ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সমাজ গঠনে প্রয়োজন নাট্যমঞ্চ

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

সমাজ গঠনে প্রয়োজন নাট্যমঞ্চ

নাটক আমাদের সাংস্কৃতিক জগতের বিশাল স্থান দখল করে আছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনেও এর প্রভাব সুদূর প্রসারী। আমাদের জীবনের চিত্র তুলে ধরার মাধ্যমে দৈনন্দিন জীবনের হাসি-কান্না, ঘাত-প্রতিঘাত, প্রেরণা-ক্ষোভ সবকিছুরই প্রতিফলন ঘটে নাটকের মঞ্চে। জীবন থেকে কুড়িয়ে নেয়া ছোট ছোট গল্পগুলোই অভিনয়শৈলীর মাধ্যমে দর্শকদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া মঞ্চ নাটকের মূল উদ্দেশ্য। নাটক জীবনের কথা বলে। নাটক হচ্ছে সমাজ নির্মাণের হাতিয়ার। কখনও কখনও সামাজিক বা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তৈরী হয় নাটক। সামাজিক অনাচার, অবিচার, শোষণ, বঞ্চনা ও কুসংস্কার নিয়ে তৈরি নাটক আমাদের সমাজকে সব সময়ই নাড়া দিয়েছে, পরিবর্তন এনেছে সমাজ মননে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ভাষা আন্দোলন, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে জনসমর্থন তৈরী করে জনতাকে জাতীয়তা বোধে উদ্বুদ্ধ করতে দেশের প্রত্যন্ত গ্রাম-গঞ্জে মঞ্চস্থ হওয়া যাত্রাপালা এবং নাটক বড় ভূমিকা রেখেছে। শুধু কি তাই, মানবিক মূল্যবোধ বিকাশে, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সম্প্রীতির সেতু বন্ধন তৈরিতে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। একটা সময় ছিল যখন প্রায় প্রতিটি গ্রামেই দু’একটি ক্লাব বা সংগঠন ছিল। সেখানে খেলাধুলা, নাচ, গান ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের চর্চার পাশাপাশি মঞ্চস্থ হয়েছে নাটক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও নাটকের চর্চ্চা হয়েছে। গ্রামের আবাল, বৃদ্ধ, বণিতা সকলেই সে নাটক উপভোগ করেছে। সেটি ছিল তাদের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম। এর পেছনে যারা কারিগর তারা ছিল নাটক পাগল মানুষ। তারা কেউ নাটক লিখতেন, কেউ বা অভিনয় করতেন। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন অসাধারণ, যাদের খবর আমরা জানি না। অনাদরে, অবহেলায় তারা কালের আবর্তে হারিয়ে গেছেন। নাটকের মধ্য দিয়ে তারা যেমন মনের খোরাক মিটিয়েছেন, তেমনি নীরবেই সামাজিক বিপ্লব ঘটিয়েছেন। কিন্তু সেদিন আর নেই। ধর্মীয় গোঁড়ামী আর আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে গ্রামে আর নাটক মঞ্চস্থ হতে দেখা যায় না। সেই সঙ্গে হারিয়ে গেছেন নাটক পাগল সেইসব গুণী নাট্যকর্মী। এখন বাঁশও নেই, বাঁশীও বাজে না। তেমনি এক নাটক পাগল মানুষ কাউনিয়া উপজেলার সাধু গ্রামের রফিকুল ইসলাম চৌধুরী। অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন, কিশোর বয়স থেকেই তিনি অভিনেতা বাবা ওসমান গণি চৌধুরীর হাত ধরে নাটকের সঙ্গে জড়িত হন। বিজয় নিশান নাটক দিয়ে মঞ্চে প্রবেশ। তাঁর মনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধে আছে