সৈকতের নীল জলে নেই কোন হাঙ্গরের আনাগোনা। সৈকতে আছড়ে পড়া ঢেউয়ে শাপরিংয়ের আদর্শ জায়গা। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড যে কোন দেশী-বিদেশী ইকোট্যুরিস্টদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান। তবে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের এ উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় স্থান বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড প্রচারের অভাব ও বঙ্গোপসাগরের অচেনা এক নতুন দ্বীপে নেই কোন দেশী-বিদেশী ইকোট্যুরিস্টদের আনাগোনা। সরেজমিন বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড ঘুরে দেখা গেছে এমনই চিত্র। দেশের সমুদ্র বিজয়ের পর বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের বিশাল এলাকার ব্লু ইকোনমির কারণে দ্বীপটি শুধু প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দার্যের লীলাভূমিই নয়, দস্যু দমন, চোরাচালান প্রতিরোধ ও সমুদ্র নিরাপত্তায় রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এ লক্ষ্য সামনে রেখে কোস্টগার্ড এ দ্বীপে করতে যাচ্ছে শক্তিশালী বেজ ক্যাম্প। আগামীতে বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ডে কোস্টগার্ডের বেজ ক্যাম্প নির্মাণ হলে ইকোট্যুরিস্টরা (প্রতিবেশ পর্যটক) নির্বিঘেœ উপভোগ করতে পারবেন বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ডের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। মংলা কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড দেড় যুগ আগে প্রকৃতির নিয়মে জেগে ওঠে। তবে বিশাল আয়তনের দ্বীপটি সরকারীভাবে এখনও জরিপ হয়নি। দ্বীপটির উপকূলে মাছ আহরণে থাকা জেলেদের দাবি, বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড প্রায় ১০ কিলোমিটার লম্বা ও পূর্ব-পশ্চিমে ৮ কিলোমিটার প্রশস্ত। বর্ষা মৌসূমেও বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ডের অধিকাংশ এলাকায় জোয়ারের পানি ওঠে না। সরেজমিন এ দ্বীপ ঘুরে দেখা গেছে, প্রাকৃতিকভাবে জন্মাতে শুরু করেছে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ সুন্দরী, কেওড়া, গেওয়া, পশুর, গরান, ধুন্দল, বাইন, আমুর, টাইগার ফার্নসহ বিভিন্ন লতাগুল্ম ও অর্কিড। এখন রূপ নিচ্ছে ম্যানগ্রোভ বনে। ইকোট্যুরিস্টদের নিরাপত্তা ও সার্বিক বিষয়ে বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ডে কোস্টগার্ড ও ট্যুরিস্ট পুলিশের ক্যাম্প স্থাপনের পাশাপাশি জরুরী প্রয়োজনে হেলিপ্যাড, মেডিক্যাল ক্যাম্প, সুপেয় পানির জন্য প্রয়োজন দীঘি খনন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষায় পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার, আধুনিক বার, সুইমিংপুল, শপিং কমপ্লেক্স, হোটেল-মোটেল ও গ্যাংওয়ে নির্মাণ প্রয়োজন। পর্যটকদের ন্যূনতম এ সুযোগ-সুবিধাটুকু নিশ্চিত করা গেলে বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড ইকোট্যুরিস্টদের জন্য হয়ে উঠবে পর্যটনের স্বর্গ। সরেজমিন একাধিক জেলের কাছ থেকে জানা গেছে, এক যুগ আগে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেরা খুবই ছোট এ দ্বীপকে চিনত ‘পুতনিরচর’ হিসেবে। বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার শ্রীফলতলা গ্রামের মালেক ফরাজী নামের এক জেলে বহরদার ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা জানাতে দ্বীপটির নাম রাখেন ‘বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড’। তিনি এ নামের একটি সাইবোর্ড লিখে দ্বীপে স্থাপন করেন। কোস্টগার্ড এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। তিন বছর আগে মালেক ফরাজী প্রয়াত হন। তবে তার নামকরণের ‘বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড’ এখন গুগল ম্যাপেও স্থান পেয়েছে। পেট্রোলবোট কেবিন ক্রজারে মংলা কোস্টগার্ড ঘাঁটি থেকে বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ডে যেতে সময় লাগে তিন ঘণ্টা। মংলার কোস্টগার্ডের পশ্চিম জোনের জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন মেহেদী মাসুদ ও স্টাফ অফিসার (গোয়েন্দা) লেফটেন্যান্ট এএম রাহাতুজ্জামান বলেন, বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ডে ইকোট্যুরিজমের অসীম সম্ভাবনা রয়েছে। ভূমি বরাদ্দের পর কোস্টগার্ডের বেজ ক্যাম্প নির্মাণ হলে গভীর সমুদ্রে মংলা বন্দরের দেশী-বিদেশী জাহাজের পাশাপাশি ট্যুরিস্ট ও জেলে-বনজীবীদের নিরাপত্তা আরও জোরদার হবে। চোরাচালান প্রতিরোধ হবে। বঙ্গোপসাগরে অবৈধ অনুপ্রবেশ হ্রাস পাবে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি এ্যাডভোকেট মীর শওকাত আলী বাদশা জনকণ্ঠকে বলেন, মৎস্যসম্পদ ও সমুদ্র অর্থনীতির স্বার্থে ‘বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড’র বহুমুখী ব্যবহারের জন্য সরেজমিন পরিদর্শনের পর যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। বিষয়টি সংসদীয় কমিটিতে উত্থাপন করা হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। বাগেরহাটের নবাগত জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, নিরাপত্তার পাশাপাশি পর্যটন অর্থনীতির স্বার্থে ‘বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড’র অপার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে।
×