ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মৌলবাদী অর্থনীতির ভয়ানক ঝুঁকিতে দেশ

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

মৌলবাদী অর্থনীতির ভয়ানক ঝুঁকিতে দেশ

মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির ॥ দেশের স্বাধীনতা পরবর্তী ৩৫ বছরে মৌলবাদী অর্থনীতির পুঞ্জীভূত নিট মুনাফা ২ লাখ কোটি টাকা। আর গত এক বছরে মুনাফার পরিমাণ ২৮শ’ কোটি টাকা। এই মুনাফা পবিত্র ধর্মের ব্যানারে ওই গোষ্ঠীটি নানা কাজে ব্যবহার করেছে। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জঙ্গীপনা ও নব আঙ্গিকের সন্ত্রাসী কার্যক্রম। আছে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ আয়ত্তে আনা। সবচেয়ে বেশি পরিমাণ অর্থ খরচ করা হয়েছে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচার ঠেকানোর কাজে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গিয়ে এ গোষ্ঠীটি প্রথমে বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালকে চ্যালেঞ্জ করেছে। এতে ব্যর্থ হয়ে তারা বিশ্বের নামীদামী লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করেছে। কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ব্যয় করেও এদের সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত সফলতার মুখ দেখেনি। সরকারের কঠোর পদক্ষেপ ও দৃঢ়চেতা মনোভাবের জের হিসেবে ইতোমধ্যেই যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত-বিএনপির শীর্ষ কয়েক নেতা ফাঁসির রশিতে ঝুলেছে। অনেকের দ- কার্যকর হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। আবার অনেকের বিচার চলমান অবস্থায় রয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ পর্যন্ত ১৮৭ যুদ্ধাপরাধীর অভিযোগের তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ৫২ জন দ-িত হয়েছে ২৬ মামলায়। সরকার ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে, এ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। কোন অবস্থাতেই যুদ্ধাপরাধীরা ছাড় পাবে না। কিন্তু মৌলবাদী গোষ্ঠীর অর্থনীতির বিস্তৃতি ও বছর বছর এর মুনাফা সহিংসতার কাজে ব্যবহারের রুট থাকায় ঝুঁকি রয়েছে ভয়ানক পর্যায়ে। অপরদিকে, জঙ্গীপনায় জড়িতদের আদ্যোপান্ত সরকারের গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে। জঙ্গী আস্তানায় পরিচালিত অভিযানে শীর্ষ পর্যায়ের কয়েক জঙ্গী নেতা প্রাণ হারিয়েছে। কেউ কেউ এখন গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে। বিএনপির সঙ্গে গাটছড়া বেঁধে মৌলবাদী জামায়াতে ইসলামী বর্তমান সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে নানামুখী নাশকতামূলক তৎপরতা চালিয়েছে। এতে নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। সরকারী-বেসরকারী সহায় সম্পদ জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। অনেকে জীবনের তরে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। দফায় দফায় দেশের আনাচে কানাচে এ তৎপরতা দিনের দিন চালিয়েও তারা এর কোন সুফল নিজেদের শিবিরে তুলতে পারেনি। সর্বশেষ জঙ্গীপনার মাধ্যমে নতুন করে ষড়যন্ত্র চালানো হয়েছে। এতে টার্গেট কিলিংয়ের পাশাপাশি দেশী-বিদেশীদের পরিকল্পিতভাবে হত্যার মাধ্যমে দেশকে বিশ্বজুড়ে সমালোচনার নীল দরিয়ায় ডুবিয়ে দেয়ার চেষ্টাও চালানো হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাও ব্যর্থ হয়ে গেছে। যারা এখনও গ্রেফতারের আওতায় আসেনি তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান জোরালো এবং তা অব্যাহত রয়েছে। মৌলবাদীদের অর্থনীতি নিয়ে নিয়মিতভাবে গবেষণা করেন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত। শুক্রবার তিনি জনকণ্ঠকে জানান, আমি আগে থেকেই এদের আর্থিক পর্যায়ের শক্ত ভিত্তির কথা জানান দিয়েছিলাম। এদের মূলধন ও বছর বছর মুনাফার পরিমাণ শুনে অনেকে তা বিশ্বাস করেনি। কিন্তু আজ প্রমাণিত হচ্ছে এদের আর্থিক ভিত্তি কত মজবুত। মৌলবাদী অর্থনীতির অর্জিত এই বিশাল সম্পদ জাতীয়করণের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন এই