ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মাতাল চালককে ধরতে পুলিশের অভিযান, এখনও ধরা পড়েনি ঠিকাদারপুত্র

ছোট ভাই দম্পতির মৃত্যুর খবরে বড় ভাইয়ের স্ট্রোকে মৃত্যু

প্রকাশিত: ০৬:০১, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

ছোট ভাই দম্পতির মৃত্যুর খবরে বড় ভাইয়ের স্ট্রোকে মৃত্যু

আজাদ সুলায়মান ॥ ঈদের ছুটিতে রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় মাতাল চালকের বেপরোয়া ড্রাইভিংয়েই প্রাণ দিতে হয়েছে আতাউর রহমান ও তার স্ত্রী রওশন আরাকে। সারারাত মদ খেয়ে মাতাল চালক ভোরের ফাঁকা রাজপথে বেপরোয়া প্রাইভেটকার চালানোর খেসারত দিতে হয়েছে এ প্রবীণ দম্পতিকে। পুলিশ ওই চালকের সন্ধান পেলেও তাকে ধরতে পারছে না। এদিকে ছোট ভাই সস্ত্রীক প্রাণ হারানোর ঘটনা সইতে না পেরে স্ট্রোক করে মারা গেছেন বড় ভাই ইদ্রিস আলী। শুক্রবার সকালে তিনি রায়েরবাগের নিজ বাসায় হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়েন। মুহূর্তেই তার মৃত্যু ঘটে। বয়স হয়েছিল আশির কাছাকাছি। জানা যায়, ইদ্রিস আলী গত বুধবার শেওড়াপাড়ায় তার ছোট ভাই আতাউর রহমান ও তার স্ত্রী রওশন আরা নিহত হওয়ার খবর শুনে রায়েরবাগ থেকে ছুটে যান লাশ দেখতে। সেখানে গিয়ে শুনতে পান এক মাতাল চালকের খামখেয়ালিপনায়ই প্রাণ দিতে হয়েছে এ দম্পতিকে। তখন থেকেই তিনি কিছুটা অস্বাভাবিক হয়ে পড়েন। এটা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। শেওড়াপাড়া থেকে বাসায় ফেরার পর থেকেই তিনি ছিলেন বেশ শোকার্ত। শুক্রবার সকালে তিনি হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়েন। ডাক্তার পরে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। শুক্রবারই গ্রামের বাড়ি নবাবগঞ্জের আলগায় তাকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানেই দাফন করা হয়। নিহত দম্পতির শেওড়াপাড়ার বাসায় শুক্রবার মিলাদের আয়োজন করা হয়। সেখানে উপস্থিত স্বজনরাও এ দুর্ঘটনাকে অবিশ্বাস্য ও রহস্যজনক বলে উল্লেখ করেন। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা তদন্তে পুলিশ বেশ সক্রিয় দাবি করলেও গত তিন দিনেও ঘাতক চালককে আটক করতে পারেনি। তবে পুলিশ নিশ্চিত হতে পেরেছে, ওই প্রাইভেটকারের মালিক আশিকুর রহমান খান। তিনি পেশায় ঠিকাদার। দুর্ঘটনার সময় তার ছেলে নাসিফ খান ওরফে অনি ও তার কয়েক বন্ধু গাড়িতে ছিল। তারা সবাই ছিল মাতাল। গাড়িতে বসেই তারা কোক দিয়ে হেগ ব্র্যান্ডের মদ খাচ্ছিল। গাড়িটি আটকের পর এর ভেতর থেকেই উদ্ধার করা হয় একটি বড় কোক ও মদের বোতল। গাড়িটি নাসিফ খান অনির চালানোর পক্ষে প্রমাণাদি পাওয়া গেছে। পুলিশ পরপর দু’দিন ওই ঠিকাদারের শাহীনবাগের বাসায় হানা দিয়েছে। কিন্তু মহল্লাবাসাী পুলিশকে জানিয়েছেন, ঘটনার পর ওই বাসায় তালা লাগিয়ে পরিবারটি সরে পড়েছে। পুলিশ তাকে ধরার জন্য শুক্রবার রাজধানীর মিরপুরের একটি বাসায় হানা দেয়। এ বিষয়ে পুলিশ জানায়, ঘাতক চালক সম্পর্কে বেশ চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। তারা গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে পারবে না। শীঘ্রই ধরা পড়ে যাবে। উল্লেখ্য, ঈদের ছুটিতে ফাঁকা রাজধানীতে বুধবার সকাল ছয়টার পর এলিয়েন মডেলের একটি নীল রঙা টয়োটা গাড়ি শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডের কাছে হাজী আশ্রাফ আলী মার্কেটের সামনে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মচারী