ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

জাতীয় ক্রীড়াপদক ও একজন শেখ কামাল

প্রকাশিত: ০৪:১০, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬

জাতীয় ক্রীড়াপদক ও একজন শেখ কামাল

ইদানীং বাংলাদেশ অনেক কিছুতে এগিয়ে থাকলেও কিছু বিষয়ে এখনও পিছিয়ে। যেমন খেলাধুলায় উৎসাহ-উদ্দীপনা ও প্রণোদনা দেয়ার অংশ হিসেবে প্রতিবছর যে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার দেয়ার কথা বার্ষিক ভিত্তিতে কিন্তু তা না দিয়ে ৩-৪ বছর একত্রে জমিয়ে পরে দেয়া হয়। একই কাজ করতে দেখা যায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিতরণীতেও। এতে হয়ত যারা পুরস্কার পাওয়ার কথা তারাই পেয়ে থাকেন; কিন্তু সমস্যা হয় দেরি হওয়ার কারণে। দেখা যায় যিনি পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য তিনি যদি সঠিক সময়ে পুরস্কারটি পেতেন কিংবা পুরস্কার পাচ্ছেন এমন ঘোষণাটিও তিনি শুনতেন তাহলে তার যে অনুভূতি হতো, দেরি হওয়ার কারণে অনেক সময় তার আনন্দটা কিছুটা হলেও ফিকে হয়ে যায়। আর সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটে তখন, যখন পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় পুরস্কারটি গ্রহণ করতে পারছেন না। মৃত্যুর পর পদক পান মরণোত্তর হিসেবে। অথচ এটা নিয়মিত করতে আয়োজক এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের একটু সহানুভূতি ও আন্তরিক ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে যে কাজটি সহজ তা হলো সরকারকে দোষ দেয়া। আমরা প্রকারান্তরে সকলেই সেই সহজ কাজটি করি সরকারকে দোষ দিয়ে। কিন্তু আমরা কখনই একটু ভেবে দেখি না পুরস্কার পরে দিয়ে সরকারের কী লাভ! আগে দিলেও সরকারের যে পরিমাণ অর্থ খরচ হতো, পরে দিলেও তাই হচ্ছে। তাহলে কেন পরে দেয়া? ঠিক তেমনিভাবে এবারও ২০১৬ সালে এসে দেয়া হলো ২০১০, ২০১১ এবং ২০১২ সালের জাতীয় ক্রীড়াপদক। বাকি রয়ে গেল ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ এবং চলতি ২০১৬ সালসহ মোট চার বছরের জাতীয় ক্রীড়াপদক। সেগুলোও হয়ত আরও কমপক্ষে ৩-৪ বছর পরে কোন এক সময়ে দেয়া হতে পারে। অপরদিকে স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদকের মতো জাতীয় পুরস্কারগুলো এখন সময়মতো প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে। এখন সময় এসেছে জাতীয় ক্রীড়াপদকসহ অন্য সব জাতীয় পুরস্কার ও স্বীকৃতিগুলো সময়মতো প্রদানের উদ্যোগ নিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা। সম্প্রতি ক্রীড়াক্ষেত্রে যখন চারদিকে কিছু সাফল্যজনক ঘটনা চলমান, ঠিক এমন একটি সময়ে গত ৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের ক্রীড়াবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০, ২০১১ এবং ২০১২ সালের জাতীয় ক্রীড়াপদক প্রদান করেন। এতকিছুর পরেও একটি আনন্দের সংবাদ এই যে, সেখানে এত বছর পরে হলেও বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক, বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে, বীর মুক্তিযোদ্ধা, ১৯৭৫ সালের সেই ঘৃণ্য নরঘাতকদের হাতে জাতির পিতার সঙ্গে নিহত শেখ কামালকে ২০১১ সালের মরণোত্তর জাতীয় ক্রীড়াপদক প্রদান করা হয়েছে। এ পুরস্কার প্রদানে কমিটি যে শুধু শেখ কামালকে সম্মানিত করেছেন তাই নয়, তারা সম্মানিত করেছেন পুরো বাংলাদেশের ক্রীড়া জগতকে। কারণ শেখ কামাল সত্যিকার অর্থেই একজন প্রকৃত ক্রীড়াবিদ এবং ক্রীড়া সংগঠক ছিলেন। দেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে তার অবদানের কথা নতুন প্রজন্ম এবং সচেতন মহলের কাছে এখনও অব্যক্ত ও অজানা। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে। তাকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর ভুল ও বিকৃতভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছে। শেখ কামালের সহপাঠী বন্ধু এবং বর্তমানে বাংলাদেশের একজন প্রধানতম তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার ২০১৬ সালের শোকের আগস্ট মাসে একটি দৈনিক পত্রিকায় এক নিবন্ধে শেখ কামালকে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট জাতির পিতার পুত্র হিসেবে নয়, বর্ণনা করেছেন একজন বন্ধুবৎসল সাধারণ ক্রীড়াবিদ এবং একাগ্রচিত্তের একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিক সংগঠক হিসেবে। একই সময়ে ক্রীড়া সাংবাদিক অঘোর ম-ল তার একাধিক নিবন্ধে শেখ কামালের ক্রিকেটপ্রীতি, ফুটবলপ্রীতি, বাস্কেটবলপ্রীতি