ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মনোয়ার হোসেন ॥ এখনও আড়মোড়া ভেঙ্গে পুরোদমে জেগে ওঠেনি ব্যস্ত শহর ঢাকা। শহরের শরীরে যেন ভর করেছে আলস্য। জড়তা কাটিয়ে পায়নি সম্পূর্ণ সচলতা। ছয় দিনের লম্বা ছুটি শেষে জীবিকার তাগিদে চাকরিজীবীদের অনেকে বৃহস্পতিবার ফিরেছেন রাজধানীতে। শহর ছেড়ে যাওয়ার তুলনায় বাস, ট্রেন ও লঞ্চে করে ফেরাটা হয়েছে কিছুটা স্বস্তির। একসঙ্গে সবাই ঢাকায় না ঢোকার কারণে যাত্রী ও পরিবহনের চাপ কম থাকায় পথে পথে পোহাতে হয়নি দুর্ভোগ। তবে শ্রমজীবী ও ব্যবসায়ীসহ শহরবাসী মানুষের বিশাল অংশটি এখনও ফেরেনি। সেই সঙ্গে চাকরিজীবীদের অনেকেই ছয় দিনের ছুটির সঙ্গে বৃহস্পতিবারকে যোগ করে ছুটিকে পরিণত করেছেন টানা নয় দিনে। এ কারণেই ঢাকা এখনও অনেকটাই ফাঁকা। নেই তার সেই কোলাহল কিংবা বিরক্ত করা যান ও জনজট। শহরে বিরাজ করছে ছিমছাম ভাব। এ শহর ঘিরেই গড়ে উঠেছে যাদের শিকড়Ñ তাদের কাছে শত বিড়ম্বনার শহরটা হয়ে উঠেছে বেশ আনন্দের। ফাঁকা হওয়া ঢাকায় চলছে ঈদ উদযাপনে ঘোরাঘুরি। নিমিষেই ছুটে বেড়ানো যাচ্ছে নগরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। তাই বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির নগরে বয়ে যাচ্ছে ঈদ বিনোদনের হাওয়া। চিড়িয়াখানা, শিশুপার্ক, সিনেমা হলসহ বিভিন্ন ধরনের বিনোদন কেন্দ্রে ভিড় জমেছে ঈদ উদযাপনকারী মানুষের। সব মিলিয়ে চোখে পড়ছে শহরের প্রতি ভাললাগার আবেশ। আশা করা যাচ্ছে কাল শনিবার পর্যন্ত থাকবে এই নির্ঝঞ্ঝাট ভাব। তারপর শহরটি ফিরে পাবে তার সেই চিরচেনা রূপ। খুলে যাবে শহরের সব অফিস বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ফুটপাথে শোনা যাবে হকারের চিৎকার, সড়কগুলোয় বিকট শব্দে বাজবে গাড়ির হর্ন, যানজটে পড়ে যাত্রীকে নষ্ট করতে হবে কয়েকটি ঘণ্টা। আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলেছিল, কোরবানি ঈদের প্রথম দিন মঙ্গলবার বৃষ্টি হবে। প্রায়শই আবহাওয়ার বার্তা না মিললেও এদিন পুরোপুরি মিলে গেছে। সকাল হওয়ার আগেই আকাশ থেকে ঝরেছে জলধারা। তুমুল বারিধারায় সয়লাব হয়েছে রাজধানীর পথঘাট। বৃষ্টি থামার লক্ষণ না দেখে বাধ্য হয়ে কিংবা অতি উত্তেজনায় অধৈর্য হয়ে অনেকেই বৃষ্টির ভেতরেই আত্মশুদ্ধির প্রত্যাশায় পশু কোরবানি দিয়েছেন। জলে ভিজে আত্মসংযমের মাধ্যমে আপন অন্তরের পশুত্বকে পরিহারের চেষ্টা করেছেন। তবে টানা বৃষ্টিজনিত জলাবদ্ধতায় পরিণত হওয়া পুরান ঢাকার অলি-গলির সড়কগুলো পশুর রক্তের সঙ্গে মিশে ধারণ করেছিল লাল রং। স্বাভাবিকভাবেই পথ চলাচলে পোহাতে হয়েছে বিড়ম্বনা। রক্তমিশ্রিত পানি মাড়িয়ে তবেই চলাচল করতে হয়েছে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত স্থানগুলোয় কেউ কোরবানি না দেয়ায় ঝামেলার মাত্রা হয়েছে দ্বিগুণ। উল্টো