অর্থনীতিবিদ। যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গীপনায় জড়িতরা এককথায় সকলেই মৌলবাদী। এই মৌলবাদীদের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের অনেকের বিচার কার্য সম্পন্ন হয়েছে। কয়েকজন ফাঁসিতে ঝুলেছে। পক্ষান্তরে, সম্প্রতি জঙ্গীপনায় জড়িতদের বিচার কাজ এখনও শুরু হয়নি। তবে ইতোপূর্বে শায়খ আবদুর রহমান, ছিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাই ও আতাউর রহমান সানির মতো কয়েক জঙ্গীর ফাঁসি হয়েছে। বর্তমানে সরকার বিএনপি-জামায়াতের সহিংস রাজনীতি, বিভিন্ন জঙ্গীগোষ্ঠীর জঙ্গীপনা দমনে ব্যাপক সফলতা অর্জন করার পর দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। জামায়াত নেতা নিজামী, বিএনপি নেতা সাকার মতো অপরাধীদের ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলানোর বিষয়টি প্রকৃত অর্থেই অত সহজ ছিল না। কিন্তু সরকার এতে সফল হয়েছে। এ অবস্থায় এসব অপরাধী চক্রের স্ত্রী, পুত্র, কন্যা ও নিকট স্বজনদের মাঝে প্রতিশোধ স্পৃহা যে জন্ম নেবে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। সঙ্গত কারণে, সমাজ বিজ্ঞানীসহ আইনজ্ঞদের বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, এসব নিকটজনদের গতি প্রকৃতি ও আর্থিক লেনদেন এবং কার্যক্রম সর্বক্ষণিকভাবে পর্যবেক্ষণে রাখা বাঞ্ছনীয়। ইতোমধ্যেই গোয়েন্দা তৎপরতায় আবিষ্কার হয়েছে, জঙ্গীপনার সঙ্গে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়া সদস্যও রয়েছে। এখানে আরও উল্লেখ্য, জামায়াতের শীর্ষ নেতা যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের এক পুত্রও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। অভিযোগ উঠেছে এরা কিন্তু থেমে নেই। মৌলবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে এরা নিয়ত যোগাযোগ রক্ষা করে সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে। বড় ধরনের কোন অঘটন নতুন করে ঘটানোর অপচেষ্টা যে চলছে তা নিয়ে গোয়েন্দাদের সতর্ক বার্তা রয়েছে। এ মুহূর্তে এসব অপকর্মের হোতারা কচ্ছপের মতো মাথা ঢুকিয়ে রেখেছে সত্য, কিন্তু যে কোন মুহূর্তে ছোবল মারতে তারা কখনও দ্বিধাবোধ করবে না। এরা অন্তর্জ্বালায় জ্বলছে। তাদের আপনজনদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করা হবে তা ইতোপূর্বে তারা চিন্তায়ও আনতে পারেনি। অথচ, বর্তমান সরকার সে অসাধারণ সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। মৌলবাদীদের আর্থিক কর্মকা-ের বিস্তৃতি ব্যাপক। ফলে তাদের অর্থের পরিমাণও বিপুল। ড. আবুল বারকাতের গবেষণা মতে, বেরিয়ে এসেছে গত পঁয়ত্রিশ বছরে মৌলবাদী অর্থনীতির পুঞ্জীভূত নিট মুনাফার পরিমাণ ২ লাখ কোটি টাকা। বিষয়টি রীতিমতো বিস্ময়কর হলেও তা যে স্বচ্ছ পানির মতো সত্য তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই এবং আর্থিকভাবে স্বচ্ছতার কারণে এরা নাশকতাসহ বর্তমান সরকার বিরোধী হেন কোন অপকর্ম নেই, যা করার সাহস করছে না। আর সরকারও যে এদের বিরুদ্ধে বিরাট ঝুঁকি নিয়ে তৎপর হবে তাও শতভাগ ভাবা যায়নি। এ কারণেই মৌলবাদীরা এখন ঘাপটি মেরে আছে। পর্যবেক্ষণ করছে সার্বিক পরিস্থিতি। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযুক্ত শীর্ষ কয়েক যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দ- ইতোমধ্যেই কার্যকর হয়েছে। কিন্তু রয়ে গেছে তাদের বিপুল পরিমাণ সম্পদ। দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে দেশী-বিদেশী পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে আর্থিকভাবে একটি ভিত্তি দাঁড় করিয়েছে। যে অর্থ সম্পদের মালিকানা এখন তাদের স্ত্রী, পুত্র এবং একান্ত আপনজনদের। তারা অর্জন করেছে নানামুখী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের ক্ষমতাও। যাদের দ- কার্যকর হয়েছে তাদের স্বজন এবং অনুসারীদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিশোধস্পৃহা সৃষ্টি হওয়া খুবই স্বাভাবিক বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সমাজবিজ্ঞানীরা। সরকার একটু নমনীয় হলেই এই গোষ্ঠীটি ক্রিয়াশীল হতে পারে এমনই আশঙ্কা তাদের। