ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

চাহিদা পূরণে উৎপাদন বাড়াতে হবে ৩ গুণ;###;এ বিষয়ে মতামত নিচ্ছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়

জাতীয় দুগ্ধ উন্নয়ন নীতিমালা হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৪:১১, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

জাতীয় দুগ্ধ উন্নয়ন নীতিমালা হচ্ছে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ দেশে দুধের চাহিদার বিপুল ঘাটতি মেটাতে জাতীয় দুগ্ধ উন্নয়ন নীতিমালা করছে সরকার। খসড়া নীতিমালায় ‘জাতীয় দুগ্ধ উন্নয়ন বোর্ড’ ও ‘জাতীয় দুগ্ধ গবেষণা প্রতিষ্ঠান’ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। ‘জাতীয় দুগ্ধ উন্নয়ন নীতিমালা, ২০১৬’-এর খসড়া তৈরির পর এখন এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের মতামত নিচ্ছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে জাতীয় দুগ্ধ উন্নয়ন বোর্ড গঠনের জন্য আলাদা একটি আইনের খসড়া প্রণয়নের কাজও করছে মন্ত্রণালয়। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব কামরুজ্জামান বলেন, ‘জাতীয় দুগ্ধ উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে। সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এটি শিগগিরই চূড়ান্ত করা হবে।’ দুগ্ধ খামারিদের বীমার আওতায় নিয়ে আসার উদ্যোগ গ্রহণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষীদের দুগ্ধ খামার স্থাপনে উদ্বুদ্ধকরণের কথা বলা হয়েছে নীতিমালায়। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ‘বর্তমানে বাংলাদেশে বছরে দুধ উৎপাদনের পরিমাণ ৫০ লাখ টনের কিছু বেশি। চাহিদা এক কোটি ৩০ লাখ ২ হাজার টন। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন অনেক কম হওয়ায় ঘাটতি প্রায় ৬১ শতাংশ। জাতীয় চাহিদা পূরণ করতে হলে দুধের উৎপাদন আরও প্রায় ৩ গুণ বাড়াতে হবে। তরল দুধের ঘাটতির কারণে প্রতিবছর ব্যবসায়ীরা প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার গুঁড়ো দুধ বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রেই আমদানি করা গুঁড়ো দুধ নিম্নমানের হয়ে থাকে বলে তা স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ বাংলাদেশের দুগ্ধশিল্প ব্যাপক সমস্যায় জর্জরিত, যার ফলে সরকারের অনেক চেষ্টার ফলেও কাক্সিক্ষত উন্নয়ন হচ্ছে না জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের দেশে উন্নত জাতের গাভীর অভাব, গো-খাদ্যের অপ্রতুলতা এবং উচ্চমূল্য, মানসম্পন্ন খাদ্যের অভাব, প্রান্তিক খামারিদের জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব, রোগের প্রাদুর্ভাব, ভ্যাকসিনের অভাব, ওষুধের উচ্চমূল্য, দক্ষ জনবলের অপ্রতুলতা, অল্প সুদের ব্যাংক ঋণের অভাব, গাভী বীমা না থাকা, দুধ এবং দুগ্ধজাত দ্রব্য সংরক্ষণ এবং মান নিয়ন্ত্রণের সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে।’ তাই দুগ্ধশিল্পের সামগ্রির উন্নয়ন ও গতিশীলতার জন্য দুগ্ধ উন্নয়ন নীতিমালা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। খসড়া নীতিতে ডেইরি শিল্পের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে দুগ্ধনীতিতে সব কার্যকলাপ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন ও তদারকিতে দেশে একটি জাতীয় দুগ্ধ উন্নয়ন বোর্ড গঠন ও বোর্ড পরিচালনার লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন করার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া দুগ্ধশিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রের গবেষণার জন্য দেশে একটি জাতীয় দুগ্ধ গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ গ্রহণ করার কথাও বলা হয়েছে নীতিমালায়। দুধের চর্বির ওপর ভিত্তি করে দুধের মূল্য নির্ধারণ করার কথাও নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে। নীতিমালায় বলা হয়েছে, দুগ্ধশিল্পে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে কৃষি সেক্টরের মতো সুযোগ-সুবিধা দেয়া হবে। দুগ্ধশিল্পের যন্ত্রপাতি যদি কোন প্রতিষ্ঠান দেশে উৎপাদন করতে চায় তবে সেই প্রতিষ্ঠানকে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা দেয়া হবে। বাণিজ্যিক খামারিদের সরকারী ও বেসরকারী বীমা কোম্পানির মাধ্যমে বীমা সুবিধা দিতে উদ্যোগ নেয়া হবে। এ ছাড়া দুগ্ধশিল্পে নিয়োজিত পুঁজির ওপর কৃষির ন্যায় কর সুযোগ-সুবিধা প্রদান, দুগ্ধশিল্পকে প্রাণিজ কৃষি খাত হিসেবে সকল ক্ষেত্রে শস্য খাতের মতো সুযোগ-সুবিধা দিতে উদ্যোগ নেয়া হবে। গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া -এই চার ধরনের প্রাণী আমাদের দেশে দুধাল জাতের প্রাণী হিসেবে স্বীকৃত। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ২ কোটি ৩১ লাখ ২১ হাজার গরু, ১৩ লাখ ৯৪ হাজার মহিষ এবং ২ কোটি ৪১ লাখ ৪৯ হাজার ছাগল ও ৩০ লাখ ৮০ হাজার ভেড়া রয়েছে। বছরে দুধ উৎপাদনের প্রায় ৯২ শতাংশ আসে গাভী থেকে এবং বাকি ৮ শতাংশ আসে মহিষ, ছাগল ও ভেড়া থেকে। উৎপাদিত দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের ভৌত, রাসায়নিক ও মাইক্রোবায়োলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মাধমে গুণগত মান যাচাই করে মানসম্পন্ন খাদ্যের নিশ্চিত করার কথা জানিয়ে নীতিমালায় বলা হয়, গো-খাদ্যের গুণগত মান রাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত এবং দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যাদির ভেজাল প্রতিরোধে বাজার থেকে এসব দ্রব্যাদি সংগ্রহ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। দুগ্ধ ক্ষেত্রকে জাতীয় গুরুত্ব দিয়ে ‘জরুরী সেক্টর’ হিসেবে চিহ্নিত করার কথা বলা হয়েছে নীতিমালায়। এতে আরও বলা হয়, সমবায়ভিত্তিক দুধ উৎপাদন কার্যক্রম সারাদেশে সম্প্রসারণ, এ ক্ষেত্রে বহির্বিশ্বের দেশের তিন স্তরবিশিষ্ট সমবায় মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে। প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারীদের ন্যায্য মূল্য প্রতিযোগিতামূলক বাজার অবস্থার আলোকে নিশ্চিত করা। বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত মাঝারি ও বৃহদাকার খামারগুলো জনবসতি, রেললাইন, মহাসড়ক থেকে কমপক্ষে ৫০০ মিটার দূরে স্থাপন করার কথার উল্লেখ করা হয়েছে খসড়া নীতিমালায়। এতে আরও বলা হয়েছে, বাণিজ্যিক খামারগুলোকে সংশ্লিষ্ট অধিদফতরের রেজিস্ট্রেশনের অধীনে রাখা। খামারের নির্ধারিত স্থানে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে বর্জ্য অপসারণের ব্যবস্থা রাখা। সমবায়ভিত্তিক দুগ্ধ উন্নয়ন পরিকল্পনা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ধীরে ধীরে সম্প্রসারণ করা। বিদেশ থেকে তরল ও গুঁড়ো দুধ আমদানি নিরুৎসাহিত করা। উন্নত জাতের গাভী উৎপাদন, উন্নত দুধাল জাতের মহিষের জাত তৈরি ও সংখ্যা বৃদ্ধিকরণ, সরকারী পর্যায়ে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মাধ্যমে প্রতি উপজেলায় ঘাস চাষের জন্য কর্মসূচী বা গ্রকল্প গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে নীতিমালায়। নীতিমালা অনুযায়ী, যেসব গোচারণ-ভূমি ভুয়া দলিলের মাধ্যমে দখল হয়ে গেছে তা পুনরুদ্ধারের ব্যবস্থা করা এবং ভবিষ্যতে যাতে এভাবে গোচারণ-ভূমি না কমে সেজন্য নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে।
×