ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাড়ির ছাদে স্বপ্নের বাগান

কংক্রিটের মাঝেই দৃশ্যমান অনন্য সবুজের ছোঁয়া

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

কংক্রিটের মাঝেই দৃশ্যমান অনন্য সবুজের ছোঁয়া

মামুন-অর-রশিদ ॥ বাড়ির ছাদে সবুজ বাগান করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন রাজশাহীর গৃহবধূ শামীম আরা। এ বছর জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। মনোরম পরিবেশে থরে থরে সাজানো তার বাড়ির ছাদ যেন পুরো একটি সবুজ উদ্যান। সবুজ প্রকৃতি আর বৃক্ষপ্রেমী মানুষ চায় হাতের নাগালে যেন থাকে সবুজের ছোঁয়া। ইট-পাথরে জীবনে অনেকের ইচ্ছে থাকলেও তা সঠিকভাবে হয়ে উঠে না। একেবারে গ্রামের সবুজঘেরা জীবনের মতো না হলেও ছোট বাসা বাড়িতে মানুষ তৈরি করতে পারে সবুজ প্রকৃতির ছোঁয়া। সেই ধারণা থেকেই শামীম আরা কংক্রিটের মধ্যেই গড়ে তুলেছেন সবুজ বাগান। বাসাবাড়ির ছাদে পরিকল্পিত তার বাগান যেন হাতের নাগালে সবুজের ছোঁয়া। হাজারো গাছ গোছালির পাশাপাশি নিজের হাতে উৎপন্ন টাটকা শাক সবজি কিংবা ফলমূল সব কিছুর চাহিদার যোগান দিচ্ছে তার বাগান। শহুরে জীবনে সবুজের সজীব ছোঁয়ার মধ্যে বেঁচে থাকতে রাজশাহী মহানগরীর মহিষবাথান এলাকার শামীম আরা তার বাড়ির ছাদে বাগান শুরু করেছিলেন ২০১১ সালের শেষের দিকে। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে সেই শামীম আরাই হয়ে উঠেছেন ছাদে বাগান তৈরির মডেল। পেয়েছেন ছাদে বাগান করায় ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে দেশসেরা পুরস্কার। ফলদ, বনজ, ভেষজ বা ঔষধি, শোভাবর্ধনকারী, দেশীয় বিলুপ্তপ্রায় গাছ, বিরল জাতীয় গাছ, সবজি কি নেই তার বাগানে। ভালবাসার ছোঁয়ায় গড়ে তুলেছেন বাগানটি। আর গাছগুলো যেন নিজের সন্তানের মতো। কোন গাছের কি প্রয়োজন তা ভালভাবেই জানেন তিনি। নেন সেইভাবেই যতœ। বাগানে বিকেল থেকেই শুরু হয় নানান পাখির আনাগোনা। সবুজ ঘেরা প্রকৃতিতে পাখিদের মিষ্টি নানান শব্দ যেন মন ভরিয়ে দেয়। শামীম আরার স্বামী সেহাব উদ্দীন একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা। শামীম আরার এসব কাজে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা করে থাকেন তিনি। শুক্রবার তার বাড়ির ছাদে উঠতেই দেখা গেল হাজারো জাতের গাছ গাছালিতে ভরা। যে কেউ ভাসমান বাগানও ভাবতে পারেন। ছাদের চারপাশে ফলদ গাছের সমারোহ। শামীম আরা জানান, তার সংগ্রহে জিনিয়া পাম, থাইল্যান্ডের জাম, লটকন, শসা, জামরুল, এলাচী লেবু, ব্যানানা ম্যাংগো, পেঁপে, গৌড়মতি আম, সফেদা, মরিচ, কাগজি লেবু, মিষ্টি জলপাই, বাতাবি লেবু, মিষ্টি চেরি ফল, নাশপাতি, আতা, বিভিন্ন ধরনের পেয়ারা, কমলা, পাকিস্তানী মালটা, কামরাঙ্গা, কদবেল, ড্রাগন, মিষ্টি তেঁতুল, থাইড্রপ আম, তেঁতুল, কালো পাতার ব্ল্যাক বক্স আম, কলা, থাই জাম, দেশী জাম, করমচা, বিদেশী বেল, বেদানা, চেরি ফল, সজনে গাছ, থাইল্যান্ডের বাতাবী লেবু, সুদানের