ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দৈনিক লেনদেন কয়েক কোটি টাকা

উপকূলে ইলিশনির্ভর অর্থনীতি চাঙ্গা

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬

উপকূলে ইলিশনির্ভর অর্থনীতি চাঙ্গা

স্টাফ রিপোর্টার, গলাচিপা ॥ মৌসুমের দু’মাসের মাথায় মধ্য ভাদ্রের অমাবশ্যা থেকে উপকূলে ব্যাপক হারে দেখা মিলতে শুরু করেছে মাছের রাজা ইলিশের। নদী এবং সাগর, সব জায়গাতেই ইলিশের ছড়াছড়ি। পটুয়াখালী-বরিশাল উপকূলের প্রতিটি মোকামে জমে উঠেছে ইলিশের স্তূপ। দামও কমে এসেছে সহনীয় পর্যায়ে। কোথাও কোথাও এত ব্যাপক হারে ইলিশ ধরা পড়ছে যে, এখন আর কেজি দরে নয়; বিক্রি হচ্ছে হালি, গ-া, পণ হিসেবে। ঝকঝকে রূপালী ইলিশের সাইজও এবার অনেক বড়। জেলেরা দেখছে লাভের মুখ। একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের পাতেও উঠছে ইলিশ। মোট কথা, মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে উপকূলের ইলিশ নির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্য বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। বরিশাল অঞ্চলে ইলিশ কেন্দ্র করে প্রতিদিন অন্তত কয়েক কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। উপকূলের জেলেরা জানিয়েছে, ইলিশের মূল মৌসুম জুলাই মাস থেকে শুরু হয়। কিন্তু উজানের ঢল বা বানের পানি না হলে ইলিশ সাগর থেকে নদীতে আসে না এটাই নিয়ম। আগস্টের শেষ সপ্তাহে উত্তরাঞ্চলে বন্যার পর থেকে নদীতে ইলিশের দেখা মিলতে শুরু করে। যা গত অমাবশ্যার জো’ এর পর ইলিশের বান ডাকতে শুরু করে। মধ্য সেপ্টেম্বরেও যা অব্যাহত রয়েছে। কয়েক বছর ধরে সরকার মা ইলিশ রক্ষা ও জাটকা নিধনের অভিযান কঠোর করায় এর সুফল মিলছে আরও। যার ধারাবাহিকতায় এবার মূল সিজনেও বড় সাইজের ইলিশ মিলতে শুরু করেছে। উপকূলের কয়েকটি মৎস্যবন্দর ও ঘাটে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরে জেলেদের জালে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ছে ইলিশ। বঙ্গোপসাগর মোহনার চ্যানেল ও অভ্যন্তরীণ নদ-নদীগুলোতে মিলছে প্রচুর ইলিশ। কাক্সিক্ষত রূপালী ইলিশ ধরা পড়ায় হাসি ফুটেছে জেলে, আড়তদার ও মৎস্যজীবীদের মাঝে। মৎস্য আড়তগুলোর ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন ট্রাক, পিকআপ, লঞ্চ, ট্রলার বোঝাই করে হাজার হাজার মণ ইলিশ পাঠাচ্ছে বিভিন্ন মোকামে। এমনকি ঢাকাগামী বহু যাত্রীবাহী বাসের ছাদেও যাচ্ছে প্যাকেট ভর্তি শ’য়ে শ’য়ে মণ ইলিশ। মৎস্য ব্যবসায়ীরা জানান, কোন কোন বড় ট্রলার সাগর থেকে ফিরে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকার পর্যন্ত ইলিশ বিক্রি করছে। দু’-তিন লাখ টাকার ইলিশ বিক্রি করছে ছোট ট্রলারের জেলেরা। বর্তমানে স্থানীয় আড়তগুলোতে গ্রেড অনুযায়ী প্রতি মণ সর্বোচ্চ ৪০-৫০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ছোট সাইজের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে অর্ধেকেরও কম দামে। অগভীর সমুদ্রের খুঁটা জালে বড় সাইজের বেশ ইলিশ ধরা পড়ছে। যে কারণে সামনে ইলিশের দাম আরও কমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। মৎস্য আড়তদারদের তথ্য অনুযায়ী, জেলেদের জালে এবার দেড় কেজি ওজনের ইলিশও ধরা পড়ছে। যা প্রতি কেজি এক হাজার থেকে বারো শ’ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এক কেজি ওজনের প্রতিটি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৯শ’ টাকায়। ৮শ’ থেকে ৯শ’ গ্রাম ওজনের প্রতি কেজি ইলিশের দাম পড়ছে ৬শ’ টাকা। ৭শ’ থেকে ৮শ’ গ্রাম ওজনের প্রতি কেজি ইলিশের দাম পড়ছে ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকা। ৬শ’ গ্রাম ওজনের নিচের প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে সাড়ে তিন শ’ টাকায়। উপকূলের অনেক এলাকায় কেজি দরের পরিবর্তে চারটিতে এক হালি, চার হালিতে এক গ-া এবং ৮০ পিসে পণ হিসেবেও ইলিশ বিক্রি হচ্ছে। বেশ বড় সাইজের হালি মিলছে ১৫-১৬শ’ টাকায়। এ যেন ইলিশের মচ্ছব। দশমিনার জেলে ছত্তার মাঝি বলেন, গেল পূর্ণিমার আগ থেকেই নদীতে মাছের দেখা মিলেছে। নদীতে পানির চাপ থাকায় জোয়ার আর ভাটায় প্রতিদিন দু’বার জাল পেতে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার মাছ পাচ্ছেন। ভাদ্রের অমাবশ্যার পর থেকে পানির চাপ যেমন বেড়েছে, তেমনি ইলিশেরও ঢল নেমেছে। তবে আবহাওয়া খারাপ থাকলে তুফানের তোড়ে আগুনমুখায় ট্রলার নামানো যায় না, এটি একটা বড় সমস্যা। রাঙ্গাবালী উপজেলার মৌডুবী এলাকার ট্রলার মালিক আনিস আকন জানান, তিনি গভীর সাগরে মাছ ধরেন। গত কয়েকদিন ধরে প্রতিদিন এক-দেড় লাখ টাকার ইলিশ বিক্রি করছেন। চরবিশ্বাসের আনোয়ার মাঝি জানান, তিনিও প্রতিদিন দেড়-দু’ লাখ টাকার ইলিশ বিক্রি করছেন। একই এলাকার নান্না মাঝি জানান, গত ১০-১২ দিনে স্থানীয় নদীতে মাছ ধরেই আয় করেছেন অন্তত চার লাখ টাকা। জেলেরা প্রায় সকলেই জানিয়েছেন এমন লাভের মুখ তারা গত কয়েক যুগেও দেখেননি। মৎস্য আড়তদার মোঃ ইমন জানান, প্রতিদিন এত বিপুল পরিমাণ ইলিশ জমছে, যা বরফ দিয়েও কুলোচ্ছে না। প্রায়ই বরফের তীব্র সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। যে কারণে বাজারে কম দামে মাছ বিক্রি করতে জেলেরা বাধ্য হচ্ছে। আড়তদার আজাদ সাথী জানান, কোন কোন আড়তে প্রতিদিন ৫০ লাখ টাকাও লেনদেন হচ্ছে। ইলিশ নির্ভর অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ায় জেলে-আড়তদার সবার মুখে ফুটেছে হাসি। বাজারেও যার প্রভাব পড়ছে। জেলে পরিবারে কেনাকাটা বেড়ে গেছে ব্যাপক। প্রতিদিন প্রচুর ইলিশ ধরা প্রসঙ্গে কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ কামরুল ইসলাম জানান, গভীর ও অগভীর সমুদ্রে আশাতীত ইলিশ ধরা পড়ছে। এবার ইলিশ অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। মৎস্য অধিদফতরের কার্যকরী পদক্ষেপ ও পরিকল্পনায় নৌবাহিনী, কোস্টকার্ড, পুলিশ, প্রশাসন ও জনগণের সহযোগিতায় মা ইলিশ নিধন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। জাটকা ধরাও প্রায় বন্ধের পথে। যে কারণে ব্যাপকহারে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে। ঢাকায় প্রশিক্ষণরত অবস্থায় গলাচিপা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা অঞ্জন বিশ্বাস জানান, সামনে আরও বেশি পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
×