ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রিয়াজুল হক

বেকার সমস্যা অর্থনীতির অন্তরায়

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬

বেকার সমস্যা অর্থনীতির অন্তরায়

বাংলাদেশের প্র্রেক্ষাপটে বেকার সমস্যা আজ প্র্রকট এবং জটিল। বেকার বলতে শ্রমশক্তির সেই মানুষগুলোকে বুঝানো হয়, যারা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজের সন্ধান করা সত্ত্বেও কোন কাজ পায় না। বেকারত্ব বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, বাড়তি শ্রমশক্তি, মূলধনের অভাব ইত্যাদি আর্থ-সামাজিক অবকাঠামোজনিত কারণে বেকারত্ব সৃষ্টি হতে পারে। তবে আমাদের দেশে শিক্ষিত বেকারত্বের হার উদ্বেগজনকহারে বেড়ে গেছে। ইকোনমিস্ট এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। বেকারত্বের সংখ্যা বৃদ্ধির অর্থই দেশের অগ্রগতির ধারাকে প্র্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন করা। যুবসমাজই দেশের প্র্রকৃত শক্তি। কিন্তু বেকারত্বে এই শক্তির সীমাহীন অপচয় ঘটে। ফলে অমিত এই যৌবশক্তিকে উপেক্ষা করে জাতি কখনও শক্তিশালী ও স্বনির্ভর হতে পারে না, হওয়া সম্ভব নয়। প্র্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে আমাদের এই জাতীয় সমস্যার সমাধান। মূলত দুটি প্রদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের বেকারত্ব দূর করা যেতে পারে : এক. আমাদের দক্ষ মানব সম্পদের বড়ই অভাব। সরকারী এবং বেসরকারী উদ্যোগে বেকারদের জন্য স্থাপন করতে হবে বেকার প্র্রশিক্ষণ কেন্দ্র। শিক্ষিত বেকারদের অর্জিত সার্টিফিকেটের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক বিষয়ে তাদের প্র্রশিক্ষণের ধরন নির্ধারণ করতে হবে। প্র্রত্যেক প্র্রশিক্ষণার্থী নিজ নিজ বিষয়ের ওপর অত্যন্ত দক্ষ হবে। সরকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্র্রশিক্ষিত কর্মী প্র্রেরণের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করে কর্মক্ষেত্র তৈরি করবে। উন্নত বিশ্বে কারিগরি ক্ষেত্রে যে প্ররিমাণ কর্ম খালি আছে, প্র্রশিক্ষিত মানব সম্পদের মাধ্যমে আমাদের বেকারত্বের হার প্র্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব। আমরা অদক্ষ জনসংখ্যা রফতানি না করে, প্র্রশিক্ষিত এবং দক্ষ মানব সম্পদ রফতানি করব। এতে করে বৈদেশিক রেমিটেন্সের পরিমাণ উত্তরোত্তর আরও বৃদ্ধি পাবে। আর যে সকল প্র্রশিক্ষিত বেকার দেশে থাকবে, তাদের জন্য থাকবে সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা। এছাড়া বিভিন্ন প্র্রতিষ্ঠানে চাকরি করার সুযোগ থাকছেই। দুই. আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্র্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত হওয়ার পর থেকেই কারিগরি শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। সব শিক্ষার্থীর নামধারী বিএ, এমএ পাস করার দরকার নেই। প্র্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা গ্রহণের দুই দিক থাকবে। একদল যাবে সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় এবং অন্যদল কারিগরি শিক্ষার দিকে। কারণ প্র্রযুক্তিতে ভাল কিছু করতে হলে তার পরিচর্চা ছোটবেলা থেকেই করতে হবে। আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছে যারা এসএসসি পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করছে, তারাই যাচ্ছে কারিগরি শিক্ষার পথে। এটা আদৌ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বরং কারিগরি শিক্ষায় মেধাবী শিক্ষার্থীদের বেশি আসা প্র্রয়োজন ছিল। এজন্যই প্র্রাথমিক পরীক্ষার পর যারা কারিগরি শিক্ষায় যাবে, শুধুমাত্র তাদের থেকেই পরবর্তীতে প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হবে। বলাবাহুল্য কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত একজন মানুষ কখনও বেকার থাকে না এবং উপার্জনও বেশি করে। কারিগরি শিক্ষাই একমাত্র উপায় যার সাহায্যে শতভাগ শিক্ষার্থীদের দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত করা সম্ভব। অনেক দেশ যেখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, আমাদের দেশে ঠিক উল্টো অবস্থা বিরাজমান। ছোট এই দেশে জনসংখ্যার চাপ অনেক বেশি। তাই সঠিক পরিকল্পনা প্র্রয়োজন। একজন মানুষের অপরাধী হওয়ার সঙ্গে তার অর্থনৈতিক অবস্থার একটি সম্পর্ক রয়েছে। একজন শিক্ষিত যুবক সঠিক সময়ে কর্মক্ষেত্রে প্র্রবেশ করতে পারলে তার অপরাধীতে প্ররিণত হওয়ার আশঙ্কা নেই বললেই চলে। অন্যদিকে একজন শিক্ষিত যুবক সঠিক সময়ে কর্মক্ষেত্রে প্র্রবেশ করতে না পারলে তার মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়। পারিবারিক ও সামাজিক উপেক্ষা একজন বেকার যুবকের, বিশেষ করে শিক্ষিত বেকার যুবকের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে। হতাশা তার মধ্যে ধীরে ধীরে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্র্রতি ঘৃণার জন্ম দেয়। এ পরিস্থিতিতে সে চুরি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। অনেকেই মাদকসেবী হিসেবে দুর্বিসহ জীবনের পথে পা বাড়ায়। এছাড়াও হতাশাগ্রস্ত শিক্ষিত বেকার যুবকরা মানব পাচারকারীদের প্র্রলোভনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় চেপে সাগর পাড়ি দিচ্ছে উন্নত জীবনের আশায়। ২০১৪ থেকে ২০১৫ সালের জুন প্রর্যন্ত গত দেড় বছরে বঙ্গোপসাগর রুট ব্যবহার করে শিক্ষিত যুবকসহ মানব পাচার হয়েছে প্র্রায় ১ লাখ। এর মধ্যে সহস্রাধিক সাগর বক্ষে মৃত্যুবরণ করেছে। জনসংখ্যার ক্রমাগত বিস্ফোরণ এবং সঠিক পরিকল্পনার অভাবে আজ বেকার সমস্যা তীব্রতর হচ্ছে। কারিগরি শিক্ষায় জোর দেয়ার কারণে বাংলাদেশের চাইতে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার জিডিপির হার অনেক বেশি। অথচ ১৯৭০ সালে এই দেশগুলোর জিডিপির হার ছিল আমাদের প্র্রায় কাছাকাছি। সরকার ইতোমধ্যে বেকারত্ব নিরসনে বেশকিছু প্র্রশংসনীয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে। তবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন না আনলে ভবিষ্যতে এই সমস্যার শতভাগ সমাধান হয়ত কখনও হবে না। বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য আজ প্র্রয়োজন সমগ্র জাতিকে নতুন করে শপথ গ্রহণ করা। গড়ে উঠবে বেকারমুক্ত আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ এবং অর্থনীতির ভিত্তি হবে আরও শক্তিশালী।
×