ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন শীঘ্র প্রয়োগ হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬

মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন শীঘ্র প্রয়োগ হচ্ছে

নিখিল মানখিন ॥ শীঘ্রই মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন-২০১৬-এর প্রয়োগ শুরু হবে। মন্ত্রিসভা বৈঠকে নীতিগত অনুমোদন ও কতিপয় পর্যালোচনা সাপেক্ষে আইনটির সম্পৃক্ত বিধিমালার খসড়া প্রয়োজনীয় সংশোধন করে বিশেষজ্ঞ কমিটির সভায় চূড়ান্ত করা হয়েছে। গত ২ মে সভায় প্রণীত খসড়া পর্যালোচনাপূর্বক জবাব চূড়ান্ত করা হয়। শীঘ্রই লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগে পাঠানো হবে। আইনে মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনে (সংশোধিত) মস্তিষ্ক মৃত্যুর (ব্রেন ডেথ) পর তার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অসুস্থ ব্যক্তির দেহে সংযোজন করার সুযোগ রাখা হচ্ছে। মৃত ব্যক্তির বা তার উত্তরাধিকারের সম্মতিতে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অন্যকে দান করার ক্ষেত্রে নির্ধারিত ফরম থাকবে। বর্তমান আইনে শুধু কারো জন্যে উইল করে যাওয়া মৃত ব্যক্তির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন করার অনুমতি রয়েছে। তবে সংশোধিত আইনে সরাসরি রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয় ছাড়া অন্য কারও কাছ থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গ্রহণ নিষিদ্ধই থাকছে। মানবদেহের যে কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্রয়-বিক্রয় বা তার বিনিময়ে কোন প্রকার সুবিধা লাভ এবং সেই উদ্দেশে কোন প্রকার বিজ্ঞাপন প্রদান বা অন্য কোনরূপ প্রচার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনটি হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। বাংলাদেশের শীর্ষ কিডনি বিশেষজ্ঞরাই মূলত আইনটি সংশোধনের পরামর্শ দেন। ২০১১ সালে কিডনি কেনাবেচার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশের পর থেকেই কিডনি প্রতিস্থাপনের সংখ্যা কমে আসে। মূলত বিকল্প খুঁজতেই ব্রেন ডেথ হওয়ার পর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহকে উৎসাহ দিতে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়। আইনটির নাম হয় মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন (সংশোধিত) আইন, ২০১২। পরবর্তীতে এই উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট, কিডনি ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ রেনাল এ্যাসোসিয়েশন, ট্রান্সপ্লান্ট সোসাইটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব ইউরোলজিক্যাল সার্জনস ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ২০১২ সালে আইনটি সংশোধন করার উদ্যোগ নেয়। খসড়া আইনটি মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হলে নীতিগত অনুমোদন দিয়ে আরও যাচাই-বাছাই করতে বলা হয়। এভাবে চলে যায় বেশ কয়েক বছর। অবশেষে গত বছর জুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সংসদ ভবনে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে ‘মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ২০১৫’ এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়। আইনটির খসড়া পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১৯৯৯ সালের আইনে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি নিষিদ্ধ ছিল। সংশোধিত আইনেও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি নিষিদ্ধ বহাল রাখা হয়েছে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনের জন্য সরকারী-বেসরকারী হাসপাতাল বা ইনস্টিটিউট বা ক্লিনিককে অনুমতি নিতে হবে। তবে কোন ক্লিনিক বা স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ন্যূনতম ২০ শয্যার দুটি ইউনিট না থাকলে সরকার এ-সংক্রান্ত অনুমতি দেবে না। এছাড়া এ ধরনের ক্লিনিক বা স্বাস্থ্যসেবী প্রতিষ্ঠানের ন্যূনতম দুটি অপারেশন থিয়েটার, আট শয্যার ট্রান্সপ্লান্ট আইসিইউ, কিডনি সংযোজনের জন্য ন্যূনতম ছয় শয্যার ডায়ালিসিস ইউনিট, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একজন অধ্যাপক, দুজন সহযোগী বা সহকারী অধ্যাপক বা সমমানের চিকিৎসক থাকতে হবে। আইনে বিভিন্ন কমিটি যেমন ট্রান্সপ্লান্ট কমিটি, মেডিক্যাল বোর্ড ও বিভিন্ন ধরনের কমিটির গঠন করা হবে। আত্মীয়তা যাচাইয়ের জন্য যাচাই কমিটি থাকবে, এজন্য ইন্টারনাল ও এক্সটারনাল মেম্বার থাকবে, যিনি সার্জেন্ট তিনি কমিটিতে থাকবেন না। যাচাই কমিটির সিদ্ধান্ত আরও যাচাইয়ের প্রয়োজন হলে আরও উচ্চ বোর্ড থাকবে। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে একটি মেডিক্যাল বোর্ড থাকবে এবং তাদের প্রত্যয়ন ছাড়া কোন সংযোজন হবে না। মস্তিষ্ক অকার্যকর হয়ে যাওয়ার পর কৃত্রিম উপায়ে বাঁচিয়ে রাখার সময় অর্থাৎ ব্রেন ডেথ এককভাবে কেউ ঘোষণা করতে পারবে না। টিমের মাধ্যমে এ ঘোষণা করতে হবে, এই টিমে যে হাসপাতালে রোগী আছে সে হাসপাতালের চিকিৎসক এবং বাইরের চিকিৎসক রাখতে হবে। অঙ্গ সংরক্ষণের পদ্ধতির কথা এখানে বলা আছে। প্রত্যক প্রতিষ্ঠানে একজন সমন্বয়কারী থাকবেন যিনি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে অধিদফতর, মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন। সমন্বয়কারীকে আগে থেকেই সংযোজনের বিষয়ে জানিয়ে রাখতে হবে। একটি ট্রান্সপ্লান্ট কমিটি থাকবে। অধ্যাপক বা পরিচালকের নিচে কেউ এর সদস্য হবে না। এই কমিটি থাকবে স্বাধীন; অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবেন তারা কেউ এই কমিটির মেম্বার হবেন না। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনে ডাটাবেজ একটি গোপনীয় বিষয় বলে বিবেচিত হবে এবং এখানে তথ্য প্রযুক্তি আইন প্রযোজ্য হবে না। মিথ্যা তথ্য দিলে এখানে শাস্তির বিধান রয়েছে এবং ডাটাবেজ সংরক্ষণ করতে হবে বলেও আইনে রয়েছে। কোন প্রতিষ্ঠান যদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন চায়, তাহলে অনুমতি নিতে হবে। যদি একটি পার্টিকুলার সংযোজন করতে চায় তাহলেও অনুমোদন নিতে হবে। এজন্য নির্ধারিত ফরম থাকবে, যাতে প্রয়োজনীয় তথ্য থাকবে। বর্তমান আইনে মিথ্যা তথ্য দিলে তিন বছর কারাদ- ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা ও লাইসেন্স বাতিলের বিধান রয়েছে। সংশোধনী আইনে আরও উল্লেখ রয়েছে, ক্যাডাভেরিক (মৃত) ব্যক্তির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনে জাতীয় কমিটি থাকবে। এ কমিটির কার্যক্রম পরিচালনা করবে ১৯ সদস্যের জাতীয় কমিটি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ কমিটির প্রধান হবেন। কমিটিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের প্রতিনিধি, বিএমডিসির সভাপতি, বিএমএ সভাপতি বা তার প্রতিনিধি, সুপ্রীমকোর্ট বার সমিতির প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টরা থাকবেন। এ কমিটির সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করবেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস এ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালের পরিচালক। কমিটি স্বাস্থ্য অধিদফতরের এ সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয়কারীর কার্যক্রম তদারকি করবে এবং ক্যাডাভেরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন সহজ করার পরামর্শ দেবে। এই কমিটি মেডিক্যাল বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা করে মৃত ব্যক্তি থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহ ও সংযোজনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এ কমিটি বিভিন্ন ধরনের উপকমিটি গঠন করে কার্যক্রম পরিচালনা করবে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনের জন্য ট্রান্সপ্লান্ট কমিটি থাকবে। তবে প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত কেউ এ কমিটিতে থাকতে পারবে না। খসড়া আইন অনুযায়ী যেসব আইসিইউতে কোন রোগীর ব্রেন ডেথ হয়েছে বলে ঘোষণা করা হবে, তাদের সঙ্গে সমন্বয়কারীর মাধ্যমে যোগাযোগ করতে হবে। বিযুক্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সচল রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। মৃত ব্যক্তি মৃত্যুর আগে তার কোন আত্মীয়কে তার অঙ্গ দান করে গেলে তা অগ্রাধিকার দেয়া হবে। তুলনামূলকভাবে কম বয়সীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। খসড়া আইনে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করার পদ্ধতিতে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি তার নিকটাত্মীয়কে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিতে চাইলে সরকারের কাছে আবেদন করবে। আবেদন পাওয়ার পর আত্মীয়তা যাচাই-বাছাই করা হবে। দাতা-গ্রহীতার জন্ম নিবন্ধনপত্র ও জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দিতে হবে। উভয়ে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্ট্যাম্পে হলফনামা দেবে। এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্র, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার তদন্ত প্রতিবেদন, প্রয়োজনে বাবা-মায়ের ক্ষেত্রে ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। এসব তথ্য যাচাই করে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে ব্যর্থ হলে অথেন্টিফিকেশন বোর্ডে পাঠানো হবে। এই বোর্ড গঠন করা হবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একজন পরিচালক ও দুজন উপ-পরিচালকের সমন্বয়ে। দাতা-গ্রহীতার আত্মীয়তা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর বোর্ড অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। এসব খুব দীর্ঘ ও রোগীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ প্রক্রিয়া বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) মহাসচিব অধ্যাপক ডাঃ ইকবাল আর্সলান জানান, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন চলবে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী। সাধারণত চিকিৎসকরা মানুষের জীবন-মরণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলেন না। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনে রোগীর স্বজন শনাক্তকরণ বিষয়ে চিকিৎসকদের ওপর কঠিন শর্ত বর্তানো ঠিক হবে না। শনাক্তকরণের সঙ্গে চিকিৎসকদের সম্পৃক্ততা থাকে না। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের মাধ্যমে শনাক্তকরণ পর্যায় চূড়ান্ত হওয়ার পরই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনে চিকিৎসকরা হাত দেন বলে জানান অধ্যাপক ইকবাল আর্সলান।
×