ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মন্ত্রীর ঘোষণায়ও কোন কাজ হচ্ছে না

আমদানির পরেও দাম কমছে না লবণের

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬

আমদানির পরেও দাম কমছে না লবণের

এম শাহজাহান ॥ চাহিদা মেটাতে দেড় লাখ টন আমদানির পরও লবণের দাম কমছে না। খুচরা পর্যায়ে প্রতিকেজি ভোজ্য লবণ বিক্রি হচ্ছে ৪২-৪৫ টাকায়, যা গত কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ দাম। সিন্ডিকেট চক্রের কারসাজিতে কোরবানির দিন প্রতিবস্তা লবণ তিনগুণ বেশি দামে বিক্রি হয়েছে। এত দাম দিয়েও দেশের কোথাও কোথাও কাঁচা চামড়া সংরক্ষণে লবণ পাওয়া যায়নি। দরপতন হয়ে অর্ধেকে নেমে আসে চামড়ার দাম। আর এতে করেই সারাদেশের চামড়ার মৌসুমী ব্যবসায়ীরা এবার বড় অঙ্কের লোকসান গুনলেন। তবে কাঁচা চামড়া সংরক্ষণে ভারত থেকে আমদানিকৃত দেড় লাখ টন লবণ আগামী সপ্তাহ নাগাদ দেশে আনা হচ্ছে। ইতোমধ্যে অপরিশোধিত লবণ ভর্তি দুটি জাহাজ বাংলাদেশের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছে। এই লবণ কোরবানির আগে কেন দেশে আনা হলো না তা নিয়ে এখন সর্বত্র বিতর্কের ঝড় বইছে। বলা হচ্ছে, এটাই অব্যবস্থাপনা। আর এতেই সিন্ডিকেট চক্র লবণের দাম বাড়ানোর সুযোগ নিয়েছে। এ কারণে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের ঘোষণার পরও লবণের বাজার স্বাভাবিক হয়নি। এদিকে লবণের ঘাটতি পূরণে দেড় লাখ টনের পর আরও এক লাখ টন লবণ আমদানির প্রক্রিয়া শুরু করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এক্ষেত্রে হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে সুযোগ না দিয়ে প্রকৃত মিল মালিকদের মধ্যে সমহারে বণ্টন করে লবণ আমদানির জন্য সুপারিশ করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। আশা করা হচ্ছে, আমদানিকৃত এসব লবণ দেশে বাজারজাতকরণ শুরু হলে দাম স্বাভাবিক হয়ে আসবে। ভোক্তাদের নাগালের মধ্যে চলে আসবে লবণের দাম। এদিকে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত মুনাফা এবং মনোপলি বাণিজ্য করার কারণে নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে লবণের দাম। খুচরা পর্যায়ে প্রতি প্যাকেট ভোজ্য লবণ বিক্রি হচ্ছে ৪২-৪৫ টাকায়, যা গত কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ দাম। এছাড়া ঈদ-উল-আযহার দিন দাম অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় চামড়ার মৌসুমী ব্যবসায়ীরা বড় অঙ্কের লোকসানের মুখে পড়েন। লবণ ইস্যুতে পানির দরে চামড়া কিনে নেন পোস্তার আড়তদার ও ট্যানারি মালিকরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন সারাদেশে কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ে ধস নামার মূলে ছিল লবণের অতিরিক্ত দাম। এদিকে বাজার ঘুরে দেখা গেছে বর্তমান খুচরা পর্যায়ে প্রতিকেজি প্যাকেট লবণ অতিরিক্ত দামে বিক্রি হচ্ছে। ব্র্যান্ডখাত প্রতিকেজি লবণ ৫০ টাকা ছুঁই ছুঁই করছে। এছাড়া আয়োডিনহীন খোলা লবণ খুচরা পর্যায়ে প্রতিকেজি ২৪-২৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া চামড়ায় ব্যবহার করা হয় লবণের (৭০ কেজি) বস্তা বিক্রি হচ্ছে ১৬শ’ থেকে ১৮শ’ টাকায়। কোরবানির দিন দেশের কোথাও কোথাও চাহিদাকে পুঁজি করে ২ হাজার টাকা বস্তা বিক্রি করা হয়েছে। তবে চাহিদা কমায় পাইকারি বাজারে এখন লবণের দাম কিছুটা কমতির দিকে। তবে খুচরা পর্যায়ে লবণের দাম কমার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন জনকণ্ঠকে বলেন, আমদানিকৃত লবণ দেশে আসলেই লবণের বাজার স্বাভাবিক হয়ে আসবে। ভোক্তা স্বার্থ বিবেচনায় নিয়েই এ বছর প্রথম পর্যায়ে দেড় লাখ টন লবণ আমদানি করা হয়েছে। এছাড়া আরও এক লাখ টন লবণ আমদানির প্রক্রিয়া শীঘ্রই শুরু করা হবে। তিনি বলেন, লবণ অতি প্রয়োজনীয় একটি পণ্য। এই পণ্যটি নিয়ে কোন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কারসাজি করার সুযোগ নেই। এছাড়া দেশীয় লবণ চাষীদের বিষয়টিও সরকারের সক্রিয় বিচেনায় রয়েছে। তাই প্রকৃত ব্যবসায়ী এবং মিল মালিকরাই লবণ আমদানির সুযোগ পাবেন। লবণের বাজার স্বাভাবিক রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। জানা