ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আজিমপুরের জঙ্গী আস্তানা ছিল নব্য জেএমবির কমান্ড সেন্টার

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬

আজিমপুরের জঙ্গী আস্তানা ছিল নব্য জেএমবির কমান্ড সেন্টার

শংকর কুমার দে ॥ রাজধানীর আজিমপুরের জঙ্গী আস্তানাটি ছিল নব্য জেএমবিদের জঙ্গী হামলার কমান্ড সেন্টার। এ জঙ্গী কমান্ড সেন্টারে অবস্থান করে পরবর্তী জঙ্গী হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছে- এমন তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। এ জঙ্গী সংগঠনটির গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ অন্তত পাঁচ জঙ্গী নেতার দম্পতিকে খুঁজছেন গোয়েন্দারা। এ জঙ্গী দম্পতিরা সবাই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ও আত্মঘাতী দলের সদস্য। পুলিশী অভিযানের সময় আটক চৌদ্দ বছর বয়সী জেএমবির সদস্য তাহরিম কাদেরী ওরফে রাসেলকে রবিবার আদালত থেকে তিন দিনের রিমান্ডে এনে এ ধরনের তথ্য পেয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা। রিমান্ডে আনা চৌদ্দ বছর বয়সী তাহরিম কাদেরীর বাবা, মা, ভাইসহ পরিবারের সবাই জঙ্গী বলে তথ্য দিয়েছে সে। তবে এ জঙ্গী আস্তানা থেকে আত্মগোপনে চলে যাওয়া মিরপুরে নিহত জঙ্গী মেজর জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার শীলা দশ মাস বয়সী শিশুসন্তান নিয়ে অন্য এক জঙ্গী আস্তানায় লুকিয়ে আছে বলে তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। আজিমপুর জঙ্গী আস্তানা থেকে আহত অবস্থায় আটক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিন নারী জঙ্গীকে অনানুষ্ঠানিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন তদন্তকারীরা। এ জঙ্গী আস্তানা থেকে উদ্ধার করা চারটি ল্যাপটপ ও একটি পেনড্রাইভ উদ্ধার হয়েছে, যার ফরেনসিক পরীক্ষা করছেন সাইবার ক্রাইম ইউনিট। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর পাওয়া গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, আজিমপুরের জঙ্গী আস্তানায় অভিযানকালে পুলিশের ওপর ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার অভিযোগে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিহত জঙ্গী তানভির কাদেরীর ছেলে চৌদ্দ বছর বয়সী তাহরিম কাদেরীকে রবিবার আদালতে পাঠিয়ে দশ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানায় কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। আদালত থেকে তিন দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তাদের দাবি। রবিবার তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে দশ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। শুনানি শেষে ঢাকার অতিরিক্তি মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক রুহুল আমিন তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সহকারী কমিশনার (এসি) ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোঃ আহসানুল হক ওই কিশোরকে আদালতে হাজির করে দশ দিনের রিমান্ড চান। যা বলা হয়েছে রিমান্ড আবেদনে ॥ তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রিমান্ড আবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন, কিশোরটি জেএমবি সদস্য। জঙ্গী আস্তানায় পুলিশ অভিযানের দিন পুলিশ ওই জঙ্গী আস্তানার একটি কক্ষে ঢোকে। এ সময় দরজা আটকে দিয়েছিল সে। পুলিশ দরজা খুলে ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ওই কিশোর পুলিশের ওপর ছুরি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তবে পুলিশ তাকে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। তার পরিবারের সবাই জেএমবির সদস্য। ওই বাসায় যাতায়াতকারী আরও কয়েকজন অজ্ঞাত পরিচয় নারী-পুরুষের বিষয়ে সে প্রাথমিক তথ্য দিয়েছে। জঙ্গী সংগঠনের আস্তানার সন্ধান, জঙ্গীদের নাম-ঠিকানা জানতে বিভিন্ন স্থানে তাকে নিয়ে অভিযান পরিচালনার জন্য দশ দিনের রিমান্ড প্রয়োজন বলে আবেদনে উল্লেখ করা হয়। আদালত শুনানি শেষে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। জেএমবির সদস্য তাহরিম কাদেরী ওরফে রাসেলের পক্ষে কোন আইনজীবী ছিলেন না আদালতে। মামলার এজাহারে যা বলা হয়েছে ॥ আজিমপুরের জঙ্গী আস্তানায় পুলিশ অভিযানের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় কিশোর জেএমবি জঙ্গী তাহরিম কাদেরী ওরফে রাসেল ৫ নম্বর আসামি। জঙ্গী আস্তানা থেকে উদ্ধারের পর তাকে আটক করে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের হেফাজতে আনা হয়। মামলার এজাহারে বলা হয়, বাসার ভেতরে ঢোকার পর একটি কক্ষের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ পাওয়া যায়। এমতাবস্থায় পরিস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ মনে হওয়ায় সোয়াত টিমকে খবর দেয়া হয়। সোয়াত টিমের সদস্যরা ওই কক্ষের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করেন এবং আট বছর বয়সী দুটি শিশুকে উদ্ধার করে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পাঠান। নিহত জঙ্গী আবদুল করিমের কিশোর ছেলে কেন তাদের ওপর হামলা চালিয়েছিল এবং সে প্রকৃতই বাবা-মায়ের মতো জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ কিনা, তা অনুসন্ধান করে দেখা হচ্ছে বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়। আজিমপুরের জঙ্গী আস্তানায় অভিযানের ঘটনায় লালবাগ থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে যে মামলা দায়ের করা হয়েছে তাতে পাঁচজনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে তাহরিম কাদেরী ছাড়াও অন্য আসামিরা হচ্ছেÑ তিন নারী জঙ্গী আফরিন ওরফে প্রিয়তি, আবেদাতুল ফাতেমা ওরফে খাদিজা, শায়লা আফরিন ও নিহত জঙ্গী তানভীর কাদেরী। কিশোর জঙ্গীরা যমজ ভাই ॥ তদন্ত সূত্র জানায়, কিশোর জেএমবির সদস্য তাহরিম কাদেরী ওরফে রাসেলের একটি যমজ ভাই রয়েছে। তবে ওই জঙ্গী আস্তানায় তাকে পাওয়া যায়নি। পরিবারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই যমজ ভাইকে ‘জিহাদের’ পথে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে বলে সিটির একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন। সে এখন কোথায় আছে তা জানার চেষ্টা চলছে। আটক কিশোর জঙ্গী তাহরিম কাদেরী ধানম-ির একটি স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। তবে সে গত কয়েক মাস ধরে স্কুলে অনিয়মিত ছিল। বাবা-মা দুজনই জঙ্গীবাদে জড়িত থাকার কারণে যমজ দুই ছেলেকেও মোটিভেট করে জঙ্গী কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত করা হতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। জঙ্গী আস্তানা থেকে আটক নারী জঙ্গী শায়লা আফরিন, যার স্বামী শীর্ষ জঙ্গী নেতা জামান ওরফে বাসারুজ্জামানের কাছে যমজ ছেলেটি রয়েছে বলে জানতে পেরেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। শীর্ষ জঙ্গী নেতা জামান ওরফে বাসারুজ্জামানকেও খুঁজছে গোয়েন্দারা। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের ডিসি মহিবুল ইসলামের সঙ্গে আলাপ হলে তিনি জানান, আজিমপুরের জঙ্গী আস্তানাটিতে আরও অনেক পুরুষ ও নারী জঙ্গীর যাতায়াত ছিল বলে প্রাথমিক তদন্তে তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে অন্তত নব্য জেএমবির শীর্ষস্থানীয় পাঁচজন রয়েছে, যাদের গ্রেফতারের জন্য খোঁজা হচ্ছে। আজিমপুরের জঙ্গী আস্তানায় অভিযানকালে নিহত জঙ্গী তানভির কাদেরীর ছেলে চৌদ্দ বছর বয়সী তাহরিম কাদেরী ওরফে রাসেলকে রিমান্ডে আনার পর জিজ্ঞাসাবাদে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যেতে পারে। জঙ্গী আস্তানা থেকে আহত অবস্থায় আটক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিন নারী জঙ্গীকে অনানুষ্ঠানিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তিন নারী জঙ্গী সুস্থ হলে তাদেরও রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা। প্রসঙ্গত, গত ১০ সেপ্টেম্বর রাতে লালবাগ থানাধীন আজিমপুরের ২০৯/৫ পিলখানা রোডের একটি ছয়তলা আবাসিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় অভিযান চালায় কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। পরে ওই বাসা থেকে এক জঙ্গীর মৃতদেহ, আহত তিন নারী জঙ্গী ও নিহত জঙ্গী করিমের এই কিশোর ছেলেকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
×