ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মিয়ানমার সীমান্তে কাজই শুরু করা যায়নি

তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ॥ ধীরে চলার নীতি

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ॥ ধীরে চলার নীতি

রশিদ মামুন ॥ তেল গ্যাস অনুসন্ধানে পিছিয়ে পড়ায় সমুদ্র জয়ের সুফল ঘরে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। মিয়ানমার এবং ভারত তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কর্মসূচী নিচ্ছে। বাংলাদেশ এর বিপরীতে ধীরে চলার নীতি নিয়ে কাজ করছে। এক লাখ ২০ হাজার বর্গ কিলোমিটারের বিশাল সমুদ্র এলাকার মাত্র চার হাজার বর্গকিলোমিটারের তেল-গ্যাসের সুনির্দিষ্ট চিত্র রয়েছে পেট্রোবাংলার কাছে। এর বাইরে আরও ৫ হাজার ১৫৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকার আংশিক চিত্র পাওয়া গেছে। বাকি এক লাখ ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকায় তেল-গ্যাসের সঠিক চিত্র জানা নেই। বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সীমান্তে মিয়ানমার বড় কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্র পাওয়ার দাবি করছে। সেখানে এখনও এই এলাকায় অনুসন্ধান কাজই শুরু করতে পারেনি বাংলাদেশ। সম্ভাবনাময় হলেও এসব এলাকার ব্লকগুলো ইজারা দিতে ব্যর্থ হয়েছে পেট্রোবাংলা। বছরখানেক আগে সরকারের প্রভাবশালী একটি গোয়েন্দা সংস্থা সীমান্তবর্তী এলাকায় মিয়ানমারের তেল গ্যাস অনুসন্ধানে দেশীয় ব্লকগুলোর ঝুঁকির বিষয়টি তুলে ধরে সরকারকে সতর্ক করে চিঠি দিয়েছিল। ওই চিঠিতে বলা হয়েছিল একই ভূতাত্ত্বিক গঠনের হওয়ায় মিয়ানমার গ্যাস তোলা শুরু করলে দেশীয় ব্লকগুলো ঝুঁকির মুখে পড়বে। তেল গ্যাস অনুসন্ধানে কেন বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার সাবেক পরিচালক (পিএসসি) মোঃ কামারুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের মডেল পিএসসি’ (উৎপাদন বন্টন চুক্তি) নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আপত্তি রয়েছে। সংশোধন না করলে তারা আকৃষ্ট হবে না। এর বাইরে আমাদের দ্বিমাত্রিক জরিপ (মাল্টিক্লাইন্ট সিসমিক সার্ভে) করাটা জরুরী। যখনই তারা বুঝবে আমাদের এখানে সম্ভাবনা রয়েছে তখনই আকৃষ্ট হবে। তাদের আকৃষ্ট করতে যথেষ্ট তথ্য আমাদের হাতে নেই বলে জানান তিনি। সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে ২০০৮ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার সমুদ্রে তেল গ্যাস অসুন্ধান করতে দরপত্র আহ্বান করে। ওই দরপত্রে মার্কিন কোম্পানি কনোকো ফিলিপস ১০ এবং ১১ নম্বর ব্লক ইজারা পায়। কোম্পানিটি ২০১১ সালের জুনে সরকারের সঙ্গে পিএসসি সই করে। দুটি ব্লকের পাঁচ হাজার ১৫৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় দ্বিতীয়মাত্রার ভূ-কম্পন জরিপ চালানোর পর বলা হয় সেখানে অন্তত চার টিসিএফ গ্যাসের মজুদ রয়েছে। তবে কূপ খনন করার পর এই গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা দেখানো হয় মাত্র ২০ ভাগ, অন্যদিকে ৮০ ভাগই ঋণাত্বক বলে ধারণা দেয়া হয়। কনোকো ফিলিপস তাদের সঙ্গে স্বাক্ষরিত পিএসসির চেয়েও গ্যাসের অতিরিক্ত দর দাবি করে। যা আইনসঙ্গত না হওয়ায় সরকার ওই প্রস্তাবে সম্মত হয়নি। ফলশ্রুতিতে কনোকো ফিলিপস বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ারও সিদ্ধান্ত জানায় সরকারকে। ওই সময় আরও দুটি ব্লক ইজারা পেলেও চুক্তিও করেনি মার্কিন কোম্পানিটি। পরে ২০১৪ সালের ১৫ জুন ব্লক ছেড়ে যাওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয় কনোকো। এর বাইরে শুকিয়ে যাওয়া চার হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার সাঙ্গুর চিত্র রয়েছে পেট্রোবাংলার হাতে। বিশাল সমুদ্র এলাকার বাকি অংশ এখনও অজানা রয়ে গেছে। দেশের স্থলভাগে আর বড় মজুদ পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে মনে করা হয়। ইতোমধ্যে দেশের স্থলভাগের যে মজুদ তার অর্ধেক শেষ হয়েছে। এখন সাগরই একমাত্র ভরসা। বিশাল অর্থনৈতিক অঞ্চলে সম্পদের সঠিক পরিসংখ্যানই করতে পারেনি সরকার। এতে এককভাবে জ্বালানি আমদানির দিকে ঝুঁকছে দেশ। সরকার এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নিচ্ছে। সরকারের সঙ্গে দেশের এবং বহুজাতিক কোম্পানিও