ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সিটের বদলে মোড়ায় বসিয়ে যাত্রী বহন!

নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা নেই, অবাধে চলছে হেলিকপ্টার সার্ভিস

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা নেই, অবাধে চলছে হেলিকপ্টার সার্ভিস

আজাদ সুলায়মান ॥ হেলিকপ্টারে সিট নেই তো কী হয়েছে, মোড়া তো আছে! তাতেই যাত্রী বসিয়ে নিন। মালিকের এমন নির্দেশে পাইলট বাধ্য হয়ে তাই করেছেন। মোড়ায় বসিয়ে ঢাকা থেকে খুলনা নিয়ে গেছেন নির্দিষ্ট আসনের অতিরিক্ত এক যাত্রীকে। সিভিল এ্যাভিয়েশনের আইন অমান্যের এটি একটি প্রকৃষ্ট নজির। দ্বিতীয় নজির হচ্ছে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাতের বেলায় হেলিকপ্টার চালানো। তৃতীয় হচ্ছে নিচু দিয়ে হেলিকপ্টার চালানো নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কয়েক ফুট উঁচু দিয়ে চালানো। আইকাওয়ের এমন অন্তত একুশটি শর্তাবলী অমান্য করে চলছে দেশের বাণিজ্যিক হেলিকপ্টার সার্ভিস। যার খেসারত দিতে হয়েছে মেঘনা এ্যাভিয়েশনের দুুটো হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় একজনের প্রাণহানি ও জনাদশেক আহত হওয়ার মধ্য দিয়ে। এ নিয়ে এতদিন কারও টনক নড়েনি। কিন্তু এ ধরনের আইনকানুন অমান্য করে হেলিকপ্টার চালানোয় সাকিব আল হাসানের মতো বিশ্ব খ্যাত ক্রিকেটারের জীবনও হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে। এখন সিভিল এ্যাভিয়েশনসহ টনক নড়েছে সংশ্লিষ্ট অনেকেরই। সিভিল এ্যাভিয়েশনও নড়েচড়ে বসেছে। এখন সবার টনক নড়ছে। দেশে বর্তমানে সাতটি কোম্পানির ২২ হেলিকপ্টার সার্ভিস চালু রয়েছে। আরও চারটি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। শাহজালাল বিমানবন্দরের দক্ষিণ পাশের পদ্মা অয়েলের ডিপোর কাছাকাছি এসব হেলিকপ্টারের জন্য পৃথক পৃথক নির্ধারিত হ্যাঙ্গার করা হয়েছে। মূলত এখানেই এসব হেলিকপ্টারের রক্ষণাবেক্ষণ ও সার্ভিসের কাজ চলে। কয়েকটি কোম্পানি অন্যের হ্যাঙ্গার ভাড়া নিয়ে তাদের কর্পোরেট কাজ চালাচ্ছে। রাজধানীর যানজট উপেক্ষা করে স্বল্প সময়ে কর্পোরেট কমিউনিকেশনের জন্য শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা এখন হেলিকপ্টার নির্ভর হয়ে পড়েছেন। এর পাশাপাশি রয়েছে বাণিজ্যিক সার্ভিস। এ সেক্টরে বর্তমানে হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে বলে দাবি করেছে হেলিকপ্টার সমিতি। এ বিষয়ে এক পাইলট ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কপ্টার মালিকরা সবাই প্রভাবশালী। কারও চেয়ে কেউ কম নন। যে কারণে তারা সিভিল এ্যাভিয়েশনের আইনের ধার ধারেন না। এমনকি যান্ত্রিক ত্রুটি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পরও পাইলটকে বাধ্য করা হয় সেটা নিয়ে ফ্লাই করতে। চাকরি রক্ষায় পাইলটকে ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও আকাশে চড়তে হয় দুরু দুরু বুকে। তবে মেঘনা এ্যাভিয়েশনের দুটো হেলিকপ্টারই দুঘর্টনার শিকার হওয়ায় এখন পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করেছে। কক্সবাজারে গত শুক্রবার মেঘনা এ্যাভিয়েশনের একটি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হওয়ার পর দেশের বাণিজ্যিক হেলিকপ্টার সার্ভিসের হালহলিকত সম্পর্কে অনুসন্ধান চালিয়ে এসব ভয়াবহ অনিয়ম অরাজকতার চিত্র ধরা পড়েছে। হেলিকপ্টার সার্ভিসগুলোর দেখভাল করার রেগুলেটর বডি সিভিল এ্যাভিয়েশনের ব্যর্থতাও চোখে পড়েছে। বার বার নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করার পরও কয়েকটি হেলিকপ্টার সার্ভিসকে আইনের আওতায় আনতে ব্যর্থ হচ্ছে সিভিল এ্যাভিয়েশন। জানা যায়, একদিকে সিভিল এ্যাভিয়েশনে পর্যাপ্ত