ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদের মত

কানাডা তৃতীয় কোন দেশে নূর চৌধুরীকে পাঠালে ফেরত আনা সহজ

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

কানাডা তৃতীয় কোন দেশে নূর চৌধুরীকে পাঠালে ফেরত আনা সহজ

বিকাশ দত্ত ॥ বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃতি খুনী নূর চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনার একটাই সহজ উপায় তা হলো তাকে তৃতীয় কোন দেশে পাঠিয়ে দেয়া। কানাডা সরকার এই মুহূর্তে বাংলাদেশে না পাঠালেও তৃতীয় কোন দেশে পাঠাতে পারে। তৃতীয় দেশের সঙ্গে বন্দী বিনিময় চুক্তি থাকলে পরবর্তীতে বাংলাদেশে আনা সম্ভব। কানাডা যেহেতু মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিকে ফেরত পাঠায় না সে কারণেই এই উপায় বের করা যেতে পারে। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ জনকণ্ঠকে এই তথ্য প্রদান করেছেন। অন্যদিকে আইন বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, খুনী নূর চৌধুরীকে ফেরত আনতে হলে কানাডার সঙ্গে বন্দী বিনিময় চুক্তি করতে হবে। পাশাপাশি পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আরও উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে। শুক্রবার হায়াত রিজেন্সি মন্ট্রিয়লে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর মধ্যে বৈঠকে নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনার উপায় বের করতে মতৈক্য হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ বলেছেন, দুই দেশের সরকার যদি চায় তা হলে অবশ্যই সে উপায় বের করা যাবে। কানাডা মনে করছে কি পদ্ধতিতে নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশের ফেরত দেয়া যায়। ওরা মৃত্যুদ- মানে না। সে কারণে সরাসরি বাংলাদেশে পাঠাতে পারবে না। বাংলাদেশে না পাঠাতে পারলেও তাকে অন্য কোন দেশে পাঠাতে পারে। কানাডা খুনীদের আশ্রয় দেয় না। এ প্রমাণ পাওয়া যায় ইউনসর থেকে জ্যাকস মুঙ্গওয়ারি নামক এক রুয়ান্ডার নাগরিককে গ্রেফতার করার পর। জ্যাকসসহ অন্যান্যরা ১৯৯৪ সালে কিবাইয়ি সম্প্রদায়ের হাজার দুয়েক এথনিক তুতসিকে হত্যা করে যারা শরণার্থী হয়ে গির্জায় আশ্রয় নিয়েছিল। সেই খুনীদেরও কানাডা গ্রেফতার করেছে। এছাড়া কেউ সত্য গোপন করে কানাডার নাগরিকত্ব লাভ করলেও পরে ঘটনা জানাজানি হলে তার নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। ইউক্রেনের নাগরিক ওয়াসিল বাগুতিন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হিটলারের নাৎসির সহায়তাকারী নাগরিকত্ব পাওয়ার ৫০ বছর তার নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছিল কানাডা সরকার। তারপর তাকে কানাডা থেকে বহিষ্কার করা হয়। এ প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ বলেন, এ কারণেই কানাডা তৃতীয় কোন দেশে নূর চৌধুরীকে পাঠাতে পারে। সেই দেশের সঙ্গে চুক্তি থাকলে পরবর্তীতে ফেরত আনা যাবে। কানাডা বলেছে কি পদ্ধতিতে আনা যায়। এটা হতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তিনি আরও বলেন, এটুকু জানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনজীবী নিয়োগের জন্য কোন এক ফার্মকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। ওখানে যদি আইনী লড়াই শেষ হয়ে থাকে তা হলে কানাডা এই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। সরকার নূর চৈৗধুরীকে ফেরত আনার চেষ্টা করেছিল। তার পাসপোর্টও হাইকমিশনে জমা দেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে নূর আদালতের আশ্রয় নেয়। উল্লেখ্য, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকা-ের মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ১২ জনের মধ্যে ছয় জন বিদেশে পালিয়ে রয়েছে। এর মধ্যে একজন কানাডায়, ১ জন যুক্তরাষ্ট্রে, ২ জন পাকিস্তানে ও অপর দুইজনের সন্ধান পাওয়া যায়নি। পলাতকরা হলেন- কর্নেল (অব) খন্দকার আব্দুর রশিদ, লে. কর্নেল (অব) শরিফুল হক ডালিম, লে. কর্নেল (অব) এএম রাশেদ চৌধুরী, রিসালদার মোসলেম উদ্দিন, লে. কর্নেল (অব) এস এইচ নূর চৌধুরী ও অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ক্যাপ্টেন (অব) আব্দুল মাজেদ। ইতোমধ্যে ১২ খুনীর মধ্যে ৫ খুনীর ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। তারা হলেন, লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর (অব) বজলুল হুদা, লে. কর্নেল (অব) মহিউদ্দিন আহম্মেদ (আর্টিলারি) ও লে. কর্নেল (অব) একেএম মহিউদ্দিন আহম্মেদ (ল্যান্সার)। বাংলাদেশের সঙ্গে অন্যান্য দেশের বন্দী বিনিময় চুক্তি থাকলেও কানাডার সঙ্গে কোন চুক্তি নেই। এ প্রসঙ্গে সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন জনকণ্ঠকে বলেন, কানাডার সঙ্গে আমাদের বন্দী বিনিময় চুক্তি না থাকায় নূর চৌধুরীকে হস্তান্তর করা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের সঙ্গে চুক্তি থাকলেই সেটা সম্ভব হতো। কানাডার আইনে মৃত্যুদ-ের বিধান নেই। তাই বলে অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে তা নয়। আইনের সৃষ্টিই মানুষের জন্য। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। তাদের বিষয়ে কি হবে তা চিন্তা করতে হবে। কানাডা বলেছে দেখব। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি। সে জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবার সহযোগিতা চেয়েছেন। খুন করে কেই কানাডায় আশ্রয় নিবেন আর তাদের বিচার হবে না। তা হতে পারে না। এতে করে খুনীরা উৎসাহী হবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর একদল সদস্য ধানম-ির ৩২ নম্বরের বাড়িতে হানা দিয়ে বেশ কয়েকজন আত্মীয়-স্বজনসহ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। নিহত হন বঙ্গবন্ধুর ছোট ছেলে রাসেলসহ মোট ২৮ জন। সেদিন ৩২ নম্বর বাড়ির নিচতলা ও দোতলায় সিঁড়ির মাঝামাঝি অবস্থান নেন বজলুল হুদা ও নূর চৌধুরী। বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে আসার সময় স্টেনগান দিয়ে গুলি করে বজলুল হুদা ও নূর চৌধুরী। বঙ্গবন্ধুর বুকে ও পেটে ১৮টি গুলি লাগে। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে বত্রিশ নম্বরের সিঁড়িতে পড়ে থাকেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সারা সিঁড়ি ভেসে যায় রক্তে। সেই নূর চৌধুরী সম্পর্কে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের হিউম্যান রাইটস কমিটির চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না জনকণ্ঠকে বলেছেন, খুনী নূর চৌধুরীকে ফেরত আনতে দুই দেশের আইন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতাও বাড়াতে হবে। সমস্ত কিছু নির্ভর করছে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপর। আন্তর্জাতিক আইনে নূর চৌধুরী কানাডায় আশ্রয় নিয়েছে। কোন খুনী কানাডায় আশ্রয় নেবে আর তার বিরুদ্ধে কিছু করা যাবে না তা হয় না। এ ব্যাপারে কানাডার আইনজীবীদের এগিয়ে আসতে হবে। পলাতক অপর আসামি আব্দুল আজিজ পাশা জিম্বাবুয়েতে মারা যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ১৯৯৮ সালের ৮ নবেম্বর ঢাকার দায়রা জজ গোলাম রসুল ২০ আসামির ১৫ জনকে মৃত্যুদ- দেন। ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ এ মামলায় বিভক্ত রায় দেয়। ওই বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মোঃ রুহুল আমিন ১০ আসামির মৃত্যুদ- বহাল রাখেন। অন্য বিচারপতি এ বিএম খায়রুল হক ১৫ আসামির ফাঁসির আদেশই বহাল রাখেন। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম তার রায়ে ১২ আসামির মৃত্যুদ-াদেশ বহাল রেখে তিন আসামি মোঃ কিসমত হাসেম, আহমেদ শরিফুল হোসেন ও নাজমুল হোসেন আনসারকে খালাস দেন। মৃত্যুদ- বহাল থাকা কারাবন্দী চার আসামি বজলুল হুদা, সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও মহিউদ্দিন আহমেদ একই বছর আপীল বিভাগে আপীল দায়ের করেন। ২০০৭ সালের ১৮ জুন দেশে ফেরত আনার পর ওই বছরের ২৪ জুন ফাঁসির অপর আসামি এ কে এম মহিউদ্দিন আপীলের আবেদন করেন। ২০০৯ সালের ১৯ নবেম্বর বিচারপতি মোঃ তাফাজ্জাল ইসলাম, বিচারপতি মোঃ আবদুল আজিজ, বিচারপতি বি কে দাস, বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেন ও বিচারপতি এস কে সিনহার সমন্বয়ে গঠিত আপীল বিভাগের বিশেষ বেঞ্চ তাদের আপীল খারিজ করে। ফলে হত্যাকারীদের ফাঁসির হাইকোর্টের রায় বহাল থাকে। পাঁচ খুনীর ফাঁসি কার্যকর হলেও এখনও ছয় খুনী বিদেশে পালিয়ে রয়েছে। তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করতে সরকার দৃঢ়প্রতিঙ্গ। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হলে সরকারী চাকরীবিধি লংঘন করায় আজিজ পাশাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। একটি সূত্র জানিয়েছে শরিফুল ইসলাম ডালিম লিবিয়া ও কেনিয়ায় অগাধ সম্পদের মালিক হয়েছে। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপে তার যাতায়াত রয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত ১২ সেনা কর্মকর্তাকে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেয়া হয়েছিল। ১৯৭৬ সালে তাদের চাকরি দেয়ার পর ১৯৮০ সালে তাদের পররাষ্ট্র সার্ভিস ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মেজর (অব) খায়রুজ্জামান চাকরি হারান। এরপর ২০০১ সালে বিএনপি এবং জামায়াত সরকার ক্ষমতায় আসলে পুনরায় খায়রুজ্জামানকে পুনর্বহাল করা হয়। জাতীয় পার্টির সময় মেজর (অব) বজলুল হুদা এবং শাহরিয়ার রশিদ একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৮৬ সালে কর্নেল ফারুক রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নেন। ১৯৮৮ সালে মেজর বজলুল হুদা সংসদ নির্বাচন করেন। ১৯৯৬ সালের ভোটবিহীন নির্বাচনে কর্নেল রশিদকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।
×