ইত্যাদির কথা খুব ভালভাবে তুলে ধরেছেন। এসব ঘটনা থেকে সহজেই অনুমেয় শেখ কামাল শুধু একজন ক্রীড়া সংগঠকই ছিলেন না, তিনি একজন খেলোয়াড়ও ছিলেন। শেখ কামাল জানতেন এবং মনে করতেন, খেলাধুলার মাধ্যমেই একদিন বাংলাদেশের পতাকা বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। তাই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের একটি ফুটবল টিমকে তখন তার নেতৃত্বে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে তিনি ভারতে খেলতে নিয়ে গিয়েছিলেন। এখন তার সেই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কথারই সফল বাস্তবায়ন আমরা ক্রীড়াক্ষেত্রে দিন দিন দেখতে পাচ্ছি। ক্রিকেটের প্রতি তার অনুরাগের স্বীকৃতিস্বরূপ ধানম-ির ৩২ নম্বরে স্থাপিত বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে সে সময়কার শেখ কামাল ব্যবহৃত তিনটি ক্রিকেট ব্যাট ও একটি ক্রিকেট বল রক্ষিত আছে। কয়েক বছর আগে ভারতীয় তারকা ক্রিকেটার রবি শাস্ত্রী সেই জাদুঘর পরিদর্শনে এসে সেখানে তখনকার বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রীতির নিদর্শনস্বরূপ ক্রিকেট সরঞ্জাম দেখে অবিভূত হন। খেলাধুলার প্রতি শেখ কামালের অনুরাগের আরেকটি জ্বলন্ত প্রমাণ হলো সুলতানা খুকুকে সহধর্মিণী হিসেবে বেছে নেয়া। কারণ তখন সুলতানা খুকু দেশসেরা একজন মহিলা ক্রীড়াবিদ ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য পুত্র হিসেবে তিনি মনে করতেন খেলাধুলার মাধ্যমে যুব সমাজকে মাদকাসক্তি, সন্ত্রাসবাদ, বিপথে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করা সম্ভব। একদিকে তিনি নিজে ছেলেদের ক্রীড়ায় মাতিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন, অপরদিকে সুলতানা খুকুকে দিয়ে মহিলা ক্রীড়াবিদ তৈরির জন্যই মূলত তিনি তাকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তাই তিনি ধানম-ি মাঠের একপাশে ছেলেদের এবং অপর পাশে মেয়েদের জন্য খেলাধুলার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি ‘আবাহনী ক্রীড়াচক্র’ নামে একটি সফল ক্লাব গঠন করেছিলেন, যা এখনও বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে বিরাট অবদান রেখে চলেছে। সেজন্য অন্য অনেকের মতোই আমিও মনে করি আরও অনেক আগেই শেখ কামালের এ পুরস্কারের স্বীকৃতি পাওয়া উচিত ছিল। এটি শেখ কামাল এতদিন না পাওয়ায় তার এবং তার পরিবারের কোন ক্ষতি কিংবা অসম্মান হয়নি। হয়ে থাকলে হয়েছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের এবং যারা এসব পুরস্কারের মনোনয়ন নির্ধারণ করে থাকেন তাদের। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যখন তিনি ঘাতকের বুলেটের নির্মম আঘাতে মৃত্যুবরণ করেন, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৬ বছর। বেঁচে থাকলে এখন তার বয়স হতো ৬৭ বছর। বাকি ৪১ বছরে বাংলাদেশের ক্রীড়া কোন্ জায়গায় গিয়ে দাঁড়াত তা সহজেই অনুমান করা যায়। আজ হয়ত বাংলাদেশের সাফল্যের ক্রীড়া ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো। তার পরেও বলা চলে এখনও বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন শেখ কামালদের দেখানো পথ ধরেই এগিয়ে চলেছে। কিন্তু ক্রীড়া সংগঠককে জাতীয়ভাবে সম্মানিত করতে কেন তিন যুগ অপেক্ষা করতে হলো সে প্রশ্ন করাই যায়। তবে এর উত্তর খুব যে সহজ সে বিষয়ে কারও কোন সন্দেহ থাকার কারণ নেই। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সন্তান, সেজন্য যত যোগ্যই হোন না কেন তাকে কোন জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত করা যাবে না। এই কথা অন্যদের বেলায় প্রযোজ্য। কিন্তু কথা হলো ’৭৫ পরবর্তী ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে এর মধ্যে তৃতীয়বারের মতো। তবুও কেন এ পুরস্কারটি শেখ কামালকে পেতে ২০১৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো- তা অজানাই হয়ত রয়ে যাবে। সে যা-ই হোক, এতদিনে একজন যোগ্য সন্তানের কাছে একটি যোগ্য পুরস্কার উঠেছে এটাই শান্তি। বিগত দিনে দেখা গেছে কেবল রাজনৈতিক কারণে, যাদের পুরস্কার পাওয়ার কথা ছিল না তারাও পুরস্কার পেয়ে গেছেন। বাদ পড়েছেন শেখ কামালের মতো যোগ্য আরও অনেকেই। আরেকটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, এসব পুরস্কার বছরের পর বছর না জমিয়ে রেখে সসম্মানে তা ফিবছর দেয়ার ব্যবস্থা করা হোক। কারণ, এখন সময় শুধু সামনে এগিয়ে যাওয়ার। লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×