নদী পথে নৌকা ভ্রমণ বাঙালীর অস্থিমজ্জায় মিশে আছে। উৎসব পার্বণে নানা আনুষ্ঠানিকতায় নৌ ভ্রমণ বাড়তি আনন্দ এনে দেয়। নদী তীরে বেড়াতে গেলে তো কথাই নেই। সারি সারি নৌকা থাকে ঘাটে। একটা সময় নদী তীরের গ্রাম ও চরগ্রামে একাধিক পয়েন্টে ছিল খেয়াঘাট। খেয়া পারের তরণী মাঝিদের হাঁক ডাকে মুখরিত থাকত। আর খেয়া ঘাটের অন্যতম প্রতীক ছিল বটপাকুড়ের গাছ ও তার নিচে বাঁশের মাচা। তার কাছেই ঝুপড়ি ঘরে থাকতো মাঝি। রাত বিরাতে জরুরী প্রয়োজনে খেয়া পারাপারের দরকার হলে মাঝিই একমাত্র ভরসা।
লঞ্চের সারেংয়ের মতো মাঝি হতো নৌকার সারেং।
আজ সেই খেয়াঘাট নেই, তবে নৌকার মাঝি আছে। যে কোন উৎসবে এই মাঝিরা নৌকা নিয়ে নদীর কিনারে খেয়াঘাটে ভিড়িয়ে অপেক্ষায় থাকে। যাত্রীদের হাঁকডাক করে। যার নৌকা দেখতে যত সুন্দর তার নৌকায় যাত্রীরা অকাতরে ওঠে। উৎসব পার্বণে সকলে মিলে এক সঙ্গে নৌকা ভ্রমণের আলাদা নৌকাও থাকে। এইসব নৌকা সাধারণ নৌকার চেয়ে কিছুটা বড়। ছইয়ের আকৃতি চ্যাপ্টা। একটু সাজানো। চারদিক খোলা। তার মধ্যে চারদিকে পানি ও দূরে কোথাও কোন তীর দেখা যায়। নদীর ধার দিয়ে গেলে গ্রাম চেনা যায়। কাছের কোন বাড়ির গাঁয়ের বধূ কিষাণ কিষাণীর দৈনন্দিন জীবনের চিত্র চোখে পড়ে। এই ধরণের ভ্রমণের আরেক নাম নৌবিহার।
বর্তমানে বছরে দুই ঈদে, বাংলা ও ইংরেজি নববষের্, শহুরে ও গ্রামীণ জীবনের কোন বড় অনুষ্ঠানে নদী ভ্রমণের আয়োজনে, অতিথিদের নিয়ে নৌকা করে বেড়ানোসহ নৌবিহার যোগ করা হয়। বিদেশের কোন রাষ্ট্রপ্রধান, বড় অতিথি, কোন দেশের বিশেষ মেহমান এলে সরকারীভাবে নৌবিহারের আয়োজন করা হয়। কোন অনুষ্ঠানের ফিল্ডট্রিপে বিনোদনের অধ্যায় যোগ করে নৌকা ভ্রমণকেই বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের খুলনায় কোন অনুষ্ঠানে বা বেড়াতে গেলে সুন্দরবন দেখার জন্য নৌ পথকে বেছে নেয়া হয়। বড় নৌকা বা ছোট লঞ্চে সকলে মিলে উঠে সুন্দরবনের ধার দিয়ে ভ্রমণের রোমাঞ্চ আলাদা। এই নৌবিহার সবচেয়ে আনন্দের ও উপভোগের।
ঢাকার কাছাকাছি কোন নদী, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জে নৌকা ভ্রমণের আয়োজন করা হয়। তবে এইসব নৌকা ভ্রমণের বেশিরভাগ হয় সরকারী পর্যায়ে। সাধারণ মানুষের নৌকা ভ্রমণ হয় নিজেদের অর্থে সাধ্যানুযায়ী। বগুড়ায় যমুনার তীরে সারিয়াকান্দি ও ধুনট এলাকায় নৌকা ভ্রমণের বা নৌবিহারের মৌসুম আছে, শীতকালে। এর বাইরে প্রতিটি ঈদে ও বাংলা নববর্ষে