ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

তানভীরের ছেলের ১০ দিন রিমান্ড চাইবে, জিয়াকে ধরতে সর্বশক্তি নিয়োগ

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬

তানভীরের ছেলের ১০ দিন রিমান্ড চাইবে, জিয়াকে ধরতে সর্বশক্তি নিয়োগ

শংকর কুমার দে ॥ রাজধানীর আজিমপুরের জঙ্গী আস্তানা থেকে অভিযানের সময়ে আটক নিহত জঙ্গী তানভীর কাদেরী ওরফে আবদুল করিম ওরফে জামশেদের ছেলে চৌদ্দ বছর বয়সী তাহরীম কাদেরী ওরফে রাসেলকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেফতার দেখিয়ে দশ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে রবিবার কাউন্টার টেররিজম ইউনিট আদালতে পাঠাবে বলে জানা গেছে। আজিমপুরের জঙ্গী আস্তানায় যাতায়াতকারী গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার মাস্টারমাইন্ড নুরুল ইসলাম মারজান ওরফে শাকিল, আরেক শীর্ষ জঙ্গী বাসারুজ্জামান ওরফে রাহুলের খোঁজে মাঠে নেমেছে গোয়েন্দারা। আজিমপুরের জঙ্গী আস্তানা থেকে পালিয়ে যাওয়া মিরপুরের রূপনগরে নিহত জঙ্গী মেজর (অব) জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী নারী জঙ্গী জেবুন্নাহার শিলার এখনও হদিস মেলেনি। অভিযানের সময় আহতাবস্থায় আটক তিন নারী জঙ্গী আফরিন ওরফে প্রিয়তি, আবেদাতুল ফাতেমা ওরফে খাদিজা, শায়লা আফরিন পুলিশ প্রহরায় কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে চিকিৎসাধীন আছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশ সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আজিমপুরের জঙ্গী আস্তানায় অভিযানকালে পুলিশের ওপর ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিহত জঙ্গী তানভীর কাদেরীর ছেলে চৌদ্দ বছর বয়সী তাহরীম কাদেরী ওরফে রাসেলকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে ভুল তথ্য দিয়ে পুলিশকে বিভ্রান্ত করেছে সে। টানা জিজ্ঞাসাবাদে তার কাছ থেকে পরে অবশ্য পুলিশ অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদ্ধার করেছে বলে পুলিশের দাবি। আজিমপুরের জঙ্গী আস্তানায় অভিযানের ঘটনায় লালবাগ থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে যে মামলা দায়ের করা হয়েছে তাতে পাঁচজনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে তাহরীম কাদেরী রাসেল ছাড়াও অন্য আসামিরা হলোÑ তিন নারী জঙ্গী আফরিন ওরফে প্রিয়তি, আবেদাতুল ফাতেমা ওরফে খাদিজা, শায়লা আফরিন ও নিহত জঙ্গী তানভীর কাদেরী। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শীর্ষ জঙ্গী বাসারুজ্জামান ওরফে রাহুল আজিমপুর জঙ্গী আস্তানায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু গত ১০ সেপ্টেম্বর রাতে পুলিশ অভিযান চালানোর আগেই তিনিসহ আরও কয়েকজন পালিয়ে যান। এর মধ্যে রূপনগরে নিহত জঙ্গী মেজর জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার শিলাও ছিল। তাদের সঙ্গে পালিয়ে যায় মেজর জাহিদের ছোট এক মেয়ে এবং আত্মহত্যা করা জঙ্গী তানভীর কাদেরীর এক ছেলে। বাসারুজ্জামানের সঙ্গে যে ছেলেটি রয়েছে সে তানভীর কাদেরীর আরেক ছেলে। এরা যমজ দুই ভাই। যমজ ভাইয়ের মধ্যে পুলিশের কাছে আটক একজন হচ্ছে তানভীর কাদেরীর আরেক ছেলে রাসেল। মূলত পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতেই যমজ দুই ভাইকে আলাদা করে রাখা হয়েছিল। কেননা পুলিশ গুলশান হামলার পর থেকেই জেনেছিল যে, দুই যমজ ভাই রয়েছে এক জঙ্গীর পরিবারে। তার নাম আব্দুল করিম ওরফে জামশেদ করিম। আর সে নিহত হওয়ার পর পুলিশ তার নাম তানভীর কাদেরী জানতে পারে। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাসারুজ্জামানকে খুঁজতে এরই মধ্যে মাঠে নেমেছে গোয়েন্দারা। বাসারুজ্জামান দেখতে কেমন, তিনি কী করেন, তার বাড়ি কোথায়, কোথায় কোথায় বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন, কার কার সঙ্গে মিশতেনÑ এর সবই মোটামুটিভাবে জেনে গেছেন গোয়েন্দারা। আজিমপুরের জঙ্গী আস্তানা থেকে আটক হওয়া ছেলে রাসেলের কাছ থেকে গোয়েন্দারা এ ব্যাপারে জানতে পেরেছেন বলে জানা গেছে। তবে রাসেলও যে বরাবরই মিথ্যা কথা বলে আসছে তার প্রমাণও পেয়েছেন গোয়েন্দারা। তাই রবিবার তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দশ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানোর কথা রয়েছে। রিমান্ড পেলে তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তবে বাসারুজ্জামান যে ঢাকাতেই আছে তার প্রমাণও এরই মধ্যে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন। এছাড়াও শীর্ষ জঙ্গী নুরুল ইসলাম মারজান, মেজর (চাকরিচ্যুত) সৈয়দ জিয়াউল ইসলাম জিয়া ও বাসারুজ্জামাকে খুঁজে পেতেই সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশ। নিহত জঙ্গী দম্পতি উচ্চশিক্ষিত ॥ একটি বেসরকারী ব্যাংকের উচ্চপদের কর্মকর্তা ছিলেন তানভীর কাদেরী আর স্ত্রী আবেদাতুল ফাতেমা খাদিজা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে কাজ করছিলেন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায়। উচ্চশিক্ষিত এ দম্পতি কিভাবে জঙ্গীবাদে জড়ালেন তার উত্তর খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা। প্রাথমিক অনুসন্ধানে তারা জানতে পেরেছে, দুই বছর আগে সৌদি আরব থেকে ফিরে আসার পর তাদের বদলে যাওয়ার তথ্য পেয়েছে তারা। ২০১৪ সালে হজ করতে সপরিবারে সৌদি আরবে যান তানভীর কাদেরী। সেখান থেকে ফিরে আসার পর তানভীরের মধ্যে ধর্মীয় উগ্রতা ধরা পড়ে আত্মীয়দের চোখে। ফাতেমাও তখন থেকেই হিজাব পরা শুরু করেন। গাইবান্ধার বাটিকামারি গ্রামের এসএম বাতেন কাদেরীর ছেলে তানভীর গাইবান্ধা সরকারী বালক বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৪ সালে এসএসসি এবং তার দুই বছর পর গাইবান্ধা সরকারী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে ঢাকা কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতক করে একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করেন। লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে দুটি বেসরকারী কোম্পানি ঘুরে সর্বশেষ ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং শাখায় উচ্চপদে যোগ দিয়েছিলেন তানভীর। হজ থেকে ফিরে ২০১৪ সালে ছেড়ে দেন সে চাকরি। এরপর ‘আল সাকিনা হোম ডেলিভারি সার্ভিস’ নামে একটি ব্যবসা শুরু করেন তিনি। ফাতেমার সঙ্গে তানভীরের সংসার জীবন প্রায় দেড় দশকের। ২০০১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের ব্যাংক কর্মকর্তা আবদুল তাওয়াতের মেয়ে ফাতেমার সঙ্গে বিয়ে হয় তার। ফাতেমা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’-এ চাকরি করতেন। তিনিও জঙ্গীবাদী তৎপরতায় জড়িত বলে পুলিশের ধারণা। গত ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকার আজিমপুরের ছয়তলা ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি ভাড়া বাসায় পুলিশের অভিযানের সময় নিহত হন তানভীর কাদেরী। ওই বাসা থেকে আহতাবস্থায় যে তিন নারীকে আট করা হয়েছিল তাদের একজন আবেদাতুল ফাতেমা ওরফে খাদিজা। তাদের যমজ দুই ছেলে ঢাকার একটি স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র, যার মধ্যে রাসেল নামের একজন সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেফতার হয়েছে। নিহত জঙ্গীই করিম নামে বসুন্ধরায় বাসা ভাড়া নেয় ॥ তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত আগস্ট মাসের শেষদিকে নারায়ণগঞ্জে পুলিশী অভিযানে নব্য জেএমবির নেতা তামিম চৌধুরী নিহত হওয়ার পর জঙ্গী দলটির সমন্বয়কের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছিলেন তানভীর কাদেরী, যিনি আব্দুল করিম ও শমসেদ নামে সংগঠনে পরিচিত ছিলেন। করিম নাম ব্যবহার করেই তিনি বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় গুলশান হামলাকারীদের জন্য ফ্ল্যাট ভাড়া করেছিলেন। আহত তিন নারী জঙ্গীকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আজিমপুরের বাসায় অভিযানে গেলে তিন নারী জঙ্গী মরিচের গুঁড়া ও ছোরা নিয়ে তাদের ওপর হামলা চালায় বলে সেদিন জানিয়েছিলেন পুলিশ কর্মকর্তারা। আজিমপুরের বাসায় কারা কারা আসত তা জানার চেষ্টা করছি। কিছুদিন আগে ওই বাসা ভাড়া নেয় জানিয়ে তারা বলেছে, যারা আসত তারা তানভীর কাদেরীর সঙ্গে দেখা করতে আসত। কী নিয়ে তাদের আলোচনা হতো তা জানার চেষ্টা চলছে। বিশেষ করে গ্রেফতার হওয়া তিন নারী জঙ্গীর মধ্যে দুই নারী জঙ্গী আফরিন ওরফে প্রিয়তির স্বামী গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড নুরুল ইসলাম মারজান ও শায়লা আফরিনের স্বামী বাসারুজ্জামানের যে আজিমপুরের জঙ্গী আস্তানায় যাতায়াত ছিল তার তথ্য পাওয়ার পর তাদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। আহতাবস্থায় গ্রেফতার হয়ে পুলিশ প্রহরায় কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিন নারী জঙ্গী আফরিন ওরফে প্রিয়তি, আবেদাতুল ফাতেমা ওরফে খাদিজা ও শায়লা আফরিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে।
×