দক্ষ জনবলের অভাব, অন্যদিকে সেফটি ও সিকিউরিটির সঙ্গে আপোস করার মতো জটিল সমস্যা নিয়ে চলছে এ সেক্টর। এতে হেলিকপ্টার ব্যবহারকারী পাইলট ও যাত্রী যেমন প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে রয়েছে, তেমনি অনেক সম্ভাবনার এই খাতে দেখা দিয়েছে দুর্ঘটনার আতঙ্ক। কক্সবাজারের দুর্ঘটনা হেলিকপ্টার ব্যবসায় বড় ধরনের আঘাতস্বরূপ উল্লেখ করে একটি কোম্পানির মালিক বলেছেন, এর দুই দিন পর ঢাকা থেকে এক শিল্পপতি খুলনা যাওয়ার জন্য পূর্বনির্ধারিত সিডিউল বাতিল করে সড়ক পথে গেছেন। অজানা আতঙ্ক ও আশঙ্কার মুখে এ ব্যবসায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। কী ধরনের আইন অমান্য করে চলছে হেলিকপ্টার সার্ভিসগুলোÑ এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিভিল এ্যাভিয়েশনের এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, হেলিকপ্টার ও বিমান চলাচলের জন্য আইকাও দুনিয়াব্যাপী কিছু বেসিক রুলস ও রেগুলেশন তৈরি করে দিয়েছে, যা অমান্য করার কোন সুযোগ নেই। অথচ বাংলাদেশে অহরহ এসব আইন অমান্যের ঘটনা ঘটছে। যেমন- নির্দিষ্ট আসনের বেশি একজন যাত্রীও হেলিকপ্টারে চড়ার কোন সুযোগ নেই। তারপরও এরো টেকনোলজি লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের হেলিকপ্টারে মোড়া বসিয়ে অতিরিক্ত সিট বানিয়ে তাতে যাত্রী বহন করার ঘটনাও সিভিল এ্যাভিয়েশনের কাছে রয়েছে। ওই ঘটনা তদন্ত করা হয়েছে। কিন্তু এ আইন অমান্যের জন্য ওই কোম্পানিকে সতর্ক করা ছাড়া আর কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারেনি সিভিল এ্যাভিয়েশন। কারণ ওই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার যারা তারা প্রভাবশালী। একইভাবে দিনের আলোতে চালানোর জন্য রয়েছে এক ধরনের ভিজুয়াল ফ্লাইট রুলস (ভিএফআর) এবং রাতের অন্ধকারে চালানোর জন্য রয়েছে ইন্সট্রুমেন্টাল ফ্লাইট রুলস (আইএফআর)। দুই ধরনের হেলিকপ্টারের টেকনিক্যাল ফেসিলিটিজ দুই ধরনের। বাংলাদেশের বেশির ভাগ হেলিকপ্টার হচ্ছে ভিএফআর মডেলের। শুধু আর এ্যান্ড আর এ্যাভিয়েশনের রয়েছে দুটো আইএফআর মডেলের বিশেষ হেলিকপ্টার, যা রাতের আঁধারে উড়তে পারে। কিন্তু এ আইনের তোয়াক্কা না করে ভিএফআর মডেলের হেলিকপ্টার অহরহ রাতে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। এতে যে কোন সময় আরও বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। কেন ভিএফআর মডেলের হেলিকপ্টার রাতে চালানো ঝুঁকিপূর্ণÑ জানতে চাইলে সিভিল এ্যাভিয়েশনের সাবেক এক ফ্লাইট ইন্সট্রাক্টর জনকণ্ঠকে বলেন, ভিএফআর হচ্ছে দিনের আলোতে দেখেশুনে ফ্লাই করা। আইএফআর মডেলের কপ্টার চালানো হয় ইন্সট্রুমেন্টাল ডিরেকশনে। এটা তৈরিই করা হয় আলাদা কিছু সুবিধাদিসহ। ম্যানুফ্যাকচার কোম্পানিগুলো এটা বিশেষ ফর্মুলায় তৈরি করে, যা ভিএফআর মডেলে থাকে না। রাতে চালানোর সময় দুজন পাইলট লাগে। দিনে একা হলেও চালানো যায়। অথচ দেশের সব কোম্পানির হেলিকপ্টার সার্ভিস এ আইন অমান্য করে সবার চোখের সামনে রাতে ফ্লাই করছে। এটার দেখভাল করার দায়িত্ব সিভিল এ্যাভিয়েশনের হলেও তারা চুপচাপ। তিনি জানান, আইকাও রুলস অনুযায়ী নিচু দিয়ে ফ্লাই করা খুবই বিপজ্জনক একটি কাজ। এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে খুবই। কক্সবাজারের উখিয়ার দুর্ঘটনা সর্বশেষ জ্বলন্ত নজির। কিন্তু দেশে এ রুলস প্রকাশ্যেই অমান্য করছে হেলিকপ্টার সার্ভিসগুলো। সাধারণত এক হাজার ফুট ওপর দিয়েই হেলিকপ্টার চালানোর নিয়ম থাকলে দেশে কখনও কখনও এক শ’ ফুট উপর দিয়ে চালানো হচ্ছে। কক্সবাজারে সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চালাতে গিয়ে বিধ্বস্ত হওয়া হেলিকপ্টারের যাত্রীরা এখন লো ফ্লাইংকে দায়ী করছেন।
×