পহেলা ফাল্গুনে, ভ্যালেন্টাইনস ডে, ইংরেজি নববর্ষে পরিবার পরিজন বন্ধুবান্ধব মিলে নৌকা ভ্রমণ উৎসবে বাড়তি আনন্দ এনে দেয়। সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীতে নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর বড় তিনটি স্পট হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হার্ড পয়েন্টে, তার থেকে কিছুটা দূরে তীরের একটি স্থানে ও রিভেটমেন্টে।
যমুনায় পুরানো বাঁধের কাছে কিছুটা নিরিবিলি এক স্থানে দিনে দিনে বেশি মানুষের আনাগোনায় স্থানীয়রা নাম দিয়েছে প্রেম যমুনার ঘাট। এই ঘাটে উৎসব পার্বণে এতটাই ভিড় বেড়ে যায় যে, সব ধরণের নৌকা নিয়ে মাঝিরা অপেক্ষায় থাকে। মনে হবে রবীন্দ্রনাথের সুরে সকলে গান তুলেছে ‘কে যাবি পাড়ে ওগো তোরা কে আমি তরী নিয়ে বসে আছি নদী কিনারে... এই বেলা বেলা গেল আয় কে যাবি মিছে কেন কাটে তোর কত কি ভাবি...’।
নৌকা ভ্রমণের নৌকারও নানারকম ফের আছে। উৎসবের সময়টায় মাঝিরা নৌকা সাজিয়ে রাখে। দীর্ঘ নৌ ভ্রমণে শরীরটাকে এলিয়ে রাখার জন্য কোন কোন নৌকার ভিতরে বিছানারও ব্যবস্থা রাখা হয়। এইসব নৌকার ভ্রমণ পিয়াসীরা খাবার দাবারসহ সঙ্গী সাথীদের নিয়ে ওঠে। কেউ বাদ্যযন্ত্র নিয়ে সঙ্গীতের মূর্চ্ছনায় নৌবিহার উপভোগ করে। হার্ড পয়েন্টের এক মাঝি জানালেন, অনেক সময় শহরের লোকজন এসে পূর্নিমার রাতে নৌভ্রমণ করে কোন চরে গিয়ে রান্নাবান্না করে খায়। এমন স্নিগ্ধ রাতে নিসর্গের মধ্যে নৌকা ভ্রমণ হৃদয় জুড়িয়ে দেয়। এই ধরণের নৌকা ভ্রমণে নিরাপত্তার বিষয়টি দেখে স্থানীয় নৌপুলিশ। তাদের আগাম জানিয়ে পূর্ণিমা রাতে নৌকা ভ্রমণে যেতে হয়। রাতের নৌবিহারের অভিজ্ঞ এক চিকিৎসক ডা. সামির হোসেন মিশু জানালেন, বছর কয়েক আগে ডাক্তাররা মিলে এক পূর্ণিমা রাতে সারিয়াকান্দি থেকে নৌকাযোগে কাশবনের চরে গিয়ে পিকনিক করার পর অন্য বন্ধুরা প্রতি বছরই হৈ তোলে নিসর্গের এমন ভ্রমণের। দিনে নৌ ভ্রমণ ও স্নিগ্ধ রাতের নৌভ্রমণের মধ্যে অনেক পার্থক্য। যাদের রোমান্টিক মন আছে তাদের কাছে নিসর্গের নৌভ্রমণ অনেক আনন্দের ও মধুময়তার।
যমুনা তীরের লোকজন বলেন, একটা সময় যমুনায় কত খেয়া ঘাট ছিল। আজও খেয়া ঘাট আছে তা শুধু এক চর থেকে আরেক চরে যাওয়ার জন্য। উৎসবের সময় তীরের কিছু এলাকায় নৌকা ভিড়িয়ে ক্ষনিকের খেয়া ঘাটে পরিণত হয়। নৌকা ভ্রমণ শেষেই এই খেয়া ঘাট উঠে যায়।
-সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: