ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নগরবাসীর দায়িত্বহীনতা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সরব

ঢাকায় ‘রক্তগঙ্গা’

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

ঢাকায় ‘রক্তগঙ্গা’

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীতে প্রতিবছরই ঈদ-উল-আযহার দিন কোরবানি দেয়া গরু-ছাগলের রক্তসহ অন্যান্য বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ায় ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয় নগরবাসীকে। তবে এ বছর সেই সমস্যা অন্যরকম অবস্থা তৈরি করেছে। টানা বৃষ্টির পানিতে পশুর রক্ত মিশে নগরীর স্বাভাবিক জলাবদ্ধতাকে দিয়েছে ‘রক্তগঙ্গার’ রূপ। এতে দুর্ভোগের মাত্রা আরও বেড়েছে। এর জন্য ঢাকার পুরনো সমস্যা জলাবদ্ধতা আর পশু কোরবানিতে মানুষের অসচেতনতা অনেকাংশে দায়ী হলেও অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘অপ্রয়োজনীয়’ বিতর্ক শুরু করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে সারাদেশের ১১টি সিটি কর্পোরেশন ও ৫৩টি জেলা শহরে কোরবানির পশু জবাইয়ের জন্য ছয় হাজার ২৩৩টি স্থান নির্ধারণ করে দেয়া হলেও বাধ্যতামূলক নয় বলে সেগুলো ব্যবহার করা হয়নি বললেই চলে। তাই রাস্তাঘাটে যত্রতত্র কোরবানি দেয়ার ফলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি। যার জন্য মানুষের অসচেতনতাই মূলত দায়ী। তাছাড়া সিটি কর্পোরেশন বেশিরভাগ স্থানেই রাস্তার ওপর ব্যানার টাঙ্গিয়ে ওই স্থানকে পশু জবাইয়ের স্পট হিসাবে ঘোষণা দিয়েছে। কোরবানির প্রথম দিন থেকেই রাজধানীজুড়ে বর্জ্য অপসারণে কাজ করেছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। কোরবানি শুরুর পর থেকেই পাড়া-মহল্লায় তৎপরতা শুরু করেন দুই সিটির অধীনে প্রায় ১৩ হাজার পরিচ্ছন্নতাকর্মী। মঙ্গলবার দুপুরে নিজ নিজ এলাকায় দুই নগরপিতা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কাজের উদ্বোধন করে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বর্জ্য অপসারণের প্রতিশ্রুতি দেন। ঈদে রাজধানীতে তৈরি হওয়া হাজার হাজার টন কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণের কাজ চলেছে দ্রুত গতিতে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের চলা এ পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে সন্তুষ্টি জানিয়েছেন নাগরিকরাও। তবে, কোন কোন এলাকায় বর্জ্য অপসারণ করা হয়নি বলেও অভিযোগ করেছেন বাসিন্দারা। আবার, কোন কোন এলাকার বাসিন্দাদের উদ্যোগে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমও চলছে। মূলত বৃষ্টিই এ বছর অন্যরকম অবস্থা তৈরি করেছে রাজধানীতে। রাজধানীতে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই মানুষ তাদের কোরবানির পশু জবাই দিয়েছেন। অনেকেই বাসার সামনে রাস্তার ওপর কোরবানি দিয়েছেন। আবার ফ্ল্যাট বাসার ভেতরে কেউ কেউ কোরবানি দিলেও রক্ত-আবর্জনা সব পানি দিয়ে রাস্তায় গড়িয়ে দিয়েছেন। এতে রাস্তায় বৃষ্টির পানির সঙ্গে রক্ত মিশ্রিত পানি একাকার হয়ে রাজধানীর অনেকস্থানই ‘রক্তগঙ্গা’ রূপ ধারণ করেছে। এ প্রসঙ্গে অর্পা রহমান নামের একজন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ঢাকার রাস্তায় বৃষ্টির পানি জমে যাওয়া আর সাথে কোরবানির পশুর রক্ত মিশে রক্তের বন্যা ঘটাতে ঢাকার ড্রেন ব্যবস্থা যতটা দায়ী আপনার ফেলা চিপসের প্যাকেট, পানির বোতল, মুড়ির ঠোঙ্গা, বাদামের খোসা ঠিক ততটাই দায়ী! জি, আপনার দায়টা বোধহয় একটু বেশিও হতে পারে!’ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে দশটার দিকেই রাস্তায় রাস্তায় কোরবানি পশুর রক্ত, আবর্জনায় একাকার হয়ে যাওয়া নয়াপল্টন এলাকার কয়েকটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেন একুশে টেলিভিশনের সিইও মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল। এ প্রসঙ্গে কবির আহমেদ নামে আরেকজন তার স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘ঢাকার রক্তগঙ্গার যে দৃশ্য ভেসে উঠেছে সেটা অপরিকল্পিতভাবে পশু জবাইয়ের এক উদাহরণ। সিটি কর্পোরেশনের নির্দিষ্ট করে দেয়া স্থানে পশু জবাই না করার কারণে এমনটাই হলো হয়ত। এর দায় এখন কার? সাম্প্রতিক অতিপ্রচারণা যে শব্দে আটকে আছে সেটা হচ্ছে ‘উন্নয়ন’। দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসা এ গল্পের অন্তঃসারশূন্য রূপ এ জলাবদ্ধতা ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা। এ ব্যাপারে সরকার ও সিটি কর্পোরেশনের কী বক্তব্য?’ সিটি কর্পোরেশন কর্মীদের ‘বিরামহীন কাজ’ এবং ‘স্থানীয়দের সচেতনতা বৃদ্ধির’ ফলে ইতোমধ্যে ৩৬ ঘণ্টারও কম সময়ে রাজধানীর অলিগলি থেকে কোরবানির পশুর বর্জ্য সরিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। মানুষের পরিচ্ছন্নতাবোধ বৃদ্ধির ইতিবাচক প্রবণতাও তুলে ধরেন আতিক বাঙ্গাল নামের একজন। ফেসবুকে তিনি লেখেন, ‘ঢাকার রাস্তায় বৃষ্টির পানিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার পানির সাথে কোরবানির পশুর রক্ত মিশে পানির রঙ লাল হয়ে গেছে। এটা নিখাঁদ জলাবদ্ধতার সমস্যা। কোরবানি প্রতিবার যেভাবে হয় এবারও তার কোন ব্যতিক্রম হয়নি। আমি বরং দেখেছি আগের চেয়ে মানুষের পরিবেশ ও পরিচ্ছনাবোধ অনেক বেড়েছে। প্রায় সবাই পানি ঢেলে রক্ত ধুয়ে ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে দেয়।’ হাবিব বাবুল নামের একজন লিখেছেন, ‘জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের কথা চিন্তা করে যেখানেসেখানে কোরবানির পশু জবাই করার বিষয়টা সবার একবার ভেবে দেখা উচিত। বৃষ্টির পানির সাথে রক্ত মিশে ঢাকার কিছু কিছু রাস্তায় যে রক্ত স্রোতের ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হচ্ছে তা অবশ্যই শঙ্কার বিষয়।’ পশ্চিমা বিশ্বে তো অবশ্যই, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যেও কোরবানি হয় বিশেষ ব্যবস্থাপনায়, বিশেষ জায়গায়। মানুষ দাম দিয়ে টোকেন নিয়ে আসে, পরে গিয়ে মাংস নিয়ে আসে। কাতার এবং বাহরাইন গিয়ে এমন অভিজ্ঞতা অর্জনের কথা ফেসবুকে শেয়ার করেন সাংবাদিক শরীফুল হাসান। কাতারে কোরবানি দেয়ার নিয়ম সম্পর্কে তিনি লেখেন, ‘এই দেশে শহরের মধ্যে যেখানেসেখানে পশু জবাইয়ের কোন সুযোগ নেই। কোরবানি করা হয় শহরের বাইরে আবু হামর এলাকায়। সেখানে ভেড়া, ছাগল, গরু, উট সার বেঁধে রাখা। কেউ একজন যেটা পছন্দ করছেন সেটার নির্ধারিত মূল্য জমা দিয়ে কুপন সংগ্রহ করছেন। শুনলাম ঈদের দিন বা পরের দিন লাইনে দাঁড়িয়ে সেই কুপন নিয়ে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করলে ভেতর থেকে সেটি জবাই এবং মাংস কাটাকুটির কাজ শেষ হয়ে আসবে। ফলে ঈদ-উল-আযহায় কাতারের কোন সড়ক বা কোথাও কোন রক্ত বা পশুর বর্জ্য চোখে পড়ে না। পরদিন বাহরাইনে গিয়েও একই চিত্র পেলাম।’ অথচ এদেশের একেবারে বিপরীত চিত্রটাও তুলে ধরেন তিনি পোস্টটিতে, ‘মঙ্গলবার সকালে যারা ঢাকা শহরে বেরিয়েছেন তারা দেখবেন সব রাস্তাঘাট বৃষ্টির পানিতে সয়লাব। পশুর রক্তে সেই পানি হয়ে গেছে টকটকে লাল। মনে হবে দেশে বুঝি যুদ্ধ চলছে। সিটি কর্পোরেশন গতবছর থেকে কোরবানির স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু সেটা তদারকির কেউ নেই। ফলে সব রাস্তাই ভেসে যাচ্ছে রক্তে। ঈদের দিন বা পরের দিন আপনি কোথাও বের হবেন, দুর্গন্ধে টেকা দায়। আর এই যে রক্তস্নাত শহর কতা যে রোগ বালাই ছড়াবে কে জানে?’
×