আতা, আপেল, অভিসারিকা আম, সুইট লেমন, থাই কাঁঠাল, বাউকুল, অরুনা (আম) সবই আছে। মসলা জাতীয় গাছের মধ্যে আছে অল স্পাইস, তেজপাতা, দারুচিনি, গোলাপজামন, ধনেপাতাসহ আরও অনেককিছু। শোভাবর্ধনকারী গাছগুলোর মধ্যে আছে, নীল অপরাজিতাসহ বিভিন্ন রঙের অপরাজিতা, ফায়ার বল, বিভিন্ন ধরনের জবা, এ্যাডেনিয়াম, এলামুন্ডা, ৩০ থেকে ৩৫ প্রজাতির গোলাপ, লাইলী-মজনু, বিভিন্ন ধরনের পাতা বাহার, সাইকাস, এ্যারোমেটিক জুঁই, টগর, কামিনী, মধুমালতি, মাধবীলতা, বিভিন্ন ধরনের অর্কিড, ক্যাকটাস, বেগুনিয়াসহ প্রায় ৭০ থেকে ৮০ প্রজাতির ফুল। বর্তমানে তাদের বাগানের গাছগুলোতে মালটা, ড্রাগন, করমচা, পেয়ার, বেদানাসহ বেশ কিছু ফল ধরে আছে। ফুটে আছে অনেক ফুল। শীতকালে এ পুরো ছাদই যেনো ফুলময় হয়ে ওঠে। শামীম আরা জানান, শৈশব থেকেই গাছের প্রতি তার চরম আগ্রহ ছিল। সেই থেকে শখ। বিয়ের পর থেকেই বাড়ির ছাদে গাছ লাগাতে শুরু করেন তিনি। নিজের প্রচেষ্টা আর স্বামীর অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায় বাড়ির ছাদে বাগানের সূচনা। শুরুর দিকে তারা বাগানে সবজির চাষও করতেন। পুঁই শাক, বিভিন্ন ধরনের সবুজ ও লাল শাক, মিষ্টি কুমড়া, সিম, টমেটো, ফুল কপি ও বাধা কপি, বেগুনও চাষ করা হতো ছাদে। বাড়ির সবজির চাহিদা ছাদের সবজি বাগান থেকেই পূরণ হয়ে যেত। তবে, বর্তমান সময়ে ছাদে সবজি চাষ কমিয়ে দিয়েছেন তারা। অন্য গাছগুলোর অসুবিধা হওয়ার কারণে তারা এ উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে এসব গাছগাছালির বেশির ভাগই গড়ে উঠেছে টবে। তিনি আরও জানান, ইট-পাথরের নগরে সবুজের ছোঁয়া একেবারে নেই বললেই চলে। অনেক খুঁজে পেতেও বাড়ি কিংবা এলাকার আশপাশে কোন গাছ পাওয়া যায় না আজকাল। অথচ এই যান্ত্রিক শহরে সবুজ প্রকৃতি খুবই জরুরী। এ অনুভবটা তিনি মনে করতেন। শামীম আরার স্বামী সেহাব উদ্দীন জানান, ছাদে বাগান করার ক্ষেত্রে মাটি পাওয়ার বিষয়টি বেশ সমস্যা হয়ে দেখা যায়। পদ্মা নদীর পলিমাটি সংগ্রহ করা হয়। সেই মাটির সঙ্গে গোবর, মিশ্র সার যোগ করা হয়। এরপরে সেগুলোতে গাছ লাগানো হয়। কৃষিবিদরা জানান, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন প্রয়োজন। প্রতিটি মানুষ দিনে ২২ হাজার বার নিঃশ্বাস নেয়। আর এতে করে একদিনে মানুষের অক্সিজেন প্রয়োজন হয় ১৬ কেজি। যার যোগান দেয় সাতটি গাছ। তাই নিজেদের সুস্থ থাকার তাগিদেই অধিক পরিমাণ গাছপালা লাগানো উচিত। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক দেব দুলাল ঢালী জানান, ছাদে বাগান সৃজন খুবই পরিশ্রমের বিষয়। অনেক যতœ-আত্তি করতে হয়। শামীম আরা বাগানের নিয়মিত পরিচর্যা করেছেন। সাফল্য পেয়েছেন। পরিবেশ অধিদফতর জাতীয়ভাবে পদক দিয়ে তাঁকে মূল্যায়ন করেছে। তিনি বলেন, কৃষি দফতর এমন বাগান গড়ে তুলতে উৎসাহ দিয়ে আসছেন। পরিবেশ সুরক্ষায় বাগান সৃজনের বিকল্প নেই। তিনি বাড়ির ছাদে ছাদে এমন বাগান সৃজনে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
×