ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রযুক্তি নির্ভর ক্যাম্পাস

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬

প্রযুক্তি নির্ভর ক্যাম্পাস

স্কুল-কলেজে একসঙ্গে পড়াশোনা করেছেন দুই বন্ধু। কিন্তু উচ্চশিক্ষার জন্য দুজন দেশের দুই প্রান্তের শত শত মাইল দূরের দুই ক্যাম্পাসে পড়ে গেলেন। সেই থেকে আর তাদের মধ্যে যোগাযোগ নেই। হঠাৎ একদিন কম্পিউটারের মনিটরে বন্ধুর ছবি দেখে লাইভ আলাপ জমিয়ে, মোবাইল নম্বর আদান-প্রদান করে আবার একত্রিত হয়ে গেলেন সেই আগের বন্ধুত্বের বন্ধনে। পাশাপাশি বোনাস হিসেবে বন্ধুর প্রোফাইল থেকে ক্লাস এইটের সেই রূপসী বান্ধবী মিতু ও শান্তার খোঁজ পেয়ে গেলেন। আনন্দ আর উত্তেজনা আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেল। কিন্তু সে উত্তেজনায় ঠা-া পানি পড়ে গেল যখন দেখলেন সাদিকা জান্নাতি মিতু ও নূরে জান্নাত শান্তার রিলেশনশিপ স্ট্যাটাসে লেখা ‘এনগেজড’। কি এই ফেসবুক যার কারণে আনন্দ, উত্তেজনা আর উত্তেজনার মধ্যে ঠা-া পানি পড়ে যায়? অনুবাদ করলে ফেসবুকের বাংলা অর্থ দাঁড়ায় চেহারা বই। যেহেতু ফেসবুক ডটকম একটি ওয়েবসাইট, সে অর্থে এক একটিকে বই বলা যেতেই পারে। তবে বইটি পুরোপুরি জীবন্ত এবং এতে চেহারার পাশাপাশি মানুষের পুরো জীবনটাই দেখা যায়। এই জনপ্রিয় ফেসবুকের যাত্রা শুরু হয়েছিল বিশ্ব বিখ্যাত ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে। সারা বিশ্বের হাজার হাজার স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বিস্তৃতি। বাংলাদেশ কেন এ রকম জনপ্রিয় ওয়েবসাইট থেকে পিছিয়ে থাকবে। বাংলাদেশের স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে ফেসবুকের ব্যবহার এখন ব্যাপক। আমাদের ক্যাম্পাসের ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি শিক্ষক-কর্মকর্তাদেরও আনাগোনা আছে ফেসবুকে। ক্যাম্পাসের সড়ক, চত্বর, গাছতলা, টেন্ট, ক্যান্টিন, ক্যাফেটোরিয়া, মাঠ কিংবা খোদ ডিপার্টমেন্টের বারান্দার আড্ডা আলোচনা বিতর্ক স্থান পরিবর্তন করে এখন ফেসবুকের ওয়ালে জায়গা করে নিয়েছে। ফেসবুকের আড্ডার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো আড্ডাটি হয় লিখিত আকারে। ফলে দুইমাস আগে শুরু“হওয়া কোন বিষয়ের ওপর আলোচনায় যে কেউ অংশগ্রহণ করতে পারে, ফলে জমে ওঠে ভার্চুয়াল আড্ডা। দেশের প্রতিটি সরকারী-বেসরকারী ও অধিকাংশ শহুরে কলেজের নামে ফেসবুকে একাধিক গ্রুপ এবং পেজ সৃষ্টি হয়েছে। আর এগুলো সৃষ্টি করেছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাই। এসব গ্রুপে গঠনমূলক আলোচনা-সমালোচনা হয় প্রতিদিনই। গ্রুপগুলোতে বর্তমান শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি দেশ-বিদেশের সাবেক শিক্ষার্থীরাও অংশগ্রহণ করে। এমনকি এক ক্যাম্পাসের আলোচনা আর আড্ডায় অন্য ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণও লক্ষ্য করা যায়। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষক-কর্মকর্তারাও আলোচনায় দুই একটা লাইন বসিয়ে দেন। এসব গ্রুপগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যায় ক্যাম্পাসগুলোর এ্যালামনাই, শিক্ষা সফর, বর্ষপূর্তি উৎসব ও শিক্ষার্থীদের পুনর্মিলনীর আয়োজন। এসব আয়োজনের দাওয়াত দেয়া, বাজেট প্রণয়ন, চাঁদা সংগ্রহ, সবকিছুই ফেসবুকের মাধ্যমে হয়ে থাকে। শুধু অনুষ্ঠানের দিন নির্দিষ্ট স্পটে খাওয়া-দাওয়া আর ফটোসেশনের কাজটা হয়, কারণ ফেসবুকে অনেক কিছু করা গেলেও খাওয়ার কাজটা করা যায় না। আবার একসঙ্গে অনেকে আড্ডা দেয়ার ব্যবস্থা থাকলেও গ্রুপ ছবি তোলার ব্যবস্থা ফেসবুকে নেই। তবে তোলা ছবি দেখার চমৎকার সব ব্যবস্থা এতে আছে। ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোর ক্যাম্পাসের নামের পাশাপাশি অনুষদ, ডিপার্টমেন্ট, আবাসিক হল এমনকি কোন বছরের ব্যাচের নামেও ফেসবুকের গ্রুপ এবং পেজের সন্ধান পাওয়া যায়। কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রুপ বা পেজের ছবি, ভিডিওচিত্র আর লেখনী এতটাই তথ্যবহুল যে তা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের চেয়েও সমৃদ্ধশালী। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি তথ্য, পরীক্ষার রুটিন, সর্বশেষ সংবাদ, সুবিধা-অসুবিধা, সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা পাওয়া যায় এসব গ্রুপ থেকে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট নিয়মিত আপডেট না হওয়ায় ফেসবুক থেকে বিশ্বস্ত তথ্য পাওয়া যায়। তথ্য জানার পাশাপাশি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি লিখিত আলাপও করা যায় সংক্ষিপ্ত সময়ে। এ প্রতিবেদনটি তৈরিতে ফেসবুকের মাধ্যমেই কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী বন্ধুর সাক্ষাতকার নেয়া হয়েছে। তারা জানিয়েছেন তাদের মতামত। প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ লাইব্রেরিগুলোতে প্রবেশ করেছি, যে কারণে শিক্ষা কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নেই এটি এখন পৃথিবীর সকল শিক্ষার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছি। তাছাড়া জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ফেসবুকের মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি যেটি সত্যি খুব আনন্দদায়ক। তবে লক্ষ্য রাখা দরকার প্রযুক্তি/ফেসবুক যেন ইতিবাচক কাজে ব্যবহৃত হয়। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রনিক্স ফিজিক্স এ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী নুসরাত জাহান লিজা বলেন, আমার বাসা কুষ্টিয়া শহরের চৌড়হাস এলাকায় হওয়ায় যেদিন ক্লাস থাকে না সেদিন বাসায় চলে যাই। দিনরাত সবসময়ই ফেসবুকে ক্যাম্পাসের কাউকে না কাউকে পাই। মনেই হয় না ক্যাম্পাসের বাইরে আছি। এছাড়া ফেসবুকে আমার সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা হলোÑ এই ফেসবুকের মাধ্যমেই খুঁজে পেয়েছি আমার সাবেক স্কুল জীবনের বন্ধু বর্তমানে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎ ও প্রকৌশল বিভাগের ছাত্রী সাঈদা আক্তার লিনাকে। জাবির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র আল-আমিন বলেন, আমার একটি স্মরণীয় ঘটনা হলো ফেসবুকের মাধ্যমে ক্যাম্পাসেরই এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। পরিচয়ের সপ্তাহখানেকের মধ্যেই তিনি আমাকে সাভারে দুটো টিউশনি জোগাড় করে দিয়েছেন। তাই বলতে হয় জয়তু ফেসবুক। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের তৃতীয় সেমিস্টারের নীলিমা ম-ল, শোয়েব, প্রিন্স, রাহুল, লিজা, সিথি, কথা, মিতু, মৈত্রী, সুমি, দিশা ও হুমায়ুন বলেন, একজন ফেসবুক ব্যবহারকারীর প্রোফাইল দেখে তার পরিচয়, ঠিকানার পাশাপাশি তার ব্যক্তিত্ব, রুচি, বন্ধুমহল এমনকি মেধা সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়। কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী এনামুল, সোহেল, মিজু, শম্পা খাতুন ও রতœা বললেন, তাদের ক্যাম্পাসের আবাসিক হলে এই ডিজিটাল জুগে এখনও ইন্টারনেট সুবিধা পায়নি তাদের অনেকেই এই বন্ধুত্বের সুন্দর মাধ্যম থেকে বঞ্চিত। তারপরও অনেকে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ শহরে কিংবা ক্যাম্পাস পার্শ্ববর্তী সাইবার ক্যাফে গিয়ে ফেসবুক চ্যাট করেন। অনেকে ইন্টারনেট মডেম কিনে অথবা মোবাইলের মাধ্যমে ফেসবুক ব্যবহার করেন। তারা তাদের ক্যাম্পাস কর্তৃপক্ষকে ক্যাম্পাস এবং আবাসিক হলে ওয়াইফাই দেয়ার দাবি জানান। ফেসবুকের এত এত সুবিধার মাঝে কিছু কিছু ভয়াবহ খারাপ দিকও যে আছে সে সম্পর্কে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের প্রথম সেমিস্টারের ছাত্রী সিফাত আরা বাঁধন, তাসনিমুল জান্নাত হিমি, সৌরভ ও সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের মাঈনুল, শাবিপ্রবি’র ইংরেজী বিভাগের ফাতেমা তুজ্জোহরা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের হুরে জান্নাত দিবা এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী ডিসিপ্লিনের রিফাত শারমিন জেরিন বলেন, ফেসবুক থেকে খুব সহজে একজনের ছবি অন্যজন ডাউনলোড করতে পারে। ডাউনলোড করা ছবি অনেক সময় বিকৃত করে আবার ফেসবুকের ওয়ালেই ছেড়ে দেয়ার নজির আছে। বিশেষ করে আমাদের মেয়েদের তথ্য ও ছবি চুরি করে ব্ল্যাকমেইল করার ঘটনা বর্তমান সময়ে অহরহ ঘটছে। ইবির ইংরেজী বিভাগের সভাপতি প্রফেসর ড. মো. মামুনুর রহমান বলেন, ফেসবুকে যেহেতু দেশ-বিদেশের অনেক বন্ধুবান্ধব একসঙ্গে মিলিত হয়। তারা আড্ডায় আড্ডায় অনেক সময় নষ্ট করে। এই সামাজিক ওয়েবসাইটটি একটি নেশার মতো বিষয়। এ নেশায় শরীর ও অর্থ নষ্ট না হলেও সময় নষ্ট হয় অনেক। শিক্ষার্থীদের জন্য এমন সময় অপচয় তাদের পরীক্ষার ফলে খারাপ প্রভাব ফেলে। ঢাবির দর্শন বিভাগের ছাত্র আমানুল্লাহ ফয়সাল, ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের মোহিব্বুল্লাহ পান্না ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএসের শিক্ষার্থী মনিরুল, মিমি ও তাওহিদ এবং বরিশাল বিএম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষার্থী মিতু, দিনা, পাপড়ি ও রিফাত বলেন খারাপের চেয়ে ভালর পাল্লাটাই অনেক ভারি, তাই বলব জয়তু ফেসবুক। ইমাদুল হক প্রিন্স
×