গেছে, কোরবানি ঈদ সামনে রেখে এবার লবণ সিন্ডিকেট চক্র প্রথম থেকে সক্রিয় ছিল। তাই গত বছরের ৫০০ টাকা বস্তা লবণ এবার ২ হাজার টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছে আড়ত ও ট্যানারি মালিকদের। এতে করে দাম কমিয়ে চামড়ার বাজার মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে। ফলে মৌসুমী ব্যবসায়ীরা বড় অঙ্কের লোকসানের মুখে পড়েন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পোস্তার আড়ত মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড এ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস এ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব হাজী মোঃ টিপু সুলতান জনকণ্ঠকে বলেন, লবণের দাম বেশি হওয়ায় চামড়ার দাম কমাতে হয়েছে। অথচ চামড়ার প্রাণ লবণের দাম স্বাভাবিক থাকলে মৌসুমী ব্যবসায়ীরা লোকসানের হাত থেকে রক্ষা পেতেন। তিনি বলেন, গত বারের চেয়ে এবার তিনগুণ দামে লবণ কিনতে হয়েছে। কোরবানি ঈদ সামনে রেখে দাম বাড়াতে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অপতৎপরতা বেড়ে গিয়েছিল। সংগঠনের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লবণের বাজার আর স্থিতিশীল থাকেনি। এদিকে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতিকেজি লবণ ২০ টাকায় বাজারজাতকরণের ঘোষণা দিয়েছেন সাধারণ মিলমালিকরা। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলের লবণ মিলমালিকরা বলছেন, প্রতিকেজি লবণ ২০ টাকায় ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করা সম্ভব। এজন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে প্রকৃত ও সাধারণ মিল মালিকদের মধ্যে সমহারে লবণ বণ্টন ও আমদানির অনুমতি প্রদানের দাবি জানানো হয়েছে। অন্যথায় সিন্ডিকেট চক্রের কালো থাবায় দেশে ৬০ টাকায়ও লবণ মিলবে না বলে তাদের পক্ষ থেকে হুঁশিয়ার করা হয়েছে। ইতোমধ্যে আমদানিতে অতিরিক্ত বরাদ্দ চেয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে পূবালী, মোল্লা, ক্রিস্টাল সুপার সল্ট, এসিআই এবং কনফিডেন্স নামক লবণ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। লবণের বাজার অস্থির এবং অতিরিক্ত মুনাফা করার কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভোক্তা পর্যায়ে অভিযোগ রয়েছে। চট্টগ্রাম অঞ্চল লবণ মিলমালিক সমিতির সভাপতি নূরুল কবির এবং কক্সবাজার জেলা লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি শামসুল আলম আজাদ সম্প্রতি সারাদেশে প্রতিকেজি লবণ ২০ টাকায় বিক্রির ঘোষণা দিয়েছেন। বাণিজ্য সচিবের সঙ্গে দেখা করে এ সংক্রান্ত একটি লিখিত প্রস্তাবও তাদের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, এই দুই জেলায় প্রায় দুই শতাধিক লবণের মিল রয়েছে। কিন্তু তাদের অপরিশোধিত লবণের ঘাটতি রয়েছে। তাই গুটিকয়েক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান লবণ আমদানির সুযোগ পেলে তারা একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ নেবে। পাশাপাশি সাধারণ মিলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই সমহারে লবণ বণ্টন ও আমদানির সুযোগ দিয়ে বাজার মূল্য স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া জরুরী। জানা গেছে, চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে দেড় লাখ টনের পর আরও এক লাখ টন লবণ আমদানির অনুমতি দেয়া হচ্ছে। মিলমালিকরা বলছেন, ইতোমধ্যে দেড় লাখ টন লবণের বরাদ্দ ও বণ্টন সঠিকভাবে করা হয়েছে। লবণের দাম কমাতে সরকারের এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। আশা করা হচ্ছে, আমদানিকৃত লবণ দেশে আসা মাত্র লবণের দাম আসবে। জানা গেছে, এর আগে বাজারে লবণের ঘাটতি পূরণ ও কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণ করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত ১৪ আগস্ট ৭৫ হাজার ভোজ্য ও ৭৫ হাজার টন শিল্পে ব্যবহৃত লবণ আমদানির অনুমতি দেয়। লবণ বিপণনকারীরা জানিয়েছেন, গত বছর সেপ্টেম্বর মাসেও প্রতি কেজি ভালমানের লবণের দাম ছিল কেজিপ্রতি ২৫ থেকে ২৬ টাকা। এখন তা ৪২ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
×