ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পাঁচ বছরেও হয়নি শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো ;###;নীতিমালা হচ্ছে না কিন্ডারগার্টেনসহ ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষার ;###;অনিশ্চয়তায় কওমী সার্টিফিকেট

ঝুলে গেছে শিক্ষা খাত

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

ঝুলে গেছে শিক্ষা খাত

বিভাষ বাড়ৈ ॥ গত কয়েক বছর শিক্ষার উন্নয়নে পদক্ষেপ নিয়ে সরকার প্রশংসা কুড়ালেও ঝুলে গেছে এ খাতের জনসম্পৃক্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থেকে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বের হতে না পারা এবং কর্মকর্তাদের বিতর্কিত কর্মকা-ের কারণে সারাদেশে ব্যাপক জনসম্পৃক্ত কাজগুলো আলোর মুখ দেখছে না। সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের কাছে দেয়া এসব নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়ায় বাড়ছে অসন্তোষ। পাঁচ বছরে হয়নি শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো, শিক্ষা কর্ম-কমিশন আলোর মুখ দেখেনি ছয় বছরেও। ঝুলে আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি, পূরণ হচ্ছে না লাখ লাখ কারিগরি শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন, আটকে আছে ইংলিশ মিডিয়াম, কিন্ডারগার্টেন স্কুল নীতিমালা ও নিবন্ধনসহ আরও অনেক বড় কাজ। বলা হয়ে থাকে, ২০০৮ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পাঁচ বছর যে কয়েকজন মন্ত্রী সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রশংসা পেয়েছেন, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ তাদের একজন। ওই মেয়াদে ব্যাপক জনবল নিয়োগ ও নিয়োগে স্বচ্ছতা আসার কারণে প্রশংসা কুড়িয়েছেন তৎকালীন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী আফছারুল আমীন। এবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের ক্ষমতার মেয়াদে প্রাথমিকের দায়িত্বে এসেছেন মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার। শিক্ষার দায়িত্বে আছেন নুরুল ইসলাম নাহিদই। এবার দায়িত্ব নিয়েই শিক্ষায় দুজন তাদের সামনে চ্যালেঞ্জগুলোকে তুলে ধরেছিলেন। বলেছেন, সকল স্তরে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করাই শিক্ষায় তাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে একই সঙ্গে আগের মেয়াদে সরকার যেসব কাজ শুরু করলেও শেষ করতে পারেনি এবার তা সমাপ্ত করার ওপরও গুরুত্ব দিয়েছিলেন দুই মন্ত্রী। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অসাধু কর্মকর্তাদের তৎপরতা সরকারের কঠোর অবস্থানের অভাবে বছরের পর বছর ধরে ঝুলে আছে বড় কাজগুলো। কাজের যে বিশাল বোঝা ফাইলবন্দী হয়ে আছে তা কবে আলোর মুখ দেখবে তা জানে না কেউ। আদৌ ঝুলে থাকা জনসম্পৃক্ত কাজগুলো বাস্তবায়ন হবে কিনা, তার উত্তরও মিলছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি কবে হবে ॥ জানা গেছে, শিক্ষা খাতের কাক্সিক্ষত বিষয় নতুন এমপিওভুক্তি বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষা করেও হচ্ছে না। গেল মহাজোট সরকারের মেয়াদের প্রথম দিকেই মাত্র একধাপে এক হাজার ৬০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু তারপরই আটকে যায় প্রক্রিয়া। খোদ সরকারদলীয় সংসদ সদস্যরা বহুবার এ বিষয়টি জাতীয় সংসদে তুললেও ফল হয়নি। তারা সংসদে বহুবার বলেছেন, প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা না হওয়ায় নির্বাচনী এলাকার সাধারণ মানুষ সরকারের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছেন দিন দিন। বাজেট ঘোষণার আগে বিভিন্ন এলাকায় দাবি ওঠার প্রেক্ষাপটে সাংসদরা সংসদ অধিবেশনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য অর্থ বরাদ্দ চান; কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকারের কোন পর্যায় থেকেই ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। প্রতিদিনই সংসদ সদস্যরা অর্থ মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে একই দাবি তুলছেন। বলছেন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়ায় জনমনে অসন্তোষের কথাও। তবে তাদের অপেক্ষাতেই থাকতে হচ্ছে। পাঁচ বছরেও হয়নি শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো ॥ মহাজোট সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা। ২০১১ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত কমিটিও গঠন করে। কমিটির প্রথম বৈঠকের পর পার হয়ে গেছে পাঁচ বছর। অর্জন দু’একটি বৈঠকই। এরই মধ্যে নতুন বেতন স্কেল হয়েছে। স্কেলে বেতন ও মর্যাদা অবনমনের ঘটনা নিয়ে সৃষ্ট অসন্তোষ এখনও কমেনি। সঙ্কট নিরসনে শিক্ষকরা আলাদা বেতন কাঠামোর দাবি তুলেছেন। দাবি তুলেছেন আরও কিছু বিষয়ে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্যাদা রক্ষায় কিছু পদক্ষেপ নেয়া হলেও তা যথেষ্ট নয় বলে বলছেন শিক্ষকরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পে স্কেলে বেতন বিশাল বাড়িয়েও কেবল বণ্টন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা রাখতে না পারায় সফলতা ঘরে তুলতে পারেনি সরকার। শিক্ষকতায় মেধাবীদের আগ্রহী করে তুলতে এবং প্রচলিত বেতন কাঠামোর বিভিন্ন অসামঞ্জস্য দূর করতে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়নের দাবিতে শিক্ষকরা দুই যুগ ধরে আন্দোলন করছেন। শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো ও পৃথক কর্ম-কমিশন গঠনের কথা সরকারের মন্ত্রীরাও বলেছেন বহুবার; কিন্ত এখন হতাশ শিক্ষক সমাজ। শিক্ষা কর্ম-কমিশনের খবর নেই, বিকল্প নিয়েও সঙ্কট ॥ জাতীয় শিক্ষানীতির সুপারিশ, শিক্ষাবিদ ও শিক্ষকদের দাবি সত্যেও শেষ পর্যন্ত ঝুলেই গেছে শিক্ষক নিয়োগে বহু প্রতীক্ষিত শিক্ষা কর্ম-কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া। জাতীয় শিক্ষানীতি এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের দীর্ঘদিনের এই দাবি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত হওয়ার পরও বছরের পর বছর ধরে এ সংক্রান্ত সকল কাজ রীতিমতো বন্ধ হয়ে আছে। এমনকি কমিশন গঠনের বিষয়ে সচিব কমিটির অনুমোদনের পরও চলে গেছে তিন বছর। কমিশন গঠনের কাজ আগানোর পরিবর্তে এখন বেসরকারী শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা নিয়ে যে প্রক্রিয়ায় নিয়োগের কথা বলা হচ্ছেÑ তা নিয়েও বেধেছে জটিলতা। জাতীয় শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) অধীনে নিয়োগের কথা বলা হলেও দিনের পর দিন অপেক্ষা করছেন আবেদনকারীরা। কোথায়, কিভাবে, কবে আসলে নিয়োগ হবে, তার উত্তর নেই কারও কাছে। আবার নিবন্ধনকারী ওই প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় শত শত সনদ জালিয়াতির তথ্য বেরিয়ে আসায় নিয়োগের স্বচ্ছতা নিয়েই সন্দিহান সারাদেশের লাখ লাখ আবেদনকারী। এদিকে শিক্ষানীতির সুপারিশ অনুসারে কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করার পর ঝুলে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্যসহ শিক্ষাবিদরা। ক্ষুব্ধ শিক্ষক সংগঠনের নেতারাও। কমিশন গঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষাবিদদের সুপারিশ মেনেই দ্রুত কাজ শেষ করার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল সরকার। সে অনুসারে ২০১২ সালের ১৬ অক্টোবর শিক্ষক নিয়োগে পৃথক কর্ম-কমিশন গঠনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব অনুমোদন করে সরকারের সচিব কমিটি। কমিটি একই সঙ্গে সেদিন শিক্ষা কর্ম-কমিশন গঠনের সারসংক্ষেপ যাচাই-বাছাই করে মতামত দেয়ার জন্য আইন মন্ত্রণালয়েও পাঠিয়েছিল। কিন্তু সে পর্যন্তই। কিছু আমলার ফাইল চালাচালির মধ্যেই এখন আটকে আছে বহু প্রতীক্ষিত শিক্ষা কর্ম-কমিশন গঠন প্রক্রিয়া। অথচ সব খাতের নিয়োগ সরকারী কর্ম-কমিশন (পিএসসি) দেখাশোনা করায় সঙ্কট বাধে নিয়োগে। পরীক্ষা শেষ করে নিয়োগ সম্পন্ন করতে তিন মাসের স্থলে লেগে যাচ্ছে এক থেকে দেড় বছর। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সচিবদের সভায় শিক্ষা খাতে পৃথক কর্ম-কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। এখন পর্যন্ত কমিশনের কাজের অগ্রগতি দৃশ্যমান না হওয়ায় হতাশ শিক্ষক, শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষা কমিশন গঠনের খবর শুনে সকলের মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু কার্যক্রম থমকে যাওয়ায় শিক্ষক সমাজ হতাশ। ইংরেজী মিডিয়াম স্কুল নীতিমালা ও নিবন্ধন ফাইলবন্দী ॥ উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পর তিন বছর চলে গেলেও ইংরেজী মাধ্যমের স্কুল পরিচালনায় নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারেনি শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিএনপি-জামায়াতপন্থী আমলাদের উদ্দেশ্যমূলক গাফিলতি এবং ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলের কর্তাব্যক্তিদের তদবিরের জোরেই এ কার্যক্রম ঝুলে রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অথচ নীতিমালা প্রণয়নের নামে সভা, কর্মশালা এ ধরনের কাজে নিয়মিত মোটা অংকের অর্থও ব্যয় হচ্ছে। নীতিমালা না থাকায় শিক্ষার্থীদের উগ্র-মতবাদে উদ্বুদ্ধ করা, ইচ্ছেমতো টিউশন ফি আদায়, অনুমোদনহীন পাঠ্যসূচী পাঠদান, জাতীয় দিবস পালন না করা ও জাতীয় সঙ্গীতের প্রতি অবজ্ঞা করাসহ নানান ধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থায় পরিচালিত হচ্ছে ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলগুলো। কার্যত এ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণই নেই। ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবির বলছিলেন, শিক্ষানীতির একটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল কিন্ডারগার্টেন থেকে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই নিবন্ধিত হতে হবে। কিন্তু ইংরেজী মাধ্যম স্কুলের ক্ষেত্রে সেটা আমরা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। এমনকি শিক্ষা আইনও করা হলো না এখন পর্যন্ত। যেভাবেই হোক এটা বারবার আটকে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্দেশ্য সফল হবে না। জানা গেছে, নিবন্ধনহীন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের তালিকা এবং এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত শিক্ষা বোর্ডের কাছেও নেই। মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা অধিদফতরের কর্তৃপক্ষও এ সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না। অন্যদিকে শিক্ষা বিস্তারের নামে এসব প্রতিষ্ঠান বেপরোয়া শিক্ষা বাণিজ্যে লিপ্ত এবং শিক্ষাকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করছে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল পরিচালনায় ২০০৭ সালের একটি নীতিমালা এমনিতেই আছে। এরপরও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালার খসড়া তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছিল। সেটি এখনও চূড়ান্ত করা হয়নি। জানা গেছে, ২০১১ সালে শিক্ষা বোর্ডগুলো অবৈধভাবে পরিচালিত হওয়া ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল এসব স্কুলের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা এবং ভর্তি ফি ও মাসিক বেতনের ওপর সরকারের কর্তৃত্ব আরোপ। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে দেশে পরিচালিত ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলের জন্য একটি পৃথক নীতিমালা প্রণয়নের জন্য নির্দেশনা দেয় উচ্চ আদালত। সে অনুযায়ী দ্রুতই ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ইংরেজী মাধ্যম স্কুলের জন্য খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট অনুবিভাগের কর্মকর্তারা এ নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখাননি। শিক্ষামন্ত্রী এই নীতিমালা চূড়ান্ত করতে কয়েক দফা তাগাদা দিলেও ফাইল নড়েনি। মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক শাখার দুজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ও কলেজ শাখার এক কর্মকর্তা ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলের মালিকদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে এ সংক্রান্ত নীতিমালার খসড়া ফাইলবন্দী করে রেখেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কিন্ডারগার্টেন স্কুল নীতিমালা ও নিবন্ধনেও সঙ্কট ॥ কিন্ডারগার্টেন স্কুল নীতিমালা কার্যকর ও নিবন্ধনের কাজ ঝুলে আছে পাঁচ বছর ধরে। ২০১১ সালে একটি নীতিমালা করে নিবন্ধনের নির্দেশ দেয়া হলেও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গাফিলতির কারণে এখনও পর্যন্ত তাতে কেউ সাড়া দিচ্ছে না। একটি নীতিমালা ঘোষণা করেই বসে আছে মন্ত্রণালয়। তা কার্যকর করার পরিবর্তে বরং নিবন্ধনহীন প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি বাস্তবায়ন করতে দিয়ে নীতিমালায় সংশোধনী আনা নিয়েই কর্মকর্তারা ব্যস্ত। ফলে অনুমোদন ছাড়াই ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা নার্সারি, প্রিপারেটরি ও কিন্ডারগার্টেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চলছে। এদিকে