নাট্যরস। অনেক বড় বড় পেশাদার নাট্য শিল্পীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মঞ্চ কাঁপিয়ে তিনি অভিনয় করেছেন। নাটকের নৌকা ভাসিয়ে শহর থেকে শহরে, গ্রাম থেকে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটে বেড়িয়েছেন মানুষকে আনন্দ দেবার জন্য। অনেকবার জেলা ও বিভাগীয় নাট্যেৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কারও পেয়েছেন। অভিনয় করেছেন দেড় শতাধিক নাটকে। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষকে জাগিয়ে তুলতে বাংলার গ্রাম-গঞ্জের পাড়ায়-মহল্লায় নাটকের দল নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। দেশাত্ববোধ আর পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে বাঙ্গালীর মনে প্রাণে আগুন জ্বালিয়েছেন নাটকের মাধ্যমে। তাদের দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সাবেক সাংসদ, রংপুরের বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা শাহ আব্দুর রাজ্জাক। গঙ্গা থেকে বুড়িগঙ্গা, ফরিয়াদ, সমাজ, অশ্রু দিয়ে লেখা, নূরল দিনের সারা জীবন, রূপবান, দেবী চৌধুরানী ইত্যাদি নাটকে তিনি অভিনয় করে দর্শক নন্দিত হয়েছেন। কথার ফাঁকে রফিকুল চৌধুরী পুরনো দিনের কথা স্মরণ করে অতীতে হারিয়ে যান। সম্বিত ফিরে বলেন, সেসব মজার দিন ছিল যা বর্ণনা করা সম্ভব না। আমরা খোলা মঞ্চে অভিনয় করতাম। তখন তো গ্রামে ডেকোরেটর ছিল না। এর ওর বাড়ি থেকে চৌকি নিয়ে এসে স্টেজ সাজানো হতো। দর্শকদের বসার জন্য খড় বিছানো হতো। পৌষ-মাঘের হাড় কাঁপানো শীতে চাদর মুড়ি দিয়ে গ্রামের বউঝিরাও খড়ের উপর বসে নাটক দেখত। হ্যাজাক বাতির আলোয় সেটি ছিল এক মোহনীয় দৃশ্য । চৌধুরী বলেন, সবচেয়ে ভাল লাগত যখন দর্শক নাটক দেখতে দেখতে কেঁদে ফেলত। ক্লাইমেক্সের সময় পিন পতন নীরবতা। আরও ভাল লাগত দর্শক যখন আমাকে জুতো দিয়ে ঢিল ছুড়তো। জুতোগুলোকে মনে হতো ফুলের তোড়া। বুঝতাম, আমার অভিনয় সার্থক। কারণ আমি বরাবরই ভিলেনের অভিনয় করতাম। তিনি হেসে বলেন, ভাল অভিনয়ের কারণে বেশ বিড়ম্বনাও পোহাতে হয়েছে। নবাব সিরাজুদ্দৌলা নাটকে মীর জাফরের অভিনয় করতাম। পরে দেখা গেল রাস্তায় দেখা হলে লোকজন মীরজাফর বলে গালি দিচ্ছে। কেউ আবার ভীড়ের মধ্যে চিমটি বা গুতো দিয়ে ফেলে। গুতো খেয়ে আমি সান্তনা খুঁজি, সে মীরজাফরকে গুতো দিয়েছে, আমাকে নয় হা..হা..হা। রফিকুল চৌধুরীর বয়স এখন সত্তর। গত বছর থেকে অভিনয় ছেড়েছেন। কেন ছাড়লেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আফসোস করে বললেন, অভিনয়ের কথা শুনলেই প্রাণটা নেচে ওঠে। কিন্তু পরিবেশ নেই। উগ্র মৌলবাদীদের কারণে গ্রামে আর মঞ্চ বানানো সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি স্কুল কলেজগুলোতেও নাটকের চর্চা বন্ধ হয়েছে। তাছাড়া আমার সঙ্গে যারা অভিনয় করতো সুশীল বর্মন, সৈয়দ আলী, ফজলু এরা অনেকেই মারা গেছেন। গ্রামে নাটক করে তো আর পয়সা পাওয়া যায় না। তাই অভাবের তাড়নায় অনেকেই নাটক ছেড়ে জীবিকা নির্বাহে মনোযোগ দিয়েছে। -আব্দুর রউফ সরকার রংপুর থেকে
×