বাংলাদেশে এলএনজি ব্যবসার সম্প্রসারণে উদ্যোগ নিচ্ছে। শুধু আমদানির ক্ষেত্রে জ্বালানি নিরাপত্তার সঙ্গে অর্থনীতিও ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে বলে মনে করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানির আন্তর্জাতিক বাজারের স্থিতিশীলতা নেই। হঠাৎ জ্বালানির দর বাড়লে মূল্যস্ফিতি একধাপ বেড়ে যাবে। যা নিয়ন্ত্রণের জন্য নিজস্ব জ্বালানির সংস্থান থাকা জরুরী। সঙ্গত করণে সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান গুরুত্বপূর্ণ। সূত্রমতে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়লেও মিয়ানমার তার সমুদ্রসীমায় ব্লক এ-১, এ-২ এবং এ-৩, সুফু, সু এবং মিঞা নামের তিনটি বড় গ্যাস ক্ষেত্র পেয়েছে বলে দাবি করছে। ফলে এর সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের ব্লকগুলোও সম্ভাবনাময় বলে মনে করা হচ্ছে। বিগত ২০১২ সালের সমুদ্র বিজয়ের পর পেট্রোবাংলার তরফ থেকে জানানো হয়েছিল অন্তত সমীন্তবর্তী ব্লকগুলো ইজারা দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু সেই ব্যবস্থাও করতে পারেনি সংস্থাটি। সূত্র বলছে, মিয়ানমার রাখাইন প্রদেশের গভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনের জন্য বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে কয়েকটি চুক্তি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের শেল ওয়েল এবং জাপানভিত্তিক মিটস্যুউ ওয়েল কোম্পানি রয়েছে সাম্প্রতিক তালিকাতে। এছাড়াও ইউনিকল এবং কনোকো ফিলিপস, দক্ষিণ কোরিয়ার দায়িয়ূ মিয়ানমারের সমুদ্র এলাকায় কাজ করছে। সেখানে বাংলাদেশের সমুদ্রে ব্লক ইজারা দিতে চাইলে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। পিএসসি ২০১২-এর আওতায় ২০১৩ সালে অগভীর সমুদ্রে ৯টি ও গভীর সমুদ্রে ৩টি ব্লকের জন্য চার দফা দরপত্র ডাকে পেট্রোবাংলা। কিন্তু কোন দরপত্রেই বিশেষ সাড়া পাওয়া যায়নি। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো দরপত্র কিনে প্রি-বিড বৈঠকে অংশ নেয়। সেখানে বারবার তারা পিএসসি সংশোধনের ওপর জোর দেয়। পেট্রোবাংলা পিএসসি সংশোধন করে দাম কিছুটা বৃদ্ধিও করেছে। কিন্তু তাতেও যথেষ্ট সাড়া মেলেনি। চার দফা দরপত্রের পর চারটি ব্লকে মাত্র তিনটি দরপত্র জমা পড়ে। অগভীর সমুদ্রে এ এস-৪ এবং এসএস-৯ নম্বর ব্লকে ভারতীয় দুই কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশ লিমিটেড (ওভিএল) ও অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেডের (ওআইএল), ব্লক এসএস-৭ এ কনকো ফিলিপস এবং ব্লক ১১-তে স্যান্টোস-ক্রিস এনার্জি দর প্রস্তাব জমা দেয়। এরমধ্যে স্যান্টোস-ক্রিস এনার্জির সঙ্গে ২০১৪ সালের মার্চে চুক্তি হয়। ভারতীয় কোম্পানির সঙ্গে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে চুক্তি করা হয়েছে। তবে কনোকো ফিলিপস পরে এসএস-৭ নম্বর ব্লকের চুক্তিটি আর করেনি। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আরেকটি আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে পেট্রোবাংলা। একমাত্র দরদাতা হিসেবে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডিএস-১২, ডিএস-১৬ ও ডিএস-২১ এই তিন ব্লকের জন্য যৌথভাবে দরপ্রস্তাব জমা দিয়েছিল কনোকো ও স্টেট ওয়েল। তবে এখান থেকেও কনোকো নিজেদের সরিয়ে নেয়। ব্লক তিনটিতে স্টেট অয়েল কাজ করতে আগ্রহী। পেট্রোবাংলা বলছে এরমধ্যে আশা করা যাচ্ছে খুব শীঘ্রই ব্লক-১২ তে চুক্তি করা সম্ভব হবে। সেখানেও নতুন করে আগ্রহপত্র নিয়েছিল পেট্রোবাংলা। মিয়ানমার পেলেও বাংলাদেশ কেন বহুজাতিক কোম্পানিকে পাশে পাচ্ছে না জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন বলেন, মিয়ানমার যে প্রক্রিয়ায় কাজ দিয়েছে আমি সেই প্রক্রিয়া সমর্থন করি না। তিনি মনে করেন মিয়ানমার কাজ দেয়ার ক্ষেত্রে যেসব পন্থা অবলম্বন করছে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নয়। তিনি জানান, তেলের দাম কমে যাওয়ায় সারা বিশ্বেই একটি বিনিয়োগ মন্দা চলছে। বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ এই খাতে বিনিয়োগ অনেকাংশে কমে গেছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এখন নতুন জায়গাতে বিনিয়োগ করতে চাইছে না। এখন আমরা ওই সময় অতিক্রম করছি বলে উল্লেখ করেন তিনি।
×