নীতিমালা বাস্তবায়নের পরিবর্তে সম্প্রতি নিবন্ধন জটিলতা নিরসনে করণীয় নির্ধারণে টাস্কফোর্স গঠন করেছে মন্ত্রণালয়। বিভাগীয়, জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে তিন ধরনের টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করে আদেশ জারি করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, নার্সারি, প্রিপারেটরি ও কিন্ডারগার্টেনগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনতে ২০১১ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় নিবন্ধন বিধিমালা জারি করলেও এখন পর্যন্ত তাতে সাড়া মেলেনি। অধিকাংশ নার্সারি, প্রিপারেটরি ও কিন্ডারগার্টেন সরকারের নিবন্ধনের আওতায় আসেনি। দেশে কতগুলো কিন্ডারগার্টেন রয়েছে তার সঠিক তথ্যও সরকারের কাছে নেই। এমন এক অবস্থায় মন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স গঠন করল। মন্ত্রণালয়ের আদেশে বলা হয়েছেÑ আশা করা হয়েছিল যে, জারিকৃত বিধিমালার আলোকে নার্সারি, প্রিপারেটরি বা কিন্ডারগার্টেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিবন্ধিত ও পরিচালিত হবে। কিন্তু বিধিমালা উপেক্ষা করে বেসরকারী উদ্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে এবং নিয়মবহির্ভূতভাবে পরিচালিত হচ্ছে। লক্ষ্য করা যায়, এসব বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সুবিধা, ছাত্রছাত্রী ভর্তি, ভর্তি ফি নির্ধারণ, প্রযুক্তি ব্যবহার এবং পাঠ্যবই অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না। অন্যদিকে পাঠ্য বইয়ের আধিক্যে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর মানসিক চাপ বাড়ছে বলে সংবাদে প্রকাশিত হচ্ছে। টাস্কফোর্স কমিটিগুলোকে সংশ্লিষ্ট এলাকার বাংলা ও ইংরেজী মাধ্যমের নার্সারি, প্রিপারেটরি ও কিন্ডারগার্টেনসহ সব ধরনের বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমতি বা নিবন্ধন সংক্রান্ত কাগজপত্র পরীক্ষা ও বিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা নিরূপণ করতে বলা হয়েছে। লাখ লাখ কারিগরি শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণ কবে ॥ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা আর প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-গুলোর অসহযোগিতায় পূরণ হচ্ছে না দেশের লাখ লাখ কারিগরি ডিপ্লোমাধারী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন। উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেয়ার বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ বছরেও বাস্তবায়ন করেনি দেশের কোন প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও এ নিয়ে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল তাদের অধিকাংশই জানেন না মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য এ ধরনের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কোন কোন কর্মকর্তারা অবশ্য বলেছেন, জাতীয় বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ অনুসারে উদ্যোগ নিলেও তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। তাদের অসহযোগিতার কারণেই বন্ধ হয়ে আছে কাজ। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিমাতাসূলভ আচরণে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ছে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে। আন্দোলন শুরু করছে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের এনভায়রনমেন্টাল টেকনোলজিসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদসহ সরকারের সংশ্লিষ্টরা প্রতিনিয়ত নানা উদ্যাগের কথা বললেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টিতে মন্ত্রণালয়ের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উদ্যোগ সফল হতে দিচ্ছেন না। সরকারের এ উদ্যোগ সফল হলে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ও ভুঁইফোঁড় কারিগরি ইনস্টিটিউটের শিক্ষা বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে তাই এসব প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছেন অসৎ কর্মকর্তার। কারিগরি শিক্ষার এ দাবি বাস্তবায়ন আন্দোলনের সঙ্গে সব সময় ছিলেন বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি ও শ্যামলী আইডিয়াল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ এমএ সাত্তার। সার্বিক পরিস্থিতিতে হতাশা প্রকাশ করে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, বহু বছরের দাবি অনুযায়ী এ উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। কিন্তু তাও বাস্তবায়ন হবে বলে মনে হচ্ছে না। বিষয়টিতে তিনি অবিলম্বে শিক্ষামন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। মৌলবাদীদের হুমকিতে কওমির শিক্ষার্থীদের সনদ স্বীকৃতি বন্ধ ॥ বছরের পর বছর ধরে আশার আলো দেখলেও এখন পর্যন্ত কিছু মৌলবাদী ধর্ম ব্যবসায়ীর হুমকিতে হাজার হাজার কওমি মাদ্রাসা ও এর শিক্ষার্থীদের সনদের সরকারী স্বীকৃতির উদ্যোগ থেকে সরে এসেছে সরকার। জামায়াত মদদপুষ্ট বিতর্কিত কিছু হেফাজত নেতার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির কবলে পড়ে কপাল পুড়েছে কওমি মাদ্রাসার ৫০ লক্ষাধিক সাধারণ শিক্ষার্থীর। কওমি মাদ্রাসার উন্নয়ন সাধারণ মানুষ চাইলেও হেফাজত নেতা নামধারী জামায়াতপন্থী নিয়ন্ত্রকরা চাচ্ছেন নিজেদের স্বার্থে গরিব ও অসহায় শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করতে। এ লক্ষ্যেই হেফাজতের ব্যানারে হুমকি দেয়া হয়, স্বীকৃতি দিলে দেশে লাখ লাখ লাশ পড়বে। এ হুমকিতেই নতুন করে ঝামেলা এড়াতে অবস্থান থেকে আপাতত সরে এসেছে সরকার। জানা গেছে, স্বীকৃতি দান প্রক্রিয়া আপাতত বন্ধ আছে। এর এর ফলে অর্ধকোটি গরিব ও এতিম শিক্ষার্থীর স্বপ্নের সনদের সরকারী অনুমোদন হচ্ছে না। অথচ স্বীকৃতি পেলে সরকারী-বেসরকারী চাকরির সুযোগ নিশ্চিত হতো, আর্থিকভাবেও তারা স্বাবলম্বী হয়ে দাঁড়াতে পারত। কিছু ধর্ম ব্যবসায়ী সনদের বিরোধিতা ও হুমকিতে সরকার পিছু হঠায় ক্ষুব্ধ ও হতাশ সনদের স্বীকৃতি দানের জন্য বছরের পর বছর ধরে আন্দোলনরত মাদ্রাসার সকল সংগঠন। ক্ষুব্ধ শান্তিপ্রিয় আলেম-ওলামাসহ দেশের বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদরাও। ঝুলে থাকা কাজে গতি আনার চেষ্টা ॥ দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা কাজে গতি আনার উদ্যোগ নিয়েছে বলে দাবি করেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। এ লক্ষ্যে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে চিহ্নিত করা হয়েছে অন্তত ১২টি বিষয়কে। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে দ্রুত সমস্যার সমাধান ও সরকারের নেয়া উদ্যোগ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মন্ত্রী কাজ শুরু করেছেন। জানা গেছে, শিক্ষক অসন্তোষ, শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন, বেসরকারী শিক্ষক নিয়োগে আলাদা কমিশন গঠন, শিক্ষা আইন ও পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ দ্রুত শেষ করতে চায় সরকার। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো বলছে, কাজ দ্রুত শেষ করতে দুটি বিশেষ বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তার কাছে অনানুষ্ঠানিক নোট দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। যেখানে মন্ত্রী তুলে ধরেছেন দেশের উন্নয়নে সরকারের অঙ্গীকারের কথা। তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে শিক্ষার উন্নয়নে নেয়া কাজগুলোর কথাও। মন্ত্রী সকল কর্মকর্তার উদ্দেশে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিগত প্রায় পৌনে সাত বছরে জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে এক বিরাট ও যুগান্তকারী উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। উন্নত দেশ গঠন এবং উন্নয়নের যে প্রক্রিয়া চলছে তার মাধ্যমে আমাদের জাতির সামনে এক অভূত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। আমাদের শিক্ষা পরিবারের দায়িত্বশীল সকল সদস্যের এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে কাজ করতে হবে এবং সকল সদস্যকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সকল মহলকে প্রস্তুত করতে হবে। ভাল কাজে পুরস্কৃত করার ইঙ্গিত দিয়ে মন্ত্রী বলেছেন, যারা কাজে সফল হবেন, আন্তরিকভাবে চেষ্টা করবেন, তাদের সম্মানিত করা হবে। যারা ব্যর্থ হবেন তাদের জবাবদিহি করতে হবে। মন্ত্রীও এ জবাবদিহিতার উর্ধে নন। এদিকে নির্দিষ্ট করে ঝুলে থাকা কাজ নিয়ে না আগালেও গুরুত্বপূর্ণ সকল কাজেই হাত দিতে চায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হঠাৎই নতুন নতুন জটিলতা সামনে চলে আসায় পুরনো কাজ আগানো নিয়ে অনেকটা হিমশিম খাচ্ছে এ মন্ত্রণালয়।
×