ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রাখাল শিশুর ঘুম ভাঙ্গে মোরগের ডাকে

উপকূলে রাখালজীবন

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

উপকূলে রাখালজীবন

মাসুদ, রুবেল, জাহিদ, ফারুক, আলমাস। ওরা সবাই রাখাল। চর-দ্বীপ গাঁয়ে গরু-মোষ চরানো ওদের কাজ। ঘাষ খাওয়ানো। গোসল করানো। খোয়ারে বাঁধা। দুধ দোয়ানো। চোর-ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষা। বন-জঙ্গলের মাঝে যেন হারিয়ে না যায়। এমন নানা কাজ ওদের। বয়স ওদের খুব বেশি নয়। সাত-আট থেকে বড় জোর পনেরো-ষোল বছর। এককথায় ওরা শিশু। যে বয়সে অন্য দশটা শিশু স্কুলে যায়। লেখাপড়া করে। মাঠ-ঘাটে খেলাধুলায় মেতে ওঠে। বাবা-মা কিংবা বড়দের হাত ধরে ঘুরতে বের হয়। সে বয়সে ওরা কাজ নিয়েছে গরু-মোষ রাখার। এতেই ওদের দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোটে। পরণের কাপড় জোটে। এমনকি সংসারের চাকাও ঘোরে। কৃষি অর্থনীতিতেও ওরা রাখছে কমবেশি ভূমিকা। কিন্তু এসব রাখাল শিশুর জীবন মানের পরিবর্তন আসে না। শিশুশ্রম নিষিদ্ধ আইনও ওদের নিবৃত্ত করতে পারে না। একঘেয়ে কঠোর পেশায় জীবনের শৈশব কাটিয়ে দিতে হয় রাখাল শিশুদের। যেখানে মেলে দেখা ॥ দেশের অন্যতম দ্বীপ জেলা পটুয়াখালী। জেলার দক্ষিণাংশে সাগরের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রয়েছে ছোট বড় শতাধিক দ্বীপ ও চর। অধিকাংশ দ্বীপ ও চর জনবসতির কারণে গাঁয়ে রূপ নিয়েছে। প্রায় প্রত্যেকটি দ্বীপে জনবসতি ছাড়াও রয়েছে ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চল। রয়েছে আবাদি-অনাবাদি জমি। বনাঞ্চল ও চারণ ভূমির কল্যাণে এসব চর, দ্বীপ গাঁয়ে গেলেই দেখা মেলে রাখাল শিশুদের। জেলার মূল ভূখ-ের সঙ্গে যুক্ত অভ্যন্তরীণ গ্রামগুলোতেও রয়েছে রাখাল শিশু। মোট কত শিশু এ পেশার সঙ্গে যুক্ত, এর সঠিক হিসেব বা পরিসংখ্যান কারো কাছে নেই। তবে বেশ কয়েকটি চর, দ্বীপ ও গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি জনপদেই অন্তত দশ থেকে ত্রিশ-চল্লিশ পর্যন্ত শিশু রাখাল রয়েছে। প্রতিটি চর ও দ্বীপে গড়ে সর্বনিন্ম ১০ শিশু ধরা হলে কেবলমাত্র চর-দ্বীপগুলোতেই রয়েছে হাজার রাখাল শিশু। এর বাইরে গ্রামগুলোতেও রয়েছে প্রচুর সংখ্যক রাখাল শিশু। চর-দ্বীপে পা রাখলে দেখা যায়, রাখাল শিশুরা গরু-মোষ চরিয়ে বেড়াচ্ছে। বাথানি, রাখাল ॥ পটুয়াখালীর ন্যায় দেশের উপকূলীয় দক্ষিণাঞ্চলের সব জেলায় কমবেশি রাখাল শিশু রয়েছে। তবে বিভিন্ন এলাকায় ওরা ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন ভোলা এলাকায় রাখাল শিশুরা ‘বাথানি’ নামে পরিচিত। পটুয়াখালী-বরগুনা অঞ্চলে ওদের ‘গরু রাখনি বা রাখইন্না’ বলা হয়। অন্যান্য অঞ্চলেও রাখাল শিশুদের রয়েছে ভিন্ন নাম। যেভাবে এরা পেশায় আসে ॥ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রধানত দারিদ্র্যের কারণে শিশুরা এ পেশায় আসে। যেসব পরিবার দরিদ্র অথচ জনসংখ্যা বেশি এবং বসবাস প্রত্যন্ত অঞ্চলে, এসব পরিবারের শিশুরা ইচ্ছেয় হোক কিংবা অনিচ্ছায় হোক, জড়িয়ে পড়ে রাখালের কাজে। মাত্র ছয়-সাত বছরেই গরুর দড়ি তুলে নিতে হয় ওদের হাতে। পটুয়াখালীর চর-দ্বীপাঞ্চলে এখনও অসংখ্য অবস্থাপন্ন পরিবার রয়েছে, যাদের পরিবার পিছু রয়েছে অনেক গরু-মোষ। শতাধিক গরু-মোষ আছে, এমন ধনী পরিবারের সংখ্যাও কিছু কম নেই। কিন্তু এসব পরিবারে গরু-মোষ দেখভাল করার কেউ নেই। তারাই দরিদ্র পরিবারের শিশুদের এ কাজে নিয়োজিত করে। প্রথম এক-দু’ বছর রাখাল শিশুদের কোন বেতন-ভাতা দেয়া হয় না। পেটে-ভাতে তাদের রাখালের কাজে রাখা হয়। বাড়তি হিসেবে দেয়া হয় পরণের কাপড়। তাও বছরে এক-দু’বারের বেশি নয়। এ সময়টাকে ‘শিক্ষা নবিসকাল’ বলা হয় এবং বয়সে বড় কোন যুবক কিংবা বৃদ্ধের অধীনে থেকে কাজ শিখতে হয়। এক-দু’ বছর পর যখন শিশুরা গরু-মোষ রাখার কাজে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠে, তখন তাদের বেতন নির্ধারণ করা হয়। শুরুতে অবস্থা অর্থাৎ গরুমোষের সংখ্যার ওপর নির্ভর করে বেতন দেয়া হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রথমদিকে মাসে এক-দেড়শ’ টাকার বেশি দেয়া হয় না। যদিও এলাকা ভেদে কোন কোন শিশু শুরুতে তিন-চারশ’ টাকা কিংবা আরও বেশি বেতন পেয়ে থাকে। তবে সে সংখ্যা খুবই কম। বছর যত গড়ায়, বেতন তত বাড়ে। অধিকাংশ শিশু বেতনের অর্থ পরিবারের হাতে তুলে দেয়। বেতন দেয়া হয় তিন-চার মাস পর পর। আবার অভিভাবকরাও অনেক সময় মহাজনের কাছ থেকে শিশুর বেতন নিয়ে আসে। শিশুর এ অর্থে স্বাচ্ছন্দ্য না ফিরলেও সংসারের চাকা কিছুটা সচল হয়। রাখাল শিশুর জীবন ॥ রাখাল শিশুর ঘুম ভাঙ্গে মোরগের ডাকে কিংবা গাঁয়ের মসজিদের আজানের ধ্বনিতে। খোয়ার থেকে গরু-মোষের পাল নিয়ে ছুটতে হয় মাঠে। বয়স ভেদে একেক শিশুর অধীনে থাকে দশ-বারো থেকে বিশ-পঁচিশটা পর্যন্ত গরু-মোষ। অনেক এলাকায় গরু-মোষ চরাতে পাড়ি দিতে হয় নদী, খাল কিংবা সাগর। পরণের লুঙ্গি মাথায় বেঁেধ গরু-মোষ সাঁতরে পার করাতে হয়। এটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। মাঠে গরু ছেড়ে মেলে কিছুটা অবসর। এ ফাঁকে বাড়ি থেকে আনা মরিচ পোড়া আর পান্তা ভাতে চলে সকালের নাস্তা। দুপুর পর্যন্ত চলে টানা গরু-মোষ চরানো। দুপুরে প্রত্যেকটি গরু-মোষকে গোসল করাতে হয়। নারকেলের ছোবরা দিয়ে গরু-মোষের গা ডলে পরিষ্কার করতে হয়। গোসল শেষে ছায়ায় তাদের বাঁধতে হয়। ছায়া না পেলে রোদেই রেখে দিতে হয়। ফাঁকে ফাঁকে রাখাল শিশু গোবর কুড়ায়। যা মহাজনের বাড়ি পৌঁছে দিতে হয়। মহাজনের বাড়িতে গোবর শুকিয়ে জ্বালানি বানানো হয়। যেসব গরু-মোষ দুধ দেয়, তা দোয়ানো ও মহাজনের বাড়ি পৌঁছে দেয়া রাখাল শিশুদের অন্যতম দায়িত্ব। দুপুর থেকে সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে আসার আগ পর্যন্ত এভাবেই গরু-মোষ আগলে রাখতে হয়। রাতে গুণে গুণে মহাজনের খোয়াড়ে গরু-মোষ তুলে বেঁধে রাখতে হয়। অনেক শিশু রাত কাটায় খোয়াড়ে। পটুয়াখালীর নির্জন চর-দ্বীপে এক ধরণের ছোট ঘরের দেখা মেলে। যাকে ‘দোয়ালাঘর’ বলা হয়। বর্ষায় আমন রোপনের মৌসুমে দোয়ালাঘর কৃষকরা নিজেদের অস্থায়ী বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার করে। কৃষকদের পাশপাশি রাখাল শিশুরাও দোয়ালাঘরকে বিশ্রামের আবাস হিসেবে ব্যবহার করে। রোদ, বৃষ্টি, শীত, কুয়াশা, ঝড়, বন্যা, তুফান, জলোচ্ছ্বাসসহ প্রাকৃতিক যে কোনও দুর্যোগই হোক, রাখাল শিশুদের মেলে না বিশ্রাম। বছরের বারো মাসই এভাবে কাটে দিন। এর ওপরে আছে মহাজনের চড় থাপ্পর গালি। কাজে একটু এদিক-সেদিক হলেই জোটে পিটুনি। রাখাল শিশুদের বয়স ষোল-সতেরো ছাড়ালে শুরু হয় আরেক জীবন। অনেকই বেছে নেয় কৃষি শ্রমিক এবং দিনমজুরের পেশা। অনেকে দ্বীপ-গাঁ ছেড়ে শহরে পা বাড়ায়। শহরে কেউ রিকশা চালায়। কেউ যোগালির কাজ করে। যে যেভাবে পারে, জীবিকা বেছে নেয়। এ বয়সে তারা বিয়েও করে। ঝুঁকির প্রান্তে জীবন ॥ সোনারচর, চরবনানী, চরআন্ডা, চরবেস্টিন, চরহেয়ার, চরলক্ষ্মী, চরকাসেম, চরকলাগাছিয়া, চরবড়মায়া, চরছোটমায়া, চরজাহাজমারাসহ পটুয়াখালী জেলার দক্ষিণে এমন আরও বেশ কিছু চর-দ্বীপ রয়েছে, যেগুলোতে স্থায়ী জনবসতি নেই। অবস্থানগত কারণে চরদ্বীপগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। এর চারদিকে সাগর। অন্যদিকে গভীর অরণ্য। বর্ষা মৌসুমে সামান্য জোয়ারে দ্বীপগুলো তলিয়ে যায়। এর ওপর ঘন অরণ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির হিংস্র বণ্যপ্রাণীর বাস। যেখানে নেই বেঁচে থাকার ন্যূনতম নিশ্চয়তা। নেই খাবারের ব্যবস্থা। নেই নিরাপদে রাত কাটানোর ব্যবস্থা। এমনকি নেই সুপেয় পানি পর্যন্ত। এসব চর-দ্বীপেও রাখাল শিশুরা গরু-মোষ চরায়। সেখানে তাদের থাকতে হয় দল বেঁধে। সাগরে জোয়ার এলে গাছে উঠতে হয়। গাছের ডাল কেটে খুঁটি বানিয়ে তার ওপরে গামছা বেঁধে আচ্ছাদন তৈরি করে খোলা প্রান্তরে কাটাতে হয় রাত। অনেক সময় রাতভর খড় কুটো জ্বালিয়ে হিংস্র প্রাণী তাড়িয়ে সময় পার করতে হয়। তারপরেও জীবনের প্রয়োজনে, জীবিকার তাগিদে অভাবী পরিবারের শিশুদের বেছে নিতে হয় রাখাল পেশা। -শংকর লাল দাশ, গলাচিপা থেকে
×