আতাউর রহমান (৭৮) ও তার স্ত্রী রওশন আরা বেগমকে (৬০) ধাক্কা দেয়। এতে দু’জনেরই মৃত্যু হয়। ফজরের নামাজ পর আতাউর-রওশন আরা দম্পতি তাদের পূর্ব শেওড়াপাড়ার বাসা থেকে বেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। মোহাম্মদপুরে বড় মেয়ের বাসায় যাওয়ার জন্য যানবাহন খুঁজছিলেন তারা। এ সময় একটি দ্রুতগামী ব্যক্তিগত গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-গ-২১-৮৫৭১) বেপরোয়াভাবে ছুটে এসে আতাউর রহমানকে চাকায় পিষ্ট করে। কারের বাম্পারে আটকে যান আতাউরের স্ত্রী রওশন আরা। এভাবেই তাকে ২০ গজ টেনে নিয়ে গাড়িটি সড়ক বিভাজকের সঙ্গে প্রচ- ধাক্কা খায়। ঘটনাস্থলে আবেদ আলী (৬০) নামের এক পানের দোকানিও গুরুতর আহত হন। তিনি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের পরিছন্নকর্মীও। ঘটনার সময় তিনি রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছিলেন। স্থানীয় লোকজন গাড়িচালক ও আরোহীদের গণপিটুনির পর ছেড়ে দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। আতাউর রহমান ৯২১ পূর্ব শেওড়াপাড়ার একটি বাড়িতে সপরিবারে থাকতেন। রওশন আরা ছিলেন গৃহিণী। নিহত দম্পতির দুই মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছেন। দুই মেয়ে বিবাহিত। কাফরুল থানার পুলিশ জানিয়েছে, ফজরের পর এমনিতেই ফাঁকা থাকা পরিবেশে মাতাল চালকের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর খেসারত দিতে হয়েছে ওই দম্পতিকে। এটা নির্ঘাত মার্ডার কেসের মতো অপরাধ। গাড়িটি তখন কাজীপাড়ার দিক থেকে আসছিল। গাড়িতে তিন থেকে পাঁচ যুবক ছিল। তারা মদ্যপ অবস্থায় ছিল বলে তাদের মনে হয়েছে। দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া গাড়ি থেকে বের হয়ে তারা তাৎক্ষণিক দৌড়ে পালায়। জানতে চাইলে কাফরুল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শিকদার শামীম হোসেন বলেন, নিহত দম্পতির ছেলে রায়হান বাদী হয়ে কাফরুল থানায় দুর্ঘটনাজনিত মামলা করেছেন। ব্যক্তিগত গাড়ির চালকের নাম-ঠিকানা পাওয়া গেছে। তাকে ধরতে অভিযান চলছে। ব্যক্তিগত গাড়িটি তিনবার হাতবদল হয়েছে। গাড়ির সবশেষ মালিকের নাম-ঠিকানা পাওয়া গেছে। একটি ঠিকানায় অভিযান চালিয়ে মালিককে পাওয়া যায়নি। সম্ভাব্য স্থানগুলোতে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। পুলিশ সূত্র জানায়, দুর্ঘটনায় দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া গাড়িটির ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে আশিকুর রহমান খান নামে একজনের পরিচয়পত্র। পরিচয়পত্রে তাকে ঠিকাদার হিসেবে লেখা রয়েছে। তারই ছেলে নাসিফ। পুলিশ জানায়, নীল রঙের টয়োটা এলিয়েন মডেলের গাড়িটি ২০০৮ সালে নিবন্ধন করা হয়। এরপর লিখিতভাবে দু’বার মালিকানা পরিবর্তন হয়। সবশেষে আসে আশিকুর রহমানের হাতে। এখন তিনিই মালিক। এদিকে, তেজগাঁওয়ের শাহীনবাগে আশিকুর রহমানের বাসায় গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। প্রতিবেশী এক যুবক জানান, আশিকের ছেলে নাসিফ প্রায়ই বাবার গাড়িটি চালায়। বেপরোয়া গাড়ি চালানোই তার শখ। ওই শখের বশেই ঈদ-উল-আযহার দিন মঙ্গলবার রাত দেড়টার দিকে নাসিফ তার এক বন্ধুর সঙ্গে গাড়ি নিয়ে বের হয়। সকালে নাসিফ তার শাহীনবাগের বাসায় ফেরে। কিন্তু ঘণ্টা দুয়েক পর পুরো পরিবার সিএনজিচালিত অটোরিক্সায় করে বাড়ি ছেড়ে যায়। তারপর থেকে বাসায় তালা ঝুলছে।
×