ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাসাবাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঢুকছে বিস্ফোরক হয়ে

এলপিজি ভর্তি সিলিন্ডার ব্যবহার এখন মারাত্মক ঝুঁকির নাম

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬

এলপিজি ভর্তি সিলিন্ডার ব্যবহার এখন মারাত্মক ঝুঁকির নাম

সমুদ্র হক ॥ রান্না ও জ্বালানি শক্তি কাজে ব্যবহারের লিকুইফায়েড পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ভরা সিলিন্ডারের বেশিরভাগই বিস্ফোরক হয়ে বাসা-বাড়ি, রেস্তরাঁ, শিল্প, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঢুকছে। এমনকি এলপিজি পরিবেশকদের প্রতিষ্ঠানেও গ্যাস ভরা সিলিন্ডার নিরাপদ নয়। এসব সিলিন্ডারের বেশিরভাগই মেয়াদ উত্তীর্ণ। ভয়াবহ ঝুঁকি নিয়েই ভোক্তারা এলপিজি ব্যবহার করছে। গত ২০ আগস্ট বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) এলপিজি সরবরাহের উত্তরাঞ্চলীয় প্রধান ডিপো বগুড়ায় ট্রাক থেকে এলপিজি নামানোর সময় ৮শ’ সিলিন্ডার বোমার মতো বিস্ফোরিত হয়ে এক কিলোমিটার এলাকার মধ্যে ছিটকে পড়ে। ৮ সেপ্টেম্বর রাতে বগুড়ার শিবগঞ্জের কিচক বাজারে জ্বালানি তেলের ডিপোতে এলপিজি সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে ভয়াবহ আগুন লেগে যায়। বগুড়া, জয়পুরহাট, গোবিন্দগঞ্জের ফায়ার সার্ভিস পৌঁছে আড়াই ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এ সময় বাজারের সকল দোকান পুড়ে যায়। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময় বাসা বাড়িতে এলপিজি সিলিন্ডার বিস্ফোরণে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটছে। যে সব এলাকায় প্রাকৃতিক গ্যাসের পাইপ লাইন গেছে সেসব এলাকা ছাড়া শহর ও গ্রামাঞ্চলে রান্নার কাজে এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার অনেক বেড়েছে। গ্রামের গৃহস্থ ও সচ্ছল কৃষক পরিবার এখন এলপিজিতে রান্না করে। একটা সময় এলপিজির ব্যবহার শুধু শহর এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বর্তমানে তা সম্প্রসারিত হয়ে গ্রাম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। শহর ও গ্রামে জীবন মান উন্নয়নে এলপিজির ব্যবহার বেড়েছে। বিপিসির চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) ও সিলেটের কৈলাশটিলা প্লান্ট থেকে যে এলপিজি সরবরাহ হচ্ছে চাহিদার তুলনায় তা যথেষ্ট নয়। প্রায় ২৮ বছর ধরে যে এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার হচ্ছে তাতেই রিফুয়েলিং করে সরবরাহ করা হচ্ছে। এলপিজি গ্যাস সরবরাহ হয় এভাবে- ভোক্তা গ্যাস ভর্তি সিলিন্ডার কেনে। এলপিজি শেষ হওয়ার পর ভোক্তা খালি সিলিন্ডার জমা দিয়ে আরেকটি এলপিজি ভরা সিলিন্ডার কেনে। এভাবে সিলিন্ডারগুলো চক্রাকারে ডিলার পর্যায় থেকে এলপিজি প্লান্টে যায়। প্লান্টে পুরাতন সিলিন্ডারগুলোতেই গ্যাস ভরে সরবরাহ করা হয়। পুরাতন সিলিন্ডারে গ্যাস ভরার পর ভোক্তা পর্যায়ে বাসা বাড়ি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে তা কতটা নিরাপদ এ নিয়ে প্রশ্ন থাকার পরও সিলিন্ডার পরীক্ষা করা হয় না। গত মাসে বগুড়া এলপিজি ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর বিপিসি, পদ্মা মেঘনা যমুনা অয়েল কোম্পানি ও সরকারের বিস্ফোরক অধিদফতরের টনক নড়ে। এসব প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এলপিজি বগুড়া ডিপো পরিদর্শন করেন। এ সময় দেখা যায় বিপিসির তিন কোম্পানির (পদ্মা মেঘনা যমুনা) সরবরাহ করা এলপিজি সিলিন্ডারের ৮০ শতাংশই বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। এসব সিলিন্ডারের মুখে পানি জমে বুদবুদের সৃষ্টি হয়েছে। বেশিরভাগ সিলিন্ডারের ভাল্ব অকেজো। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি সিলিন্ডার পাঁচ বছর অন্তর পরীক্ষা করে তাতে গ্যাস ভরে নিরাপদভাবে সরবরাহ উপযোগী কি না তা দেখার কথা। যদি নিরাপদ না থাকে তাহলে তাৎক্ষণিক সিলিন্ডার বাতিল করে নতুন সিলিন্ডারে গ্যাস ভরার কথা। খোঁজ খবর করে জানা যায়, এই বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয় না। এলপিজির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় নতুন সিলিন্ডার আনা হচ্ছে। তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে পুরাতনগুলো। এই পুরাতন সিলিন্ডার বিস্ফোরক হয়ে বাসা বাড়ি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিবেশকদের প্রতিষ্ঠানে ঢুকে ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। এই ঝুঁকি ও দুর্ঘটনার সম্ভাবনা মাথায় নিয়ে ভোক্তারা এলপিজি ব্যবহার করছে। সূত্র জানায় এলপিজি সরবরাহের উত্তরাঞ্চলের বড় ডিপো বগুড়ায় প্রতি বছর এক লাখের বেশি এলপিজি আসে। উত্তরের জেলাগুলোতে ৭৫০ ডিলারের মাধ্যমে তা ভোক্তা পর্যায়ে বিতরণ করা হয়। এসব ডিলারের অনেকেই মাঠ পর্যায়ে ড্রামে করে জ্বালানি তেল বিক্রি করে। তাদের ঘরে এলপিজি থাকে। বগুড়ার কিচকে এমন এক ডিলারের প্রতিষ্ঠানে এলপিজি বিস্ফোরণে আগুন লেগে যায়। একজন ডিলার বললেন, এই ঝুঁকি নিয়েই তারা ব্যবসা করছেন। বিষয়টি উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অনেকবার জানিয়েছেন। কোন কাজ হয়নি। ভোক্তা পর্যায়ের কয়েকজন জানান, এলপিজি সিলিন্ডারে গ্যাস কম মিলছে। আগে যে সিলিন্ডারে অন্তত তিন সপ্তাহ চলতো বর্তমানে তা দু’সপ্তাহেই শেষ হয়ে যায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিটি সিলিন্ডারে সাড়ে ১২ কেজি করে এলপিজি থাকার কথা। বর্তমানে সেখানে মিলছে সাড়ে নয় কেজি করে। প্রতিটি সিলিন্ডারে ৩ কেজি করে গ্যাস কম পাওয়ায় ঠকছে ভোক্তারা। গ্যাস ভর্তি প্রতিটি সিলিন্ডার বিক্রি করা হয় ৬৮০ টাকা দরে। ৩ কেজি করে কম পাওয়ায় প্রতি সিলিন্ডারে গ্রাহক ঠকছে ১৬৩ টাকা করে। এলপিজি ফিলিং করার সময় প্রতি সিলিন্ডারে সাড়ে ১২ কেজি করে গ্যাস ভরানো হয়। ত্রুটিপূর্ণ সিলিন্ডার থেকে ৩ কেজি করে গ্যাস উড়ে যাচ্ছে। বিপিসির একটি সূত্র জানায়, ইআরএল ও কৈলাশটিলা প্লান্ট থেকে বছরে প্রায় ৫ লাখ এলপিজি সরবরাহ করা হয়। এলপিজি সরবরাহের পর ভোক্তার ব্যবহারের পর যে খালি সিলিন্ডার ফিরে আসে তাতেই রিফুয়েলিং করা হয়। ওই সূত্র স্বীকার করে অনেক সিলিন্ডার ব্যবহার অনুপযোগী। সিদ্ধান্ত হয়েছে এগুলো দ্রুত রিপ্লেস করে নতুন সিলিন্ডারে গ্যাস ভরে সরবরাহ করা হবে।
×