ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সন্দেহভাজনদের তথ্য থানাকে অবহিত করতে নগরবাসীর প্রতি ডিএমপি কমিশনারের আহ্বান

মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভাড়াটিয়া সেজে জঙ্গীরা আস্তানা গড়ে তুলছে

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভাড়াটিয়া সেজে জঙ্গীরা আস্তানা গড়ে তুলছে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ মিথ্যা তথ্য দিয়ে বাড়িভাড়া নিচ্ছে জঙ্গীরা। তারা ভাড়াটিয়ার তথ্য যাচাই-বাছাই না হওয়ার সুযোগ নিচ্ছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়েই জঙ্গীরা রাজধানীতে একের পর এক আস্তানা গড়ে তুলছে। সম্প্রতি রাজধানীতে বেশ কয়েকটি জঙ্গী আস্তানার সন্ধান মেলে। সেসব আস্তানায় অভিযান চালানোর পর বাড়িওয়ালার কাছে হতাহত জঙ্গীদের দেয়া তথ্য মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে। এজন্য নতুন করে সন্দেহভাজন ভাড়াটিয়াদের সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট থানাকে অবহিত করতে নাগরিকদের অনুরোধ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত ১ জুলাই রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানের কূটনৈতিকপাড়ায় হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গী হামলায় ১৭ বিদেশী ও তিন বাংলাদেশী এবং দুজন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন। পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে নিহত হয় জঙ্গী নিবরাস ইসলাম, খায়রুল ইসলাম পায়েল, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্ব¡ল, মীর সামিহ মোবাশ্বেরও রোহান ইবনে ইমতিয়াজ। অভিযানে নিহত শরীয়তপুরের সাইফুল ইসলাম চৌকিদারও জঙ্গী ছিল বলে তদন্তকারীদের সন্দেহ। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, জঙ্গীদের থাকার বিষয়ে নারায়ণগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হলি আর্টিজান ঘটনার মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজা করিমের। হাসনাত করিম জঙ্গীদের থাকার জন্য নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রোভিসি গিয়াস উদ্দিন আহমেদের বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ই ব্লকের ই-৩ নম্বর বাড়িটিতে তুলে দেন। জঙ্গীদের থাকার বিষয়ে গিয়াস উদ্দিনেরও যোগসূত্র ছিল। যে তথ্য দিয়ে জঙ্গীদের ওই বাড়িতে তোলা হয়েছিল, পরবর্তীতে তা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। একইভাবে ভুয়া তথ্য দিয়ে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের বৃহত্তম ঈদ জামাতে হামলার চেষ্টাকারী জঙ্গীরা পাশের একটি বাড়িতে উঠেছিল। জঙ্গীরা পুলিশের বাধায় ঈদ জামাতে হামলা করতে ব্যর্থ হয়ে, গ্রেনেড মেরে দুই পুলিশকে হত্যা করে। পরবর্তীতে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে হামলাকারী জঙ্গী শফিউল নিহত হয়। গত ২৬ জুলাই রাজধানীর কল্যাণপুরের ৫ নম্বর সড়কের ৫৩ নম্বর ছয়তলা জাহাজ বিল্ডিংয়ে জঙ্গী আস্তানায় অভিযানে নয় জঙ্গী নিহত হয়। আহত অবস্থায় গ্রেফতার হয় জঙ্গী রাকিবুল হাসান রিগ্যান। পরবর্তীতে পালিয়ে যাওয়া জঙ্গী ইকবালও গ্রেফতার হয়। তদন্তকারীরা বলছেন, জঙ্গীরা ওই ভাড়া বাড়িতে উঠেছিল ভুয়া তথ্য দিয়ে। গত ৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর রূপনগর আবাসিক এলাকার ৩৩ নম্বর সড়কের ১৪ নম্বর ছয়তলা বাড়িতে পুলিশের অভিযানে নিহত নব্য জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা সাবেক মেজর জাহিদুল ইসলাম ওরফে মেজর মুরাদ। সেও মিথ্যা তথ্য দিয়ে বাড়িভাড়া করেছিল বলে পরবর্তীতে পুলিশ ও বাড়িওয়ালা নিশ্চিত হয়। একই অবস্থা প্রতিটি জঙ্গী আস্তানার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সর্বশেষ গত ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরে মহিলা জঙ্গীদের আস্তানা আবিষ্কৃত হয়। আস্তানায় অভিযানকালে আত্মহত্যা করে জঙ্গী তানভীর কাদেরী। আস্তানা থেকে এক বছরের শিশুপুত্র নিয়ে পালিয়ে যায় রূপনগরে নিহত জঙ্গী মেজর মুরাদের স্ত্রী জেবুন্নাহার শিলা। সেখান থেকে আহত অবস্থায় গ্রেফতার হয় আর্টিজানে জঙ্গী হামলার মাস্টারমাইন্ড পলাতক নুরুল ইসলাম মারজানের স্ত্রী আফরিন ওরফে প্রিয়তি, পলাতক শীর্ষ জঙ্গী নেতা জামান ওরফে বাসারুজ্জামানের স্ত্রী শায়লা আফরিন ও আত্মহত্যা করা জঙ্গী তানভির কাদেরীর স্ত্রী আবেদাতুল ফাতেমা ওরফে খাদিজা। আস্তানা থেকে উদ্ধার হওয়া তিন শিশু সন্তানের মধ্যে দুই জনকে তাদের দাদা-দাদি ও নানা-নানির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। একজনের বয়স বারো বছরের বেশি হওয়ায় তাকে পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা মিথ্যা তথ্য দিয়ে বাড়িভাড়া নিয়েছিল। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, দেশের প্রায় সকল বিভাগীয় শহরেই বাড়িভাড়া আইন মেনে চলতে বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়াদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বাড়িওয়ালাদের ভাড়াটিয়াদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে। এমন আইন অন্যান্য বিভাগীয় শহরের তুলনায় ঢাকায় বেশি কার্যকর। প্রতিটি বাড়িওয়ালাকে ভাড়াটিয়ার যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণ করতে বলা হয়েছে। এজন্য ঢাকা মহানগর পুলিশের তরফ থেকে নির্ধারিত ফরম পর্যন্ত বিতরণ করা হয়েছে। এখনও ভাড়াটিয়াদের তথ্য সংগ্রহের কার্যক্রম অব্যাহত আছে। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে একটি সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের কাজ চলছে। বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়াদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে কম্পিউটারে। পাশাপাশি প্রতিটি ভাড়াটিয়ার নামে একটি পিন নম্বর দেয়ার কাজ চলছে। ওই নম্বরের মাধ্যমে একজন ভাড়াটিয়া সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য জানা যাবে। ভাড়াটিয়া বাড়ি পরিবর্তন করলে, ওই পিন নম্বরে ক্লিক করলেই ভাড়াটিয়ার অবস্থান জানা যাবে। সূত্র বলছে, এমন প্রযুক্তি ব্যবহারের পরেও মিথ্যা তথ্য দিয়ে বাড়িভাড়া নেয়ার প্রবণতা কমেনি। বিশেষ করে নানা অপরাধে জড়িতরা এভাবেই রাজধানীতে আত্মগোপনে থাকছে। মিথ্যা তথ্য দিয়ে বাড়িভাড়া নেয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি জঙ্গীদের। ভাড়াটিয়ার দেয়া তথ্যের ফিরিস্তি সংশ্লিষ্ট থানায় জমা হচ্ছে। কিন্তু সেই ফিরিস্তিতে যে তথ্য থাকছে, তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে না।
×