মোস্তাফিজুর রহমান টিটু/নুরুল ইসলাম ॥ গাজীপুরের টঙ্গী বিসিক শিল্প নগরীতে ট্যাম্পাকো ফয়েলস প্যাকেজিং কারখানায় উদ্ধার কাজ সোমবার সকাল হতে শুরু করেছে সেনাবাহিনীর ১৪ স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডের সদস্যরা। রানা প্লাজার চেয়ে বেশি এ কারখানার ধ্বংসাবশেষ অপসারণের পুরো কাজ শেষ করতে দুই মাস সময় লাগার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। এদিকে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা-ের ঘটনার পর ষষ্ঠ দিন বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ওই কারখানার আগুন পুরোপুরি নিভেনি। এখনও কারখানার বিভিন্ন স্থানের ধ্বংসস্তূপ থেকে আগুনের ধোঁয়া বের হচ্ছে। ফলে ঝুঁকির মধ্য দিয়ে সেনা সদস্যসহ উদ্ধার কর্মীদের কাজ করতে হচ্ছে। ওই কারখানায় বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা-ের ঘটনায় বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৩৪ জনে দাঁড়িয়েছে। এদের মধ্যে ৭ জনের পরিচয় বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এছাড়া এখনও নিখোঁজ রয়েছেন ১০ জন। কারখানার এ ঘটনায় শীঘ্রই শ্রম আইনে মামলা হচ্ছে।
টঙ্গী মডেল থানার ওসি ফিরোজ তালুকদার জানান, টঙ্গীর বিসিক নগরীর ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেড কারখানায় গত শনিবার ভোরে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ২৫টির বেশি ইউনিটের কর্মীরা একটানা চেষ্টা চালিয়ে রবিবার সকালে নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে আগুন পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয়নি। বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত কারখানার বিভিন্ন স্থানের ধ্বংসাবশেষ থেকে আগুনের ধোঁয়া বেরোতে দেখা গেছে। আগুন পুরোপুরি নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কাজ করছে। ফলে হতাহতদের খোঁজে কারখানার ভিতরে এখনও তল্লাশি চালাতে পারেনি উদ্ধার কর্মীরা। ভয়াবহ এ ঘটনায় ওই কারখানার বিশাল ভবনের অধিকাংশই ধসে পড়ে বিশাল ধ্বংস স্তূপে পরিণত হয়। ধসে পড়ার পর ৫ তলা ভবনের অবশিষ্টাংশেও ফাটল দেখা দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এ ঘটনায় আগুনে দগ্ধ হয়ে এবং ভেঙে পড়া কাঠামোর নিচে চাপা পড়ে বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৪ জনে। এছাড়াও আহত হয় অর্ধশতাধিক। নিখোঁজ রয়েছে বেশ কয়েকজন। কারখানার ধ্বংসস্তূপে আরও লাশ বা জীবিত অবস্থায় কেউ আটকা থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন নিখোঁজদের স্বজন ও স্থানীয়রা। এ পরিস্থিতিতে সোমবার সকালে ভারি যন্ত্রপাতি নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৪ স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এএসএম মাহমুদ হাসানের নেতৃত্বে একটি দল বুলডোজার ও ভেক্যুসহ ভারি যন্ত্রপাতি নিয়ে টঙ্গীর ওই ট্যাম্পাকো ফয়েলস প্যাকেজিং কারখানায় উদ্ধার কাজ শুরু করে। বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত তারা দু’দিক থেকে কারখানা ভবনের ধ্বংসাবশেষ অপসারণ করছিল। তবে ঘটনাস্থলে কেমিক্যালের একাধিক ড্রাম থাকায় বেশ সতর্কতার সঙ্গে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। সেনা সদস্যরা বৃহস্পতিবার ওই কারখানার ধ্বংসাবশেষ থেকে খাট, চেয়ার, টেবিল, পাতিল, লেপ-তোষক, বইসহ বিভিন্ন মালামাল উদ্ধার করেছে। উদ্ধার কাজে তাদের সহায়তা করছেন গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও পুলিশ সদস্যরা। এর আগে উদ্ধার কাজের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য রবিবার রাতে সেনা বাহিনীর একটি দল ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ করেন।
