ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদের ছুটিসহ আটদিনে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ১০৩ ;###;ঈদের আগে সড়ক নিরাপত্তায় পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন হয়নি

সড়ক নিরাপত্তায় সিদ্ধান্ত অনেক কিন্তু বাস্তবায়নে- ॥ নজরদারির অভাব

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬

সড়ক নিরাপত্তায় সিদ্ধান্ত অনেক কিন্তু বাস্তবায়নে- ॥ নজরদারির অভাব

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ঈদে নিরাপদ সড়ক যোগাযোগ নিশ্চিত করতে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের কথা কেউ এখনও ভোলেননি। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে খোদ মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টরা বারবার বলেছিলেন সড়ক নিরাপত্তার নানান নির্দেশনার কথা। বলা হয়েছিল, মহাসড়কে নিষিদ্ধ যানবাহন চলবে না। সিটি সার্ভিসগুলো কোন অবস্থাতেই যাত্রী পরিবহন করতে পারবে না। উল্টোপথে বা বেপরোয়া গাড়ি চালানো হলে নেয়া হবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। ছাদে যাত্রী পরিবহন বন্ধ। লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালকদের গাড়ি চালানো নিশ্চিত করারও কথা ছিল। ছিল এরকম আরও ডজনখানেক সিদ্ধান্ত। কিন্তু এর বেশির ভাগই বাস্তবায়ন হয়নি। পরিবহন নেতা থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারী সিদ্ধান্তের বেশির ভাগই পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়া ও প্রয়োজনীয় নজরদারির অভাবে সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রা বেড়েছে। সব মিলিয়ে সড়কে মৃত্যুর মিছিল চলছেই। ঝরছে রক্ত। গত আট দিনে সড়কে গেছে শতাধিক প্রাণ। ঈদের ছুটিতে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ৪৪ জন নিহত ও দুই শতাধিক আহত হয়েছেন। ছুটি শেষে শুক্রবার এক দিনেই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান ২১ জন, আহত হন অর্ধশতাধিক মানুষ। শনিবার দুপুরের আগেই সড়কে ঝরেছে আরও ১১ প্রাণ। সব মিলে গত আট দিনে শতাধিক নিহত ও চার শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। সর্বশেষ শনিবার সকালে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর ও কালিহাতী উপজেলায় যাত্রীবাহী বাস ও ইটভর্তি ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে মা-ছেলেসহ ৭ জন নিহত ও কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছেন। আর একই দিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার হেকিমগঞ্জ এলাকায় বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে ৪ জন নিহত ও অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। জানতে চাইলে নৌ-সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে জনকণ্ঠকে বলেন, মূলত তিনটি কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে। তিনি বলেন, আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো বেপরোয়া গাড়ি চালানো ও চালকদের সচেতনতার অভাব, সড়ক-মহাসড়কে ট্রাফিক পুলিশের গাফিলতিসহ যাত্রীদের সচেতনতার অভাব। সবাই সচেতন থাকলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকটাই রোধ করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। সিটি সার্ভিস মাইক্রোবাস ও নিষিদ্ধ পরিবহনই দুর্ঘটনার কারণ ॥ মহাসড়কে অবাধে চলছে রাজধানীতে চলা সিটি সার্ভিসগুলো। যদিও ঈদের আগে এসব পরিবহন মহাসড়কে চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এছাড়াও নসিমন, করিমন, মহেন্দ্রসহ মহাসড়কে নিষিদ্ধ পরিবহন চলছে অবাধে। গত কয়েক দিনের সড়ক দুর্ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অদক্ষ চালক, বেপরোয়া ড্রাইভিং, নিষিদ্ধ পরিবহন চলাচলসহ বেপরোয়া বাস চালানো দুর্ঘটনার মূল কারণ। শুক্রবার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে যাত্রীবাহী বাস ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে বরসহ একই পরিবারের ৮ জন নিহত হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ১০টার দিকে উপজেলার শশই নামক স্থানে সিলেটগামী এনা পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাসের (ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৭৮৫১) সঙ্গে মৌলভীবাজার থেকে আসা বরযাত্রীবাহী নোহা মাইক্রোবাসের (ঢাকা মেট্রোÑচ-১৩-৯২২৬) মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলেই মাইক্রোবাসে থাকা বরযাত্রীসহ ৭ জন মারা যান। গুরুতর আহত অজ্ঞাত একজনকে জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির জানান, সকাল ১০টার দিকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বিজয়নগর উপজেলার শশই এলাকায় সিলেটগামী এনা পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে বিপরীত দিক থেকে আসা অপর একটি মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই মাইক্রোবাসের আট আরোহী মারা যান। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও দুইজন। তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। পরিবহন নেতারা জানিয়েছেন, মাইক্রোবাসটি আরেকটি বাসকে অভারটেক করে দ্রুত যাওয়ার সময় এনা পরিবহনের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। একই দিন ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কের কালিহাতী উপজেলার পুংলি নামক স্থানে যাত্রীবাহী বাস উল্টে ৫ জন নিহত ও অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছেন। এলেঙ্গা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ জাহাঙ্গীর আলম জানান, ঢাকা থেকে রংপুর-লালমনিরহাটগামী একটি যাত্রীবাহী বাস টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার পুংলি নামক স্থানে শুক্রবার ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে অপর একটি বাসকে ওভারটেক করার সময় উল্টে রাস্তার পাশে পড়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই তিনজন নিহত ও অন্তত ২৬ জন আহত হন। শুক্রবার দুপুরে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার বড়ব্রিজ নামক স্থানে যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে মহেন্দ্র পরিবহনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই চারজন নিহত ও কমপক্ষে ১০ যাত্রী আহত হয়েছেন। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার আরাকান মহাসড়কের পটিয়া আমজুরহাট এলাকায় সৌদিয়া বাস ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে মাইক্রোবাসের চালক মোঃ আবদুল মোনাফ (২৬) ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে শুক্রবার বিকেলে বরযাত্রীবাহী বাস উল্টে এক যুবক নিহত ও ৩০ জন আহত হয়েছেন। গ্রামবাসী জানিয়েছেন, ঈদে ঢাকা থেকে ঘরমুখো যাত্রীদের নিয়ে একটি টাউন সার্ভিস বাস (ঢাকা মেট্রো-জ-১৪-০৮৭১) মহিমাগঞ্জে আসে। পরবর্তীতে ঢাকাগামী যাত্রীদের জন্য বাসটি মহিমাগঞ্জে অবস্থান করছিল। বাড়তি টাকা আয়ের জন্য বাসের হেলপার ওই বিয়ের যাত্রীবহনের কাজ করছিল। মহাখালী আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ আব্দুল মালেক জনকণ্ঠকে বলেন, ঈদের সময় যাত্রাপথে সড়কে গাড়ির চাপ বেশি থাকে। এজন্য বেপরোয়া চালানোর কোন সুযোগ থাকে না। তাই দুর্ঘটনাও কম হয়। ফেরার পথে ফাঁকা রাস্তা। বেশিরভাগ গাড়িই ৭০ থেকে ১০০ কিলোমিটার গতিতে চলাচল করে। অর্থাৎ বেপরোয়া গতিতে