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সর্বদা সতর্ক থাকা সময়ের দাবি। মানবতাবিরোধী অপরাধে এ পর্যন্ত ফাঁসির দ- কার্যকর হয়েছে ৬ যুদ্ধাপরাধীর। এরমধ্যে ৫জনই স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা। তারা হলেন- দলটির আমির মতিউর রহমান নিজামী, মহাসচিব আলী আহসান মুজাহিদ, কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান ও মীর কাশেম আলী। প্রথম সারির নেতা ও বিভিন্ন পর্যায়ের বাহিনী প্রধানরা আর নেই। দ- কার্যকর হওয়া অপরজন হলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। আমৃত্যু কারাদ-ের রায় নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযম ও বিএনপি নেতা আবদুল আলীম। একেবারে শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সাজা এবং দ- কার্যকর হয়ে যাওয়ায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে গড়িমসি, রাজনীতি ও দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ আনার সুযোগ আর নেই। বরং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে সরকার। বাকি যারা রয়েছেন তারা বড় নেতা নন। ফলে তাদের বিচার নির্বিঘেœ সম্পন্ন হবে এমনই আশাবাদ বিচারপ্রত্যাশীদের। শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীরা একের পর এক দ-িত ও ফাঁসিতে ঝুললেও তাদের স্বজনদের মধ্যে তেমন অপরাধবোধ বা বিচলিত ভাব পরিলক্ষিত হয়নি। বরং আকারে ইঙ্গিতে এক ধরনের ঔদ্ধত্য মনোভাবই প্রকাশ করেছেন। বোঝাতে চেয়েছেন যে, তারাও একদিন দেখিয়ে দেবেন। বিশেষ করে সর্বশেষ মীর কাশেম আলীর স্বজনদের মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে দম্ভোক্তি। জামায়াতের এ নেতা একজন ধনকুবের। তার রয়েছে অঢেল সম্পদ ও ব্যবসা বাণিজ্য। জামায়াতের টাকার কুমির হিসাবে পরিচিত এ নেতা ছিলেন দলটির রাজনীতি পরিচালনার নেপথ্যে অনেক বড় এক ডোনার। দেশে-বিদেশে শতকোটি টাকা ঢেলে এবং লবিস্ট নিয়োগ করে তিনি শেষ চেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজকে রক্ষায় সফল হননি। মীর কাশেম আলী এবং দ-িত বাকি ৫ যুদ্ধাপরাধীর মতাদর্শের একটি গোষ্ঠী দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছে। একটানা প্রায় দুই যুগ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন থাকার সুবাদে তাদের শিকড় গজিয়েছে এদেশের মাটি ও সমাজে। যুদ্ধাপরাধী হিসাবে দেশের জনগণের কাছে তারা যতই নিন্দিত হোন না কেন, স্বজনদের প্রতিশোধস্পৃহা থাকা খুবই স্বাভাবিক। আর মনে প্রাণে প্রতিশোধপরায়ণরা যদি হন বিশাল অর্থ সম্পদ তথা বিত্তের মালিক তাহলে সরকারের বিশেষভাবে সতর্ক থাকার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বোদ্ধা মহল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঈদ-উল-আযহার দিন গণভবনে শুভেচ্ছা বিনিময়কালে বলেছেন, দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের কোন অস্তিত্ব থাকবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং সম্প্রতি জঙ্গীবিরোধী যে সাঁড়াশি অভিযান সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চালিয়েছে তাতে প্রধানমন্ত্রী এহেন দৃঢ়তায় আস্থা রাখতে চায় জনগণ। কিন্তু পাশাপাশি একটি শঙ্কাও রয়েছে। আর তা হলো দ-িত যুদ্ধাপরাধীদের রেখে যাওয়া বিশাল সম্পদের ভা-ার। অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি প্রশ্নÑ প্রতিশোধ গ্রহণের লক্ষ্যে তাদের সন্তানরা যে এই অর্থ-সম্পদ ব্যবহার করবে না তার নিশ্চয়তা কি? সর্বশেষ, সাকা চৌধুরীর মামলার রায়ের খসড়া ফাঁসের মামলায় বৃহস্পতিবার তার স্ত্রী ও পুত্র বেকসুর খালাস পেয়েছেন। আইনজীবীর দশ বছর ও চারজনের সাত বছর করে কারাদ- হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গীপনায় জড়িতদের নিকটাত্মীয়দের সার্বিক কার্যক্রম অত সহজভাবে না নিয়ে তা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা বাঞ্ছনীয়। কেননা, এরাও বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের জন্য প্রত্যেকে একেকটি কালসাপ। বিষয়টি সরকারের নীতি নির্ধারক মহলের ভাবনায় রাখার দাবি রয়েছে উৎসুক মহলগুলোর বিভিন্ন সূত্রের।
×