অভিযোগও ছিল নগরবাসীর, কোরবানির নির্ধারিত স্থানে সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক নিয়োজিত কসাই থাকার কথা থাকলেও কোথাও সেই ব্যবস্থা ছিল না। এছাড়া ঈদ-উল-আযহার প্রথম দিনটিতে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি লক্ষ্য করা গেলেও দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন থেকে বর্জ্য অপসারণে কাজ করেছে উত্তর ও দক্ষিণ ঢাকা সিটি কর্পোরেশন। শেষ পর্যন্ত পশুর বর্জ্য পরিষ্কারে যথাযথ ভূমিকা রাখায় ঢাকাবাসীর প্রশংসা কুড়িয়েছে দুই সিটি কর্পোরেশন। এবার আসি ঈদ-উল-আযহাকে কেন্দ্র করে নগরবাসীর বিনোদনের কথায়। উৎসবপ্রিয় বাঙালীর কাছে স্বমহিমায় ধরা দিয়েছে মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্যতম এ ধর্মীয় উৎসব। যদিও আনন্দপ্রিয় বাঙালীসত্তার কাছে ধর্মের গ-ি পেরিয়ে সৌহার্দ্যরে পথরেখায় এসব ধর্মীয় উৎসও পেয়ে যায় সার্বজনীন রূপ। গৌণ হয়ে যায় হিন্দু-মুসলমান কিংবা বৌদ্ধ-খ্রীস্টানের পরিচয়। উৎসবের সন্ধানে সবাই এক সুরে মেতেছে আনন্দের অবগাহনে। ঈদ আনন্দ উদ্যাপনে নগরবাসীর সরব পদচারণায় রাজধানীর বিনোদন কেন্দ্রগুলো হয়েছে মুখরিত। ঈদের ছুটিতে ফাঁকা হওয়া ঢাকায় বিরাজ করেছে সুখময় দৃশ্যকল্প। অপার বিনোদনের সন্ধানে শহরময় ছুটে বেড়িয়েছে বিনোদনপিপাসু নগরবাসী। ট্রাফিক জ্যামহীন শহরে মনের সুখে ঘুরে বেড়িয়েছে শহরবাসী। বিশেষ উপলক্ষে কিছুটা নীরব হওয়া শহরে ক্রিং ক্রিং শব্দ তুলে চলেছে রিকশাভ্রমণ। নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই পৌঁছানো গেছে কাক্সিক্ষত গন্তব্যে। ফলে ঘোরাঘুরিটাও হয়েছে আরামদায়ক ও স্বস্তিকর। ঢাকার সব রাস্তা যেন শাহবাগের শিশুপার্ক, জাতীয় জাদুঘর, মিরপুরের চিড়িয়াখানা, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, শ্যামলীর শিশুমেলা, যমুনা ফিউচার পার্ক, পুরান ঢাকার লালবাগ কেল্লা কিংবা আহসান মঞ্জিলে গিয়ে ঠেকেছিল। শিশু-কিশোরদের নিয়ে পরিবারের সদস্যরা ঘুরে বেড়িয়েছেন এসব পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্রে। ঘোরাঘুরির তালিকায় বাদ যায়নি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, হাতিরঝিল, চন্দ্রিমা উদ্যান, সংসদ ভবনের চারপাশ কিংবা পুরান ঢাকার বলধা গার্ডেনসহ বিভিন্ন স্পট। ঢাকার অদূরে ফ্যান্টাসি কিংডম বা নন্দন পার্কেও রকমারি রাইডে চড়ে উৎসব উদযাপন করেছে অনেকে। এ তালিকায় বাদ পড়েনি ঐতিহাসিক স্থাপনার রেপ্লিকায় সাজানো হেরিটেজ পার্কও। অন্যদিকে ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি ঘরে ঘরে চলেছে অতিথিবান্ধব বাঙালীর অতিথি আপ্যায়ন। মধুমিতা, স্টার সিনেপ্লেক্স, বলাকা কিংবা ব্লকবাস্টার সিনেমাসে নতুন আসা ঢাকাই ছবিটি দেখেও আনন্দ উপভোগ করেছেন অনেক সিনেমাপ্রেমী। কেউ বা বিজ্ঞাপনের বিড়ম্বনা নিয়েই আনন্দ খুঁজেছেন চ্যানেলে চ্যানেলে বিনোদনমূলক নাটক, গান, সেলিব্রেটিদের আড্ডা কিংবা সঙ্গীতানুষ্ঠান দেখে। ঈদের প্রথম দিন মঙ্গলবার দিনভর বৃষ্টি হওয়ায় মূলত বুধবার থেকে শুরু হয়েছে শহরবাসীর বিনোদন উদযাপন। বৃহস্পতিবারও বয়ে গেছে ঈদ উদযাপনের সেই স্রোতধারা। সোনামণিদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়েছে রাজধানীর বিভিন্ন পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্র। চিড়িয়াখানার প্রাণিরাজ্য অবলোকন করে কিংবা শিশুপার্কের রাইডে চড়ে আপন আনন্দ মিটিয়েছে শিশুরা। ঈদের ছুটিতে সবচেয়ে বেশি সরগরম ছিল রাজধানীবাসীর অতিপ্রিয় এ দুটি বিনোদন কেন্দ্র। আর উৎসবের এই বর্ণময়তায় যেন এককালের তিলোত্তমা ঢাকা পরিণত হয়েছে আনন্দ নগরীতে। ঈদের দ্বিতীয় দিন বুধবার থেকে খোলা ছিল আনন্দ উদযাপনে সোনামণিদের তীর্থস্থান শাহবাগের শিশুপার্ক। রোমাঞ্চ চক্র, আনন্দ ঘূর্ণি, উড়ন্ত বিমান, উড়ন্ত নভোযান, ঝুলন্ত চেয়ার, লম্ফঝম্ফ, ব্যাটারি কার, এফ সিক্স জঙ্গীবিমান, রেলগাড়ি ও বিস্ময় চক্রÑ এমন সব মজার রাইডার নিয়ে শিশুদের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত ছিল শিশুপার্ক কর্তৃপক্ষ। শিশুপার্কের দায়িত্বে নিয়োজিত সহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ নুরুজ্জামান জানান, ঈদের দ্বিতীয় দিন বুধবার থেকে খুলেছে শিশুপার্ক। সে হিসেবেই ঈদ ছুটির পর পার্ক খোলার প্রথম দিনেই দর্শনার্থী এসেছে ২৭ হাজার। ঈদের ছুটিতে সবচেয়ে বেশি ভিড় জমেছিল মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানায়। শিশুপার্কের মতো এখানেও ঈদের দ্বিতীয় দিন বুধবার ভিড় জমিয়েছেন অগণন দর্শনার্থী। পরিবার-পরিজনের সঙ্গে নির্মল সময় কাটিয়েছেন এই প্রাণিরাজ্যে। দর্শনার্থীরা মন ভরে উপভোগ করেছেন বাঘের গর্জন, বানরের চেঁচামেচি, বেবুনের ভেংচি, উটপাখির দৌড়াদৌড়ি, জলহস্তির ডুবসাঁতার, ময়ূরের নাচ, নানান জাতের সাপের ধীরগতিতে পথচলাÑ আরও কত কী? সবচেয়ে বেশি ভিড় দেখা যায় বানরের খাঁচার সামনে। কারণ অন্য প্রাণী চিড়িয়াখানায় আসার পর তাদের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য সামান্য হলেও হারিয়ে ফেলে। কিন্তু বানরের বাঁদরামি এখানে বিন্দুমাত্র কমে না। তারা সব সময়ই প্রাণবন্ত থাকে ও সারাক্ষণ খাঁচার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত লাফালাফি করতে থাকে। শিশু-কিশোরও অনেক সময় যোগ দেয় তাদের বাঁদরামোর সঙ্গে। অনেকেই শিশু-কিশোরসহ পরিবারের বিভিন্ন বয়সের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে দিনভর চিড়িয়াখানার পশুপাখি দেখে সময় কাটিয়েছেন। কেউবা আবার বাসা থেকে নিয়ে আসা আহারপর্বটিও সেরেছেন সেখানেই। শ্যামলীর শিশুমেলায়ও ঈদের দ্বিতীয় দিন থেকে দেখা গেছে ছোট ছোট শিশু-কিশোরদের হৈ-হুল্লোড়। এখানে অভিভাবকদের সঙ্গে আসা শিশুরা উপভোগ করেছে প্যারাট্রুপার, ভাইকিং বোট, রেসিং বাইকসহ বিভিন্ন রাইড। পুরো প্রাঙ্গণে ছিল ঈদের আমেজ। ঈদের দ্বিতীয় দিন বুধবার থেকে খুলে যায় জাতীয় জাদুঘর। খোলা থাকে বেলা ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। সাধারণ দর্শনার্থী ছাড়া এই তিন দিন শিশু-কিশোর, শিক্ষার্থী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য বিনাটিকেটে জাদুঘর পরিদর্শনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এছাড়া ঈদের দ্বিতীয় দিন বুধবার থেকে তরুণদের আগমনে মুখর ছিল শাহবাগ ও টিএসসি চত্বর। অন্যদিকে গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরায় গড়ে ওঠা ইনডোর রেস্তরাঁগুলো দুপুর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ছিল বিনোদনপিয়াসী মানুষের আনাগোনায় সরগরম। খোলা আকাশে নিচে নয়, কাঁচঘেরা মনোরম পরিবেশে ফুড কর্নারে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কফি আর মুখরোচক খাবারে বিরামহীন আড্ডা দিয়ে সময় পার করেছে তরুণের দল। বৃক্ষরাজি দেখা আর সবুজ ঘাসে হাঁটার আনন্দে জনসমাগম ঘটেছে সোহরাওয়ার্দী, রমনা কিংবা চন্দ্রিমা উদ্যানে। ঈদের আনন্দকে বর্ণাঢ্য করতে নগরবাসী ছুটেছেন রাজধানীর বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রে। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা হাজির হয়েছেন নন্দন পার্ক, ওয়ান্ডারল্যান্ড, ওয়াটার ওয়ার্ল্ডসহ রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত হোটেলের চিলড্রেন কর্নারগুলোতে। ঈদের ছুটিতে প্রথম দিন থেকেই উৎসুক জনসমাগম ঘটে পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক স্থাপনা লালবাগ কেল্লায়। অনেকেই ভিড় জমিয়েছেন ঐতিহ্যবাহী এ কেল্লায় আনন্দঘন কিছুটা সময় কাটাতে। জেনে নিয়েছেন ১৬১০ সালে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গড়ে ওঠা এ ঐতিহাসিক স্থাপনার নানা বিষয়। শুধু লালবাগের কেল্লা নয়, পুরান ঢাকার বলধা গার্ডেন, আহসান মঞ্জিলসহ বেড়ানোর জায়গাগুলোতে সপরিবারে বেড়িয়েছেন অনেকে। এদিকে আনন্দের সন্ধানে অনেকেই ছুটে গেছেন বিভিন্ন সিনেমা হলে। বসুন্ধরা সিটির স্টার সিনেপ্লেক্সে সিনেমা দেখার পাশাপাশি ফাস্টফুডের দোকানগুলোতে জমে ওঠে দীর্ঘ আড্ডা। এছাড়াও ঢাকার যমুনা ব্লকবাস্টার সিনেমাস, মধুমিতা, অভিসার, জোনাকী, বলাকা, রাজমণিসহ বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহেও সিনেমাপ্রেমীদের কমতি ছিল না। ঈদকে রংময় করতে ছবি দেখে কাটিয়ে দিয়েছেন বেশ কিছুটা সময়। ঈদ উপলক্ষে মুক্তি পেয়েছে তিনটি ঢাকাই ছবি। এগুলো হলোÑ বসগিরি, শূটার ও রক্ত। বলাকা, মধুমিতাসহ বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হচ্ছে ছবিগুলো।
×