চলায় দুর্ঘটনা ঘটছে। এছাড়াও যেসব গাড়ি হাইওয়েতে চলার কথা নয় সেগুলো হরদম চলছে। দেখার কেউ নেই। এই পরিবহন নেতা বলেন, গত কয়েক দিনে আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো দুর্ঘটনার পেছনে সড়কে চলা নিষিদ্ধ পরিবহন যেমন- লেগুনা, ইজিবাইক, অটোরিক্সা, নসিমন, ভটভটি, মহেন্দ্রসহ স্বল্পগতির অন্যান্য পরিবহনই দায়ী। অনভিজ্ঞ চালক ও অসাবধানতাও দুর্ঘটনার কারণ। সড়ক-মহাসড়কে নিষিদ্ধ পরিবহন চলাচল বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, সিলেট এনা পরিবহনের সামনে আরেকটি বাসকে অভারটেক করে মাইক্রোবাসটি চলে আসে। এনা বাসের চালক অনেক চেষ্টা করেও দুর্ঘটনা এড়াতে পারেননি। তিনি এ দুর্ঘটনার জন্য মাইক্রোবাস চালককে দায়ী করেন। ঈদের ছুটিতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১০৩ ॥ ঈদ-উল-আযহার ছুটিসহ মোট আট দিনে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ১০৩ জন নিহত ও ৪২৪ জন আহত হয়েছেন। নিহতের তালিকায় ৯ জন নারী ও ১৩টি শিশু রয়েছে। গত ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন সড়ক, মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কে এসব হতাহতের ঘটনা ঘটে। শনিবার নৌ-সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। বিভিন্ন পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ, অনলাইন নিউজপোর্টাল, সংবাদ সংস্থা ও টেলিভিশন চ্যানেলের ওপর পর্যবেক্ষণ চালিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়। প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়, সরকার নির্বাহী আদেশে ১১ সেপ্টেম্বর সাধারণ ছুটি ঘোষণা করায় ঈদের আগে শেষ কর্মদিবস ছিল ৮ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার। সেই হিসেবে কার্যত পরদিন ৯ সেপ্টেম্বর শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন থেকেই শুরু হয় ঈদের টানা ছুটি। ওই দিন সড়ক দুর্ঘটনায় এক শিশুসহ নিহত হন চারজন এবং আহত হন ৯৪ জন। ১০ সেপ্টেম্বর ২২ জন নিহত ও ৫৩ জন আহত হন। নিহতের মধ্যে এক নারী ও এক শিশু রয়েছে। ১১ সেপ্টেম্বর নিহত ও আহত হয়েছেন যথাক্রমে- ৯ ও ৪৪ জন। নিহতের তালিকায় এক নারী ও দুই শিশু রয়েছে। ১২ সেপ্টেম্বর এক নারী ও এক শিশুসহ ১০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৩৯ জন। ১৩ সেপ্টেম্বর নিহত ও আহত হয়েছেন যথাক্রমে- ১০ জন ও ১৭ জন। নিহতের মধ্যে রয়েছেন দুই নারী ও তিন শিশু। ১৪ সেপ্টেম্বর চার নারী ও তিন শিশুসহ নিহত হয়েছে ১৯ জন; আহত হয়েছে ৫১ জন। ১৫ সেপ্টেম্বর ছয়জন নিহত ও ১৩ জন আহত হয়েছেন। নিহতের মধ্যে এক শিশু রয়েছে। ১৬ সেপ্টেম্বর নিহত হয়েছে ২৩ জন; যার মধ্যে রয়েছে এক শিশু। আর এদিন আহত হয়েছে ১১৩ জন। জাতীয় কমিটির পর্যবেক্ষণে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে পাঁচটি প্রধান কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলো হলোÑ ঈদে বিভিন্ন মহাসড়ক ও ফেরিঘাটে তীব্র যানজটের কারণে সময় ব্যয় হওয়ায় ফাঁকা রাস্তায় বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, দীর্ঘ ছুটির কারণে সড়ক-মহাসড়কে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালনে উদাসীনতা, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছতে যাত্রীদের বারবার তাগিদের কারণে চালকের অন্যমনষ্কতা, অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ সামাল দিতে বাড়তি ট্রিপ দেয়ার কারণে চালকের সাময়িক শারীরিক ও মানসিক ভারসাম্যহীনতা এবং দ্রুত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে ওভারটেকিংয়ের ক্ষেত্রে চালকদের মাঝে ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে অনুসরণ না করার প্রবণতা।
×