এদিকে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এসএম আলম জানান, গত সোমবার সেনা সদস্যরা কারখানার পূর্বপাশে রাস্তার ওপর থেকে কারখানা ভবনের ধ্বংসাবশেষ অপসারণ করে ২ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করে। এর আগে সকাল ৭টার দিকে ভবনের তৃতীয় তলার ধ্বংসাবশেষ থেকে আরও দু’জনের লাশ উদ্ধার করে। এরপর মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর নর্দান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মোঃ মনোয়ার হোসাইন (৪০) নামের এক ব্যক্তি মারা যান। হাসপাতালের আইসিইউর আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ নাফিউল ইসলাম বলেন, তার শরীরের প্রায় ২০ শতাংশ দগ্ধ ছিল। অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের কারণে ফুসফুস ও খাদ্যনালী পুড়ে গিয়েছিল। পাশাপাশি বুকে ও মাথায় গুরুতর আঘাত ছিল। গত ১০ সেপ্টেম্বর টঙ্গীর ট্যাম্পাকোতে দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত মনোয়ার হোসাইনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে ওই হাসপাতালের আইসিইউতে জায়গা না থাকায় নর্দান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা ৩৪ জনে দাঁড়িয়েছে। এ ঘটনায় ১০ জন নিখোঁজ রয়েছেন বলে তালিকা পাওয়া গেছে। নিহতদের মধ্যে এ পর্যন্ত ২৭ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তাদের লাশ ইতোমধ্যে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে যে ৭টি লাশের পরিচয় এখনও পাওয়া যায়নি, তাদের পরিচয় শনাক্তের জন্য লাশগুলো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রাখা রয়েছে। পরিচয় শনাক্তের জন্য অজ্ঞাত ওই ৭টি লাশ আরও কিছুদিন সেখানে সংরক্ষণ করা হবে। তাদের পরিচয় শনাক্তের পরই লাশগুলো হস্তান্তর করা হবে।
দোষীদের বিরুদ্ধে শ্রম আইনে মামলা ॥ শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জানান, টঙ্গীর ট্যাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকা-ের ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে শ্রম আইনে মামলা করা হবে। ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের আর্থিক সহযোগিতার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। খুব দ্রুত তাদের আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে। এছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতদের নগদ ১৫ হাজার টাকা করে সহায়তা দেয়া হয়েছে। আর হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি থাকা আহতদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে।
ট্যাম্পাকো কারখানার ভয়াবহতা রানা প্লাজার চেয়েও অনেক বেশি ॥ সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দলের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এএসএম মাহমুদ হাসান জানান, টঙ্গীর বিসিক নগরীর ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেড কারখানাটির ভয়াবহতা রানা প্লাজার চেয়েও অনেক বেশি। এখানে যে পরিমাণ গার্বেজ (ধ্বংসাবশেষ) জমে রয়েছে তা রানা প্লাজার চেয়েও অনেক বেশি। সেনা সদর থেকে যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সে অনুযায়ী আমরা কাজ করছি। সোমবার সকালে আমরা আমাদের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছি। মূলত আমরা তিন দিক থেকে কাজ করবও। কিন্তু এখানে রয়েছে ইথাইল কেমিক্যালের ড্রাম- যেগুলো কাজের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। এসব ইথাইল ড্রাম একেকটা বোমার মতো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা ইথাইল ড্রামগুলো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। কোন ড্রামে খোঁচা লাগলে সেটি বোমার মতো বিস্ফোরিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ধরনের জায়গায় কাজ করার মতো অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। তাই ইথাইল ড্রামগুলোকে এড়িয়ে সাবধানতার সঙ্গে আমাদের কাজ করতে হবে। আমরা হয়ত সোমবার বিকেলের মধ্যে পূর্ব পাশের্^র ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে ফেলতে পারব। কিন্তু এখানকার পুরো কাজ শেষ করতে এক মাসের বেশি সময় লাগবে। এমনকি দু’মাসও লাগতে পারে।
কারখানার মালিক ও স্ত্রীসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা ॥ এদিকে দুর্ঘটনায় নিহত জুয়েলের পিতা আঃ কাদের বাদী হয়ে টঙ্গী মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় কারখানার মালিক মকবুল হোসেন ও তার স্ত্রী শেফালী পারভীনসহ ৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতদের আসামি করা হয়েছে। মামলার অন্য আসামিরা হলোÑ কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভির আহমেদ, মহাব্যবস্থাপক সফিকুর রহমান, ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মনির হোসেন, ব্যবস্থাপক (সার্বিক) সমীর আহমেদ, ব্যবস্থাপক হানিফ ও উপ সহকারী পরিচালক আলমগীর হোসেন। এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কী অভিযোগ আনা হয়েছে, তা স্পষ্ট হওয়া যায়নি। তবে ঘটনার পর থেকে মামলার আসামিরা পলাতক রয়েছে।
নিহত ২৭ জনের পরিচয় ॥ টঙ্গীর ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেড কারখানায় দুর্ঘটনায় নিহত ৩৪ জনের মধ্যে ২৭ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১০ জন নিখোঁজ রয়েছেন। বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসা নিয়েছেন ৩৪ জন। বৃহস্পতিবার দুপুরে দুর্ঘটনাস্থলের পাশে স্থাপিত জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুম সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
নিহতরা হলেনÑ টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার ভেংগুলা গ্রামের কৃষ্ণ প্রসাদের ছেলে সুভাষ চন্দ্র প্রসাদ (৩৫), ভোলার দৌলতখান গ্রামের জবুল হকের ছেলে জাহাঙ্গীর আলম (৪০), ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার কাকচুর গ্রামের আরশাদ আলীর ছেলে রফিকুল ইসলাম (২৮), একই জেলার ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার সরিষা গ্রামের আজিম উদ্দিনের ছেলে আবদুর রাশেদ (২৫), চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার রুহিতারপাড়া গ্রামের মৃত খালেক মাস্টারের ছেলে আবদুল হান্নান (৬৫)। কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী থানার মানিককাজী গ্রামের নিজাম উদ্দিনের ছেলে ইদ্রিস আলী (৪০), ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার বড়বাহ্রা গ্রামের মৃত নবদীপ দাসের ছেলে গোপাল দাস (২৫), একই উপজেলার চরমানপুর গ্রামের নিতাই সরকারের ছেলে শংকর সরকার (২৫), পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার পশ্চিম ফুলজুড়ি গ্রামের মৃত ইনজাম উদ্দিন আজাদের ছেলে আল মামুন (৪০), সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার সুন্দিসাই গ্রামের সোনা মিয়ার ছেলে এনামুল হক (৩৮), কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার আআস্তাফলা গ্রামের করিম বক্সের ছেলে সোলাইমান (৩৫), টাঙ্গাইল সদরের মধুপুর গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে আনিছুর রহমান (৫০), একই এলাকার মৃত তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে ওয়ালি হোসেন (৩৫), ভোলার দৌলতখান থানার লেজপাড়া গ্রামের মৃত তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে মাইন উদ্দিন (৩৫)। সিলেটের গোলাপগঞ্জের সুন্দিসাড়ি গ্রামের তনজিদ আলীর ছেলে সাইদুর রহমান (৫০), টাঙ্গাইল সদরের মধুপুর গ্রামের মৃত মচর আলীর ছেলে হাসান সিদ্দিকী (৫০), চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ এলাকার মোস্তাফিজুর রহমানের ছেলে মামুন ওরফে ক্লিনার মামুন (৪০), সিলেটের মিবগঞ্জ সোনাপাড়া এলাকার আবদুল আহাদের ছেলে মিজানুর রহমান (২৫), হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার বনদশক্যানপুর গ্রামের হাবিবুর রহমানের মেয়ে রোজিনা, বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার আদর্শপাড়া এলাকার মৃত মুকুল চন্দ্র দাসের ছেলে রিপন দাস (৩০)। এছাড়া শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার উত্তর মহিষা গ্রামের মৃত ওয়াজেদ আলীর ছেলে আনোয়ার হোসেন (৪০), সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার মুরাদনগর এলাকার ওয়াহিদুজ্জামান তপন (৩৬), শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার পুরাঘর এলাকার আবদুল খালেকের ছেলে দেলোয়ার হোসেন (৫০), হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার আদমপুর এলাকার হাবিবুর রহমানের মেয়ে তাহমিনা আক্তার (২০), ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার পাবাডুবি এলাকার রসি মিয়ার ছেলে আশিক (১৪) ও শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার আনাখন্দ গ্রামের উদ্দিন দেওয়ানের ছেলে মনোয়ার হোসেন (৩৮)।
নিখোঁজ ১০ জনের তালিকা ॥ অগ্নিকা-ে ১০ জন নিখোঁজ রয়েছেন। তারা হলেনÑ মাগুরা সদরের চনপুর ইগরন গ্রামের আব্দুস ছালেক মোল্লার ছেলে কাজিম উদ্দিন (৩৬), টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের উকলমি গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে জহিরুল ইসলাম (৩৭), লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার শিবপুর আবু তাহেরের ছেলে রিয়াদ হোসেন মুরাদ, একই গ্রামের সুলতান গাজীর ছেলে আনিসুর রহমান (৩০), কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার মেসেরা গ্রামের আব্বাস আলীর ছেলে রফিকুল ইসলাম (৪০)। চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার পলাখান গ্রামের ইউসুফ পাটোয়ারীর ছেলে নাসির পাটোয়ারি, কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার টনকি গ্রামের তোফায়েল হোসেনের ছেলে মামুস আহমেদ (৩০), ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ভীমনগর গ্রামের মোজাম মোল্লার ছেলে চুন্নু মোল্লা, সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ ফানিশাইল গ্রামের হাজী আবদুল করিমের ছেলে রেদোয়ান আহমেদ ও সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার আলীনগর গ্রামের মৃত তমিজ উদ্দিনের ছেলে জয়নুল ইসলাম।
বয়লার অক্ষত ॥ টঙ্গীর ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেড কারখানায় দুর্ঘটনায় গঠিত একাধিক তদন্ত কমিটি ছাড়াও বিশেষজ্ঞগণ ইতোমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। বিশেষজ্ঞগণের দাবি বয়লার বিস্ফোরণে নয়, গ্যাস লাইন লিক হয়ে ট্যাম্পাকো কারখানায় বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। এ ব্যাপারে শিল্প মন্ত্রণালয়ের বয়লার পরিদর্শক ইঞ্জিনিয়ার শরাফত আলী জানান, ট্যাম্পাকো কারখানায় দুটি বয়লার রয়েছে। এগুলো আগামী ২০১৭ সালের জুন মাস পর্যন্ত নবায়ন করা আছে। অগ্নিকা-ের পরও কারখানার দুটি বয়লার অক্ষত আছে। তাই বয়লার বিস্ফোরণে নয়, গ্যাস লিকেজ থেকে এ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। তবে তদন্তের পর এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
কারখানার বয়লার অপারেটর ইনচার্জ ইমাম উদ্দিন বলেন, কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণের কোন সম্ভাবনাই নেই। আমরা বয়লার রুমে গিয়ে দেখেছি বয়লার দুটি এখনও অক্ষত আছে। তবে গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে কারখানায় গ্যাস লাইনে লিকেজ সৃষ্টি হয়েছিল। সে কারণে হয়তো অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটতে পারে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ট্যাম্পাকো কারখানায় মোট ৪টি বয়লার ছিল। তবে প্রতিষ্ঠানটির এ দায়িত্বশীল কর্মকর্তা দাবি করছেন দুটি ও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ওই কারখানায় দুটি বয়লারের অনুমোদন রয়েছে।
এদিকে কারখানায় সরকারীভাবে গ্যাস ব্যবহারের অনুমোদন ছিল ১০ পিএসআই। কারখানার বয়লার এবং জেনারেটর গ্যাসের সাহায্যে চলত। এ দুর্ঘটনার পর থেকে কারখানার আশপাশের এলাকায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে তিতাস কর্তৃপক্ষ।
উল্লেখ্য, গত শনিবার ভোরে গাজীপুরের টঙ্গী বিসিক শিল্প নগরীতে ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেড কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। এতে কারখানা ভবন ধসে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের ২৫টির বেশি ইউনিটের কর্মীরা রবিবার সকালে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও পুরোপুরি নেভাতে পারেনি। ইতোমধ্যে কারখানা ভবনের অধিকাংশই ধসে পড়ে। ফলে এঘটনায় আগুনে দগ্ধ হয়ে এবং ভেঙ্গে পড়া কাঠামোর নিচে চাপা পড়ে শনিবার রাত পর্যন্ত মৃত্যু হয় ২৪ জনের। আহত হয় অর্ধশতাধিক। আহতদের মধ্যে অন্তত ৩৫ জন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, টঙ্গী সরকারী হাসপাতাল ও উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আহতদের মধ্যে ঘটনার পরদিন রবিবার সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রিন্টিং অপারেটর রিপন দাস (৩০) নামের আরও একজন মারা যায়। এছাড়াও রবিবার সন্ধ্যায় ওই কারখানার পূর্ব পাশে রাস্তার ওপর ধসে পড়া ভবনের ধ্বংসস্তূপ অপসারণ করে আরও ৪ জনের লাশ উদ্ধার করে কর্মীরা। সোমবার ধ্বংসস্তূপ থেকে আরও চার জনের লাশ উদ্ধার করে সেনা বাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার কর্মীরা। মঙ্গলবার রাতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কারখানার লেদ সেকশনের ইনচার্জ মনোয়ার হোসেন নামের আরও একজন মারা যায়। এ নিয়ে ওই ঘটনায় এ পর্যন্ত ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।
৬ দিন পরও খোঁজ মেলেনি ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা মির্জাপুর থেকে জানান, মির্জাপুর উপজেলার উফুল্কী গ্রামের জহিরুল ইসলাম ওরফে জুলহাসের ছয় দিনেও খোঁজ মেলেনি। শনিবার টঙ্গীর ট্যাম্পাকো কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনায় তিনি নিখোঁজ হন। তার পিতার নাম মৃত আবুল হোসেন। তিনি ওই কারখানায় সহকারী অপারেটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
শনিবার ওই কারখানায় অগ্নিকা-ের খবর বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রচারের পরই তার মা জেলেকা বেগম, স্ত্রী জাবেদা বেগম ও তিন বছরের একমাত্র সন্তান নাহিদকে নিয়ে জহিরুলের চাচা হাবিবুর রহমান তার খোঁজে টঙ্গী চলে যান। বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজাখুঁজির পরও তার হদিস না পাওয়ায় ঈদের দিন সকালে চাচা হাবিবুর রহমান বাড়ি ফিরে আসেন বলে জানিয়েছেন।
তিনি আরও জানান, সংসাদের জহিরুলের ভিটেমাটি ছাড়া আর কিছুই নেই। পিতা আবুল হোসেনের মৃত্যুর পর তিন বছর আগে জহিরুল ওই কারখানায় চাকরি নেয়। এ বেতনের টাকায় তার পরিবারের ব্যয়ভার মিটত।
তার চাচা হাবিবুর রহমান আরও জানান, শনিবার সকালে জহিরুল তার মা জেলেকা বেগমকে ফোন করে বলেছিল ২টা পর্যন্ত ডিউটি করে বেতন হাতে নিয়ে পরদিন ঈদের ছুটিতে বাড়িতে আসবেন। কিন্তু তার কিছুক্ষণ পরই ওই কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। সেই থেকে জহিরুল নিখোঁজ রয়েছে।
জহিরুলের ছোট বোনের স্বামী আলাউদ্দিন চৌধুরী জানান, অগ্নিকা-ের ১০ মিনিট আগে জহিরুল কারখানায় প্রবেশ করে। এখনও জহিরুলের খোঁজে তার মা জেলেকা বেগম, স্ত্রী জাবেদা বেগম টঙ্গীতে অবস্থান করছেন। কিন্তু তার কোন খোঁজ মেলেনি।