ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকাস্থ পাক ন্যাশনাল ব্যাংক হাজার কোটি টাকা ঋণ দিল কাকে !

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬

ঢাকাস্থ পাক ন্যাশনাল ব্যাংক হাজার কোটি টাকা ঋণ দিল কাকে !

রহিম শেখ ॥ অনিয়ম, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, ধারাবাহিক লোকসান ও বড় ধরনের ঋণ ঝুঁকিতে পড়েছে বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনাকারী বিদেশী খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান (এনবিপি)। এ মুহূর্তে বিদেশী খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। খেলাপী ঋণের হারে শীর্ষ ১০ ব্যাংকের মধ্যে ৮৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ খেলাপী ঋণ নিয়ে ১০ ব্যাংকের মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে ব্যাংকটি। ব্যাংকটির খেলাপী ঋণের শতভাগই মন্দঋণে রূপান্তরিত হয়েছে, যা আদায়ের সম্ভাবনা খুবই কম। এ বিপুল অঙ্কের খেলাপী ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের প্রভিশনের ঘাটতি রয়েছে প্রায় সাড়ে ৩শ’ কোটি টাকা। এ ঘাটতি পূরণে বাংলাদেশ ইউনিটের শাখা থেকে পাকিস্তানে চিঠি দেয়া হয়েছে। এদিকে, ২০১৫ সালে লোকসান দিয়েছে ৩৪ কোটি ১১ লাখ টাকা। তবে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের (এসবিপি) সুপারভিশন এ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্ট বলছে, বাংলাদেশে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান (এনবিপি) লোকসান দিয়েছে এক হাজার ৮৫০ কোটি রুপী। এ অর্থ লোকসান হয়েছে না-কি দুর্নীতি হয়েছে তা নিয়ে তদন্ত চলছে। জানা গেছে, দুর্বল ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকিতে পড়েছে বাংলাদেশে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের (এনবিপি) কার্যক্রম। বড় কিছু গ্রাহক মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় ও নতুন গ্রাহক ধরতে না পারায় বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে লোকসান গুনতে হচ্ছে ব্যাংকটিকে। বাংলাদেশের ৫৬ ব্যাংকের মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের অবস্থান সবচেয়ে তলানিতে। বিদেশী ৯ ব্যাংকের মধ্যেও ব্যাংকটির অবস্থান সবচেয়ে নাজুক। ঢাকা, গুলশান, চট্টগ্রাম ও সিলেট শাখার মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে এনবিপি। মূলত অন্য দেশের আমানতেই পরিচালিত হয় ব্যাংকটি। ২০০৮ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে ব্যাংকটির খেলাপী ঋণ বাড়তে থাকে। ২০১০ সালের পর ক্রমান্বয়ে খেলাপী ঋণ বাড়ছে। চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান ঋণ বিতরণ করেছে এক হাজার ৫০২ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এর মধ্যে এক হাজার ৩৩৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকাই চলে গেছে খেলাপীর খাতায়। খেলাপী ঋণের হার ৮৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ, যা দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপী ঋণের সর্বোচ্চ হার। এছাড়া ব্যাংকটির খেলাপী ঋণের শতভাগই মন্দঋণে রূপান্তরিত হয়েছে, যা আদায়ের সম্ভাবনা খুবই কম। কেন এ টাকা মন্দঋণ হলো এবং কোথায় গেল এ টাকা- এ নিয়ে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না। এ বিপুল অঙ্কের খেলাপী ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের প্রভিশনের ঘাটতি রয়েছে প্রায় সাড়ে ৪শ’ কোটি টাকা। এ ঘাটতি পূরণে তাগিদ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, প্রভিশন সংরক্ষণ করতে না পারলে ব্যাংকটি তলানিতে পড়ে যাবে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের গুলশানের আঞ্চলিক প্রধান শাখায় চিঠি পাঠানো হয়। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা জনকণ্ঠকে বলেন, প্রভিশন সংরক্ষণের জন্য আমরা চিঠি দিয়েছি। এরচেয়ে বেশি কিছু বলা সম্ভব নয় বলে তিনি জানান। এদিকে, প্রতি বছর বড় অঙ্কের লোকসান গুনছে ব্যাংকটি। ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান ২০১৫ সালে লোকসান দিয়েছে ৩৪ কোটি ১১ লাখ টাকা। তবে খোদ স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের (এসবিপি) সুপারভিশন এ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্ট বলছে, বাংলাদেশে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান (এনবিপি) লোকসান দিয়েছে এক হাজার ৮৫০ কোটি রুপী। বাংলাদেশী টাকায় দুই হাজার কোটি টাকার বেশি। এ অর্থ লোকসান হয়েছে না-কি দুর্নীতি হয়েছে তা নিয়ে তদন্ত করছে আন্তর্জাতিক অডিট প্রতিষ্ঠান কেপিএমজি। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র বলছে, মূলত ২০০৭ সাল থেকে বাংলাদেশ শাখায় সমস্যা শুরু হয় খেলাপী ঋণ নিয়ে। ওই সময় ১৯টি অভিযোগ প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হলেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। জানা গেছে, ২০০৩ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সময়ে এনবিপির বাংলাদেশ শাখা প্রয়োজনীয় জামানত ছাড়াই সন্দেহপূর্ণ বেশকিছু কোম্পানিকে ঋণ দেয়। বর্তমানে আর্থিক খাতের শীর্ষে থাকা বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ওই সময় এনবিপির এ কার্যক্রমের দায়িত্বে ছিলেন। সূত্র জানায়, ওই সময়ের ঋণ শাখা এবং বিদেশী কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে থাকা প্রধান কর্মকর্তারা এবার তদন্তের আওতায় এসেছেন। ওই সময়ে প্রয়োজনীয় জামানত ছাড়াই যে ঋণ দেয়া হয়েছে তাতে উর্ধতন এ কর্মকর্তাদের কোন গাফিলতি ছিল কি-না কিংবা তারা তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন কি-না এ বিষয়টি তদন্ত করছে। সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তাানের (এনবিপি) বাংলাদেশ শাখায় বড় অঙ্কের লোকসানের জন্য ৬১ কর্মকর্তাকে দায়ী করে রিপোর্ট দেয় পাকিস্তানের একটি পার্লামেন্টারি প্যানেল। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এনবিপির বাংলাদেশ শাখায় লোকসানের সঙ্গে জড়িত রয়েছে ব্যাংকের ৬১ জন কর্মকর্তা। যারা শুধু বাংলাদেশ শাখায় নয়, আঞ্চলিক অফিস বাহরাইন এবং প্রধান কার্যালয় করাচীতেও ছিলেন। এদিকে, ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের প্রাথমিক তথ্যেও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণেই ক্ষতি হওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। পরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত ডিসেম্বরের মধ্যে এনবিপিকে একটি কর্মপরিকল্পনা জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়। এ বিষয়ে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের প্রধান অর্থ ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ খবিরুল হক খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। ব্যাংকটির গুলশান শাখা ও মতিঝিল শাখায় ফোন দিলেও কেউ কথা